প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের স্বাস্থ্য শিক্ষা

December 26, 2019,

মোহাম্মদ মোতাহার  বিল্লা॥ আমরা জানি সু-স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। তাই স্বাস্থ্য সচেতনতা সুস্বাস্থ্য জীবনের জন্য অপরিহার্য। একজন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী শিশু সুন্দর জীবন যাপনে অভ্যস্থ হয়ে ওঠে যা তাকে ভবিষ্যতে উন্নত জীবনের প্রতিশ্রুতি দেয়। শিশুরা প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে হাতে কলমে স্বাস্থ্য সচেতনতা সম্পর্কে ধারণা লাভ করে থাকে। শিক্ষকগণ ছাত্র-ছাত্রীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য প্রদান করেন। আমরা জানি আমাদের অধিকাংশ অভিভাবক স্বাস্থ্য সম্পর্কে অসচেতন।। স্বাস্থ্যশিক্ষা সম্পর্কে তাদের সুস্পষ্ট ধারনা নেই। ফলে আমাদের শিশুরা সু স্বাস্থ্যের অধিকারী হবে না এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে কষ্টে জীবন যাপন করছে। মা সমাবেশের মাধ্যমে মায়েদের নিজেদের ও সন্তানদের স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শ প্রদান করে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। প্রয়োজন Health Card চালু করে ডাক্তারের পরামর্শ প্রদানের ব্যবস্থ্যা করতে হবে।
পুষ্টি বিষয়ক জ্ঞান : সুস্বাস্থ্যের প্রধান চাহিদা সুষম পুষ্টিকর খাবার। কিন্তু আমাদের অধিকাংশ মানুষের পুষ্টিজ্ঞান সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। আমরা প্রতিদিন দেখা যায় একই উপদানের খাদ্য গ্রহণ করছি। অথচ যদি সচেতন হই তাহলে বিভিন্ন দিনে ভিন্ন ভিন্ন উপাদানের খাদ্য গ্রহণ করতে পারি। সুস্বাস্থ্যের জন্য অতীব জরুরী।
নিরাপদ পানি : নিরাপদ জানি সুস্বাস্থ্যের জন্য অন্যতন জরুরী উপাদান। নিরাপদ পানি পান করলে পেটের পীড়া, কলেরা, ডায়েরিয়া, আময়য়, টাইফয়েডসহ অসংখ্যরোগ থেকে নিরাপদ থাকা যায়। তাই গৃহ ও বিদ্যালয়ে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং শিশুদের অনিরাপদ পানি পানের ক্ষতিকর দিক ও নিরাপদ পানি পানের সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
টিকা : আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই এই শিশু সুস্থ ও সবল করে গড়ে তুলতে সথাসময়ে সঠিক টিকা প্রদান করতে হবে। টিকা প্রদানে শিশুর শারীরিক সক্ষমতা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে শিশুরা নিরোগ থেকে শিক্ষালাভে অধিক ও কার্যকরী সময় ব্যয় করতে পারে।
নিরাপদ ও স্বাস্থ্য সম্মত টয়লেট : শিশু স্বাস্থ্য রক্ষায় টয়লেটের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপদ ও স্বাস্থ্য সস্মত টয়লেট ব্যবহারের অভ্যাস শিশুকে স্বাস্থ্যকর জীবন ও ব্যক্তিত্ববোধ সম্পন্ন করে গড়ে তোলে। তাই বিদ্যালয়ে শিশুদের টয়লেট ব্যবহারের নিয়ম কানুন অবহিত করে তাদের স্বাস্থ্য সচেতন করে তুলতে হবে। টয়লেট ব্যবহারের পর তা অপরের জন্য উপযোগী করে রাখা এবং সাবান দিয়ে হাত পরিস্কার করা। তাই বিদ্যালয়ে পর্যান্ত নিরাপদ পানি ও অধিক সংখ্যক টয়লেটের ব্যবস্থা করা। সুখবর যে সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকল্পে আধুনিক ওয়াশব্লক নির্মাণ করছে যা শিশুদের বিদ্যালয়ে গমনে আগ্রহী করে তুলেছে।
বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা : আমরা জানি বিদ্যালয়ে প্রবেশের পূর্বেই অনেক শিশু বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়। জন্মের পর শিশু স্বল্প ওজন, বামন উচ্চতা, চক্ষু ও কানের সমস্যা দেখা দেয়। তাই যদি সঠিক সময়ে এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা যায় তাহলে এই সকল সমস্যার সমাধান করা যায় এবং শিশুদের সুস্থ্য সবল জীবনের সংস্থান করা যায়। এই ব্যাপারে অভিভাবক ও শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী শিশুরাই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তাই বর্তমান সরকার শিশুদের সুস্বাস্থ্যের জন্য মায়ের হাতে যত্নে তৈরি মিড-ডে-মিল নিশ্চিত করার পাশাপাশি সকলের জন্য রাষ্ট্রিয়ভাবে মিড-ডে-মিল ব্যবস্থার উদ্যেগ গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি ক্ষুদে ডাক্তার ধারনা ছাত্র-ছাত্রীদের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে স্বাস্থ্য সচেতন করে গড়ে তুলছে।
শিশুদের মেধা বিকাশে ইনোভেশন ধারনার বাস্তাবায়ন :
চ্যাম্পিয়নদের সাথে সাধারণ মানুষের পার্থক্য হচ্ছে – একই খেলায় বা প্রতিযোগিতায় তারা ছুড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য জ্ঞানকে চর্চা ও সাধনার মাধ্যমে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায় যা কালক্রমে তাদের বিজয় করে তুলে। আমরা জানি, বর্তমান সময় অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। এখানে বর্তমান সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে কৌশলে অন্যকে পিছিয়ে ফেলতে হয়। তাই সেজন্য এমন কিছু কৌশল বা ধারণা তৈরী করতে হবে যা গৎবাঁধা ও সকলের সাথে হুবহু না হয়। যে কৌশল নতুনত্বে আভাষ দিবে বা আরো বেগবান ও আধুনিক করবে যাতে প্রাপ্তি অধিক হয়। সৃজনশীলতা ও মননশীলতা ঘটিয়ে এমন কৌশল উদ্ভাবন করতে হবে যাতে সমস্যা অতি সমজেই সমাধান করা যায়। আমরা জানি, প্রত্যেক মানুষের আবেগ রয়েছে এবং সে অনুযায়ী সে তার যোগ্যতা চর্চা করে থাকে। কিন্তু যে শিশু সেই যোগ্যতাকে কালোত্তীর্ণ ও বিকশিত করতে পারে সে শিল্পী নামে ধারণ করতে পারে। তাই আমাদের বিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষককে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জ্ঞান বিজ্ঞানে শক্তিশালী হিসেবে তৈরি করতে ইনোভেশন আইডিয়া উদ্বুদ্ধকরণ ও বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের মেধা বিকাশে এবং তাদের স্বপ্ন ও আকাঙ্খা পুরনে সহায়তা করতে হবে। আমরা জানি প্রত্যেকটি শিশু অপার সম্ভাবনার অধিকারী। আমরা যদি তাদের সেই সম্ভাবনা বিকাশে সুযোগ করে দিতে পারি তাহলে প্রতিটি শিশু হবে জাতির জন্য এক মানব সম্পদ যা সর্বিকভাবে দেশের জন্য অপরিহার্য।
Student of the day :   প্রাথমিক শিক্ষায় বর্তমানে সবচেয়ে যুগান্তকারী এবং কার্যকরী উদ্যোগ হচ্ছে Student of the day  ধারনা। শিশুরা আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণে অধিক পারদর্শী। শিক্ষকরা যদি শিশুদের মাঝে সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহনের উদ্যোগ গ্রহণ করে তাহলে শিশু খেলতে খেলতে শিক্ষা লাভ করতে পারবে। প্রতিদিন শিশুদের তাদের বিদ্যালয় প্রাঙ্গন ও শ্রেণিকক্ষে Performance অনুসারে শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী হিসেবে ঘোষণা করলে সকলের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হবার বাসনা তৈরি হবে যা তাদের শিক্ষা লাভে উৎসাহিত করবে। শিশুদের মেধার স্বীকৃতি দিয়ে তাদের পুরস্কৃত করলে তাদের মধ্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাবে।
ডিজিটাল কনটেন্ট : আনন্দদায়ক পাঠ শিশু শিক্ষার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শিশুরা সবসময় আনন্দের সহিত শিক্ষা গ্রহণে অধিক উৎসাহী। তাই আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া, আকর্ষনীয় শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করে পাঠের ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করতে হবে। আমরা জানি শিশুরা স্বভাবতই যন্ত্রপ্রেমী। তাই ডিজিটাল কনটেন্ট এর মাধ্যমে আনন্দদায়ক শিক্ষা প্রদান করলে তা শিশু মস্তিস্কে ধারন করা অতি সহজতর এবং এর প্রবাব সূদুর প্রসারী হয়। তাই শিক্ষকদের এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
মিড ডে মিল : শিশুর শিক্ষা লাভের জন্য সুস্বাস্থ্য, অত্যন্ত জরুরী। একজন স্বাস্থ্যবান শিশুই শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে নিজেকে ভবিষ্যতের জন্য যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারে। তাই শিশুর সু-স্বাস্থ্যের জন্য বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল ধারনা চালু করা অত্যন্ত সময় উপযোগী ও ইনোভেশন ধারনা। শিক্ষা গ্রহণ অত্যন্ত মানসিক শ্রমের কাজ। বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহনে শিশুরা এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তাই সঠিক সময়ে খাদ্য গ্রহণ করলে ক্লান্তি না এসে শিক্ষা গ্রহণে তাদের উৎসাহ বেড়ে যায়। তাই একটি উন্নত ও স্বাস্থ্যকর প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য মিড ডে মিলের বিকল্প নেই।
শিশু শিক্ষক : শিশু শিক্ষক বিদ্যালয়ে শিশুদের পাঠদানের একটি আধুনিক কৌশল। আমরা জানি, শিশুরা সাধারণত কৌতুহলী কিন্তু ভীতু ও লাজুক। ফলে তারা তাদের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করতে পারে না। চুপচাপ বসে থাকে। কিন্তু আমরা যদি এই শিশুদের সাহস প্রদান, প্রানবন্ত যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সহপাঠীদের ফ্যাসিলেটর হিসেবে ব্যবহার করি তাহলে শিশুদের মধ্যে সাহস ও সাবলিলতা বৃদ্ধি পাবে। প্রান খুলে আনন্দদায়ক শিক্ষা গ্রহন করতে পারবে। আমরা জানি বিতর্ক, কুইজ ইত্যাদির মাধ্যমে শিশুদের যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি করা যায়। একটি শ্রেণিকক্ষে যত সংখ্যক শিশু থাকে সেই অনুসারে শিক্ষক নির্দিষ্ট সময়ের অধিকাংশ শিক্ষককে সমান গুরুত্ব দিতে পারে না। পাশাপাশি দুর্বল ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি ইচ্ছা বা আন্তরিকতা থাকা সত্বেও কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। তাই শিশু শিক্ষক ধারনা প্রয়োগ করে ছাত্র-ছাত্রীদের গ্রুপ তৈরি তাদের পাঠদানের প্রতিযোগিতা মূলক পরিবেশ তৈরি করলে সকল শিশু অন্যদের নিকট নিজেকে বিব্রত না করে নিজেদের গড়ে উঠতে আগ্রহী হবে। এই ব্যাপারে শিশু শিক্ষক তাদের দুর্বলতা কাটাতে এবং নিজেদের সেই যোগ্যতায় আসীন করার চিন্তা মনোজগতে প্রবেশ করলে সেই শিশু একজন যোগ্যতা সম্পন্ন ও স্মার্ট স্টুটেন্ড এ পরিনত হবে। প্রতিদিন সমাবেশে জাতীয় সংগীত, শপথ বাক্য, নীতি বাক্য ও স্বাস্থ্য শিক্ষা সম্পর্কে আলোচনার মাধ্যমে একটি শিশুর মাঝে দেশপ্রেমের সৃষ্টি হয় এবং শিশুর মধ্যে নৈতিকতা সম্পর্কে ধারনা সৃষ্টি হয়। মানবজীবনের বিকাশে, মানব সম্পদ উন্নয়নে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। একমাত্র উপযুক্ত শিক্ষাই পারে মানুষকে মানব সম্পদে পরিনত করতে পারে। তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে ইনোভেশন আইডিয়া প্রয়োগ করে ছাত্র-ছাত্রদের কাজে শিক্ষাকে আনন্দদায়ক এবং সকল সমস্যা সমাধান কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা।
প্রাথমিক শিক্ষার উন্নায়নে ভুমিকা:
শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। যে জাতি যত শিক্ষিত সেই জাতি তত সভ্য ও উন্নত। সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে তা সহজেই অনুমেয়। বর্তমান সভ্যতা সম্পূর্ণরূপে মেধা ও মননের উৎকর্ষতার উপর নির্ভর করে। তাই দেশের উন্নয়নে শিক্ষাকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করতে হবে। বর্তমান প্রজন্মকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার, প্রতিষ্টানকে দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা জানি আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। বর্তমান শিশুরাই আমাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তাই এ শিশিুদের আধুনিক সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার পরিবেশ আমাদের তৈরি করে দিতে হবে। শিক্ষাই পারে আমাদের শিশুদের মানব সম্পদে পরিনত করতে যা দেশের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে শিশুর শিক্ষা প্রধান আনুষ্টানিক প্রতিষ্ঠান। আমরা জানি জন্মের পর থেকে শিশু পরিবার ও প্রকৃতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে শিক্ষার জন্য সে বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে। তাই এই বিদ্যালয়ে শিশুর মৌলিক শিক্ষা ও সুপ্ত প্রতিভার বিকাশে সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অপরিহার্য।
পরিবারের ভূমিকা : পরিবারে শিশু শিক্ষার প্রধান ও প্রথম প্রতিষ্ঠান। শিশু জন্মের পর মা ও পরিবারের কাছ থেকে শিক্ষার প্রথম পাঠ গ্রহণ করে থাকে। তাই পরিবারের অগ্রজরা শিক্ষিত ও সচেতন হলে সেই পরিবারের শিশুরা সঠিক দিক নির্দেশনা পায়। পরিবার হতে নীতি নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ভালো ধারণা লাভ করে থাকে যা পরবর্তী জীবনে তার মেধা মননের বিকাশে সহায়তা করে। তাই পরিবারকে শিশুর শিক্ষার অগ্রনী ভূমিকা পালন করতে হবে।
বিদ্যালয়ের ভূমিকা : বিদ্যালয় হচ্ছে শিশুর শিক্ষা লাভের আনুষ্ঠানিক প্রধান কেন্দ্র। মূলত শিশুরা বিদ্যালয় হতে দেশের মানব সম্পদ পরিনত হতে শিক্ষা লাভ করে থাকে। তাই বিদ্যালয় শিশুর জন্য শিশুবান্ধব ও আকর্ষনীয় হলে তা পরবর্তী জীবনে শিক্ষা লাভের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়। বিদ্যালয় গুলোকে বর্তমান বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি ও আকর্ষনীয় শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করে পাঠদানকে শিশুর জন্য আনন্দদায়ক করে উপস্থাপন করতে হবে। শিক্ষকদের ছাত্র-ছাত্রীদের চাহিদা নিরূপন করে ও বন্ধু সুলভ ব্যবহার করে আনন্দদায়ক শিক্ষা প্রদান করতে হবে।
সমাজের ভূমিকা : প্রাথমিক বিদ্যালয় একটি সামাজিক প্রতিষ্টান। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উন্নয়নে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সমাজের দানশীল ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের পাশাপাশি সকলকে শিশুদের নিরাপদ ও আকর্ষনীয় বিদ্যালয় বিনির্মানে সহায়তা করতে হবে। বিদ্যালয়ে উন্নয়নের পাশাপাশি এ সকল শিশুদের মেধা বিকাশে খেলাধুলা মাঠ, চিত্তবিনোদনের উদ্যোগ, ব্যায়মাগার ইত্যাদি সংস্থান করতে হবে।
রাষ্ট্রের ভূমিকা : রাষ্ট্র জনগনের প্রধান আশ্রয়স্থল। রাষ্ট্রকে তার নাগরিকের কল্যাণ সাধনের সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। দেশ স্বাধীন পর পরই সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে শিক্ষাকে সকলের জন্য সার্বজনীন ও অবৈতনিক করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারই ধারাবাহিকায় ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু ৩৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করে শিক্ষকদের সামাজিক নিরাপত্তা ও সম্মান বৃদ্ধি করেন এবং তারই ধারাবাহিকতায় জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতিয়করণ করেন তৎ সংশ্লিষ্ট সকল শিক্ষককে আত্তীকরণের আওতায় আনেন। বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নের জন্য আধুনিক আকর্ষনীয় অবকাঠামো, শিক্ষা আনন্দদায়ক করতে ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, পিয়ানো, হারমোনিয়াম, তবলা, হোয়াইড বোর্ড ইত্যাদি বিতরণ করেন। বছরের শুরুতে বছরের ১ম দিনেই আকর্ষনীয় রঙ্গীন বই বিতরণ এবং ১০০% উপবৃত্তি বিতরণের মাধ্যমে শিক্ষাকে সকলের কাছে সহজ করে দিয়েছেন।
আমরা জানি, সকল শিশু অসীম সম্ভাবনা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। তাই এই সকল শিশুকে তাদের যোগ্যতা অনুসারে বিকাশের সুযোগ করা দেওয়া আমাদের সকলের নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। শিশুর সম্ভাবনা ও সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দিলে শিশুরা কালজয়ী ও মানব-সর্ম্পকে পরিনত হবে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা ও প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। তাই চলুন আমরা যার যার অবস্থান থেকে রাষ্ট্রের পাশাপাশি বিদ্যালয়ের উন্নয়নে ভূমিকা রাখি।
অটিজম সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা:
আজকের শিশু আগামী দিনের দেশের কর্ণধার। তাই সেই শিশুকে হতে হবে সুস্থ সবল প্রাণবন্ত ও মেধাবী। সুস্থ সবল শিশুই পারে সুস্থ জাতি উপহার দিতে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সকল শিশু সুস্থ সবল হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। কিছু কিছু শিশু জন্ম গ্রহণের সময় বা জন্মগ্রহণের কিছুদিন পরই বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে প্রায় ৩% শিশু সুস্থ অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে না যা একটি রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত পীড়াদায়ক। তার মধ্যে কিছু কিছু শিশু স্বাভাবিক সমস্যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে যাদের যথাসময়ে সুচিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা যায়। তাই এই ব্যাপারে পরিবার ও রাষ্ট্রের আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। পরিবারের সদস্যদের এই সকল শিশুদের সাথে মানবিক ও শ্রদ্ধাশীল আচরণ প্রদর্শন করতে হবে এবং সমস্যা কাটিয়ে তোলার জন্য মনস্তাত্ত্বিক ভাবে সহায়তা করতে হবে। তাদের মেধা বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে তারা আমাদের সন্তান এবং তাদের সুস্থভাবে বেড়ে উঠার জন্য আমাদের দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা রয়েছে। তাদের হাসিখুশি রাখা এবং যে বিষয়ে তাদের মেধা বিকাশের লক্ষণ দেখা যায় সেই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কোনক্রমেই এই সকল শিশুদের অবহেলা, অশ্রদ্ধা ও উদাসীনতা প্রদান অন্যায় আচরণ বলে বিবেচিত হবে – যা কাম্য নয়। সমস্যাগ্রস্থ এই সকল শিশুদের প্রতি আমাদের যত্নশীল হতে হবে। রাষ্ট্রকে শিশুদের পরিবার ও সমাজে সম্মানের সহিত বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। রাষ্ট্রকে এই সকল শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। অল্প খরচে এবং উন্নত প্রযুক্তির ব্যবস্থা করে চিকিৎসার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। এই সকল শিশুদের প্রতি আমাদের অমানবিক মনোভাব দূর করতে হবে।
অটিজম ঃ অটিজম কোন রোগ নয়। অটিজম স্নায়ুজনিত বিশৃঙ্খলার কারণে শিশুর একটি অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া। অটিজম আক্রান্ত অধিকাংশ শিশু মেধা বিকাশের সুযোগ রয়েছে। সেজন্য তাদের প্রতি যত্নশীল হতে হবে এবং যে বিষয়ে তার পারদর্শিতার লক্ষণ দেখা যায় সে ব্যাপারে মেধা বিকাশে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিশ্বে যারা আজ স্মরণীয় তাদের অনেকেই অটিজমে আক্রান্ত। কিন্তু পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সুদৃষ্টি থাকায় তারা আজ বিশ্ববরেণ্য। অরবার্ড আইনস্টাইন, নিউটন ও জনজন্টিরোডস তারা অটিস্টিক। কিন্তু পরিবারের সুদৃষ্টি ও তাদের পরিচর্যার কারণে তারা সেই সমস্যা থেকে মুক্ত হতে পেরেছে। তাই বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে শিশুদের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে এবং অভিভাবকদের এই ব্যাপারে সাহায্য ও সচেতনতা পরামর্শ প্রদান করতে হবে।
চোখের সমস্যা ঃ চোখের সমস্যা শিশুর সুস্বাস্থ্য জীবনের জন্য অন্যতম প্রধান বাধা। জন্মের পর বিদ্যালয়ে প্রবেশের পূর্বে প্রায় এক-চতুর্থাংশ শিশু চোখের সমস্যায় আক্রান্ত হয়। কিন্তু যথাসময়ে কার্যকরী চিকিৎসা নিলে তা সুস্থ করে তোলা যায়। এ সকল শিশুদের শৈশবে চিকিৎসা না করালে ভবিষ্যতে তা তাদের জীবনের অভিশাপ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই শিক্ষকদের ও অভিভাবকদের এই ব্যাপারে সচেতন ও সময়মত চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিশুদের ডাক্তার দ্বারা পরীক্ষা করে চশমা ব্যবহারে এই সমস্যার সমাধান করা যায়।
কানের সমস্যা ঃ অনেক শিশু কানের সমস্যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। ফলে তারা সঠিক সময়ে কথা বলতে পারে না। পরিবারের সদস্যরা এই সকল সমস্যা দেখলে বা বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ এই সমস্যা পর্যবেক্ষণ করলে দ্রুত অভিভাবককে অবহিত করে কার্যকরি চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। ফলে শিশুকে কানের সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে সুস্থ শিশু হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
ওজন ও উচ্চতা সমস্যা ঃ আমাদের দেশে অনেক শিশু জন্মের সময় কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু শিশুর এই সমস্যা শৈশবে চিহ্নিত হলে পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে এই সকল সমস্যা থেকে মুক্তি লাভ করা যায়।
কথায় জড়তা ঃ কথায় জড়তা শিশুর একটি সমস্যা। শৈশবেই কথা বলার এই সমস্যা উপলব্ধি করতে পারলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। স্পিস থেরাপিসহ অন্যান্য আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে শিশুদের এই সমস্যা সমাধান করা যায়। তাছাড়া পরিবারের সদস্যদের তাদের সহিত বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে এবং আনন্দ প্রদান করে তাদের কথা বলার সাবলীলতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করতে হবে।
অতএব শিশুরা একটি জাতির সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। তাদের মেধা বিকাশের সুযোগ করে দিয়ে মানব সম্পদে পরিণত করার মাধ্যমে দেশের সার্বিক উন্নয়ন করা সম্ভব। তাই রাষ্ট্রসহ সকলকে শিশুর কল্যাণে এগিয়ে আসতে হবে।
মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন :
শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। সুশিক্ষা একটি জাতিকে উন্নত ও আধুনিক জাতিতে পরিণত করে। আমরা জানি শিক্ষা একটি বহুমাত্রিক এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। তাই মানুষ আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক উপ-আনুষ্ঠানিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক বহু ভাবেই শিক্ষা গ্রহন করে থাকে। কিন্তু সকল মানুষ শিক্ষাকে নিজের জীবনে বিকাশের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করে না। তাই সরকারকে সংবিধানে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূরীকরণে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের বিধান এবং শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তা সবার জন্য সার্বজনীন ও অবৈতনিক করা হয়েছে। পাশাপাশি নিরক্ষরতাকে জাতির জন্য অভিশাপ মনে করে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন পাস করেছে। সকল শিশুকে বিদ্যালয়ে প্রেরণ এবং সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য সরকার বছরের শুরুতে আকর্ষণীয় বই, ১০০% উপবৃত্তি প্রদান, মনোরম ও আধুনিক বিদ্যালয় ভবন, শিশুবান্ধব শ্রেণিকক্ষ, উন্নত ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ (ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া ও প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা) চালু করেছে। শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষকদের আধুনিক প্রশিক্ষণ ও বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করে সামাজিক নিরাপত্তা ও সম্মান নিশ্চিত করেছে। বিদ্যালয়ে শিশুরা আনন্দঘন পরিবেশে বাংলা, ইংরেজি ও গণিত পড়তে, বলতে ও লিখতে পারবে। শিশুদের বয়স ও সময়ের চাহিদা নিরূপণ করে তাদের যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক হতে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত তাঁরা তাঁদের যোগ্যতা অনুসারে নিজেদের প্রকাশ করতে পারবে এবং শ্রেণীশেষে যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে পরবর্তী উচ্চ শ্রেণিতে পদার্পণ করবে। শিশুদের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে ২৯ টি প্রান্তিক যোগ্যতা এবং ১৫৬টি বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি শ্রেণীতে প্রতি বিষয়ে প্রান্তিক ও বিষয় ভিত্তিক যোগ্যতা অর্জন করলে শিশুর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় শিক্ষকদের আন্তরিকতাহীনতা, পাঠদানে অনাকর্ষণীয়তা ও সৃজনশীলতার অভাব, আকার্ষণীয় শিক্ষা উপকরণ ব্যবহারে অবহেলা শিশুদের মানসম্মত শিক্ষা অর্জনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। তবে এই ব্যাপারে শুধু শিক্ষক একা দায়ী নয়, বিদ্যালয় কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয় এবং শিশু শিক্ষা একটি জটিল প্রক্রিয়া। শিশুরা বিদ্যালয়ে থাকে মাত্র কয়েকঘন্টা অথচ অধিকাংশ সময় সে থাকে পরিবার ও সমাজে। তাই পরিবার ও সমাজকে শিশুর শিক্ষায় আরো যত্নশীল ও আন্তরিক হতে হবে। শিশুকে গৃহে আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণের অভ্যাস তৈরি করতে হবে এবং সমাজকে স্থিতিশীল পরিবেশের নিশ্চয়তা প্রদান করে শিশুদের প্রকৃতি থেকে আবারিত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ লাভের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে শিক্ষকদের ন্যায় ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক ঃ মোহাম্মদ মোতাহার  বিল্লা, উপজেলা শিক্ষা অফিসার, মৌলভীবাজার সদর। মোহাম্মদ

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com