ফুরফুরা সিলসিলার উজ্জ্বল নক্ষত্র : পীরে কামিল শাহ্ সুফি মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন বিশকুটি (রহ.)

February 6, 2025,

বশির আহমদ :  বাংলাদেশের ইসলামী ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন পীরে কামিল শাহ সুফি মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন বিশকুটি (রহ.)। তিনি ছিলেন এক মহান আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব, যিনি ইসলাম প্রচারে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর পিতা শাহ সুফি মশহুদ (রহ.) এবং দাদা বিশ্বনন্দিত বুজুর্গ পীরে কামিল আল্লামা আব্দুল্লাহ ভাদেশ্বরী (রহ.), যাঁরা ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন।

বিশকুটি ছাহেব (রহ.) জন্মসূত্রে চৌধুরী বংশের মানুষ ছিলেন, কিন্তু বিনয়ী স্বভাবের কারণে কখনো নামের সঙ্গে “চৌধুরী” উপাধি ব্যবহার করেননি। বরং, যদি কেউ তাঁর নামের সাথে চৌধুরী লিখত, তবে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বাধা দিতেন। তাঁর বিনয় ও আত্মসমর্পণের প্রতীক হিসেবে তিনি বরং নিজের নামের সঙ্গে “মিন ফকীর” লিখতে পছন্দ করতেন, যা তাঁর প্রকৃত সুফি-চরিত্রের প্রকাশ।

বিশকুটি ছাহেব (রহ.) শুধু নিজ এলাকায় নয়, বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামের দাওয়াত ও খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। তিনি প্রায় ৫৪টি দেশ সফর করেছেন এবং বহুবার হজ ও উমরাহ পালন করেছেন। তাঁর সফর শুধু আত্মশুদ্ধি বা ইবাদতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং যেখানে গেছেন, সেখানেই ইসলামের সঠিক শিক্ষা প্রচার করেছেন। তাঁর দাওয়াতি কার্যক্রমের ফলে অসংখ্য মানুষ সঠিক পথের দিশা পেয়েছে এবং ইসলামের প্রতি আগ্রহী হয়েছে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামের খেদমতে তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম। বিশেষ করে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেটসহ দেশের নানা স্থানে তিনি মাদরাসা, মসজিদ, মক্তব ও খানকার প্রচার-প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি শুধু নিজ হাতে বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেননি, বরং অসংখ্য দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ও পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো হিংগাজিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা, হিংগাজিয়া শাহী জামে মসজিদ, বাবনিয়া হাশিমপুর নিজামিয়া আলিম মাদরাসা ও জামে মসজিদ, জালালিয়া দাখিল মাদ্রাসা, গুপ্তগ্রাম দাখিল মাদরাসা ও এতিমখানা, লাংলা খাশ জামে মসজিদ এবং মৌলভীবাজার ইসলাম মিশন ও দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র। এছাড়াও, তিনি নেত্রকোনা জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে মসজিদ-মাদরাসার উন্নয়নে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেছেন।

বিশকুটি ছাহেব (রহ.) ছিলেন প্রকৃত সুফি, যাঁর ব্যক্তিত্ব ও আচার-আচরণ মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলত। তাঁর কাছে মানুষ দ্বীনি শিক্ষা ও ইসলামের সঠিক দিশা নিতে আসত। তিনি ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে মুসলমানদের ইসলামের মৌলিক শিক্ষা প্রদান করতেন। মানুষ যখন তাঁর কাছে মসজিদ-মাদরাসার জন্য সাহায্য চাইত, তখন তিনি যথাসাধ্য সহযোগিতা করতেন এবং প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা দিতেন। এমনকি তিনি পরবর্তীতে অর্থ পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিলে তা যথাযথভাবে পালন করতেন, যা সাধারণ পীর-মাশায়েখদের মধ্যে খুব কম দেখা যায়।

তিনি ছিলেন একজন খাঁটি আল্লাহওয়ালা, যার জীবনে অহংকারের লেশমাত্র ছিল না। তাঁর বিনয়, পরোপকারিতা এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ তাঁকে গভীর শ্রদ্ধার চোখে দেখত। তাঁর ব্যক্তিত্বের অন্যতম দিক ছিল তিনি সবসময় সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থাকতেন এবং মানুষের কষ্ট দূর করতে প্রাণপণ চেষ্টা করতেন।

বিশকুটি ছাহেব (রহ.)-এর সাথে উপমহাদেশের বিখ্যাত আধ্যাত্মিক সাধক হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলা (রহ.)-এর গভীর আত্মার বন্ধন ছিল। তিনি ফুলতলী ছাহেব কিবলাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন এবং তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দ্বীনি সম্পর্ক ছিল গভীর ও নিবিড়। উভয়ে ইসলামের প্রচারে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন এবং পরস্পরের প্রতি গভীর সম্মান প্রদর্শন করতেন।

তাঁর দানশীলতা, উদারতা এবং সহযোগিতার মনোভাবের কারণে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিল। ধনী-গরিব, হিন্দু-মুসলিম, শিক্ষিত-অশিক্ষিতÍসবাই তাঁর সান্নিধ্য লাভে ধন্য হতো। তাঁর দরবার সর্বদা সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। মানুষের দুঃখ-কষ্টে তিনি সবসময় পাশে দাঁড়াতেন এবং যেকোনো প্রয়োজনে সহায়তা করতেন। বিশেষ করে মেহমানদারিতে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তাঁর বাড়িতে সবসময় মেহমানদের সমাগম থাকত, এবং তিনি নিজ হাতে তাদের আপ্যায়ন করতেন।

তিনি ছিলেন একজন খাঁটি ইবাদতগুজার ব্যক্তি। নামাজ ও অন্যান্য ইবাদত তিনি অত্যন্ত ধীরস্থির ও মনোযোগের সঙ্গে পালন করতেন। তাঁর পরিচ্ছন্নতা, পরিপাটি জীবনযাপন এবং শৃঙ্খলিত রুটিন ছিল অতুলনীয়। তিনি ব্যক্তিগত জীবনেও ছিলেন অত্যন্ত মার্জিত, ধৈর্যশীল এবং সদালাপী।

তাঁর আর্থিক সহযোগিতায় অনেক ছাত্র লেখাপড়া করে বড় বড় আলেম হয়েছেন। হিংগাজিয়া এলাকাসহ কুলাউড়া অঞ্চলে তাঁর দাওয়াতি কার্যক্রমের মাধ্যমে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর দোয়া, সহযোগিতা ও মেহনতের বদৌলতে অসংখ্য মানুষ সঠিক পথের সন্ধান পেয়েছে।

আজও তাঁর স্মৃতি, শিক্ষা ও আদর্শ অনুসরণ করে তাঁর খোলাফাও  উত্তরসূরিরা দ্বীনের খেদমতে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। তাঁর সুযোগ্য নাতি হাফিজ মাওলানা ক্বারী আব্দুল্লাহ নিজাম মাজেদ  সেই সিলসিলার কার্যক্রম  অব্যাহত রেখেছেন এবং দ্বীনের খেদমত চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা আশা করি, বিশকুটি ছাহেব (রহ.)-এর রেখে যাওয়া এই সিলসিলা কেয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে এবং তাঁর দ্বীনি খেদমতের আলো সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে ইনশাআল্লাহ।

আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসে উচ্চ মাকাম দান করুন, আমিন।

লিখক পরিচিতি : অধ্যক্ষ, উলুয়াইল ইসলামিয়া আলিম মাদরাসা। সংগঠক,সমাজকর্মী

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com