বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অব্যক্ত কিছু কথা
সুজিতা সিন্হা ॥ যার বদৌলতে আমরা একটি স্বাধীন ভূখন্ড, একটি জাতীয় পতাকা ও একটি জাতীয় সঙ্গীত পেয়েছি তিনি আর কেউ নন-মহান স্বাধীনতার মহানায়ক, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি মিশে গিয়েছিলেন এই বাংলার জল-হাওয়া মাটির সাথে। তার শরীর থেকে বের হতো বাংলার সোঁদা মাটির গন্ধ। তাই বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক হয়ে গেছে আমাদের কাছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট এদেশীয় কতিপয় দানবের হাতে এই মহানায়কের জীবনাবসান হয়। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে। কিন্তু দানবেরা হয়তো ভাবতে পারেনি শারীরিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেললেও তিনি অমর রয়ে যাবেন এদেশের প্রতিটি দেশ প্রেমিক মানুষের হৃদয়ে।
আমার বাবা যাদব সিংহ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অন্ধভক্ত। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুপরবর্তী ঘটনাসমুহ বাবার হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। আততায়ীর হাতে বঙ্গন্ধুর খবর রেডিওতে যেদিন প্রচারিত হয় সেদিন ভোরে বাবার কান্নার আওয়াজ শুনে আমার ঘুম ভেঙে যায়। কান্নার কারণটা আমি খুঁজে পাইনি। সকালে উঠোনে ধান ঝাঁড়াই করার সময়েও দেখতে পাই বাবা বারান্দার এক কোণে বসে কাঁদছেন। আমি মাকে বাবার কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে মা জানান, তোমার বাবার এক বন্ধু মারা গেছেন। তাই তিনি কাঁদছেন। আমি মাকে জিজ্ঞেস করলামÑ তার নাম কী, তিনি কোথায় থাকেন? মা বললেনÑ তার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তিনি ঢাকায় থাকেন। বাবার কান্না আমাকে হতবিহ্বল করে তোলে। আমি দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ি। আমি বাবার ন্যাওটা ছায়ার মতো লেপে থাকতাম। প্রতিদিন তামাক সাজিয়ে দেওয়া, কোদাল নিয়ে চা-নাস্তা নিয়ে মাঠে যাওয়া সবই আমি করতাম। সে জন্য বাবার এই কান্না আমাকে খুবই ব্যথিত করেছিল। বাবা বললেনÑ কিছুই হয়নিÑ কেঁদো না। যাও পড়তে বসো। কিছুক্ষণ পর বাবা কাজ ফেলে রেখে মোহাম্মদ আলী সাহেবের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর বিস্তারিত জানতে। মোহাম্মদ আলী ছিলেন ৬নং আলীনগর ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান এবং থানা আওয়ামীলীগের সভাপতি। বাবা সেই যে সকালে বেড়িয়ে গিয়েছিলেন ফিরলেন রাতে। মা সারাদিন উৎকন্ঠা-উদ্বেগ নিয়ে বসেছিলেন বাবার পথ চেয়ে। সেদিন আমাদের বাড়িতে দুপুরে হাঁড়ি চড়েনি। আমাদের ক্ষিধে লেগেছে চিন্তা করে মা বললেন-হাঁড়িতে কিছূ পান্তা ভাত রয়েছে। যাও লবন মরিচ মেখে কিছু খেয়ে নাও। তোমার বাবা এলে তাড়াতাড়ি রান্না কনে খেতে দেব। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন মারা গেলে যেভাবে বিষাদের ছায়া নেমে আসে সেভাবে আমাদের বাড়িতে সেদিন মৃত্যুর নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল। মা রাতে রান্না শেষ করে বাবাকে খেতে ডাকলেন। কিন্তু বাবা ভাত খেলেন না। মা অনেক জোরাজুরি করেও বাবাকে খাওয়াতে পারেননি। আমার মার পতিভক্তি প্রবল ছিল। বাবা খাওয়ার আগে তিনি কখনো খেতেন না। সেদিন পুরোটা সময় যেন বাবা একটা খোরের মধ্যে ছিলেন। অনেক কাছের স্বজন মারা গেছেন কিন্তু কারো জন্য এতো শোক প্রকাশ করতে দেখিনি। বাবাকে আমি এখন অনুভব করি-বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাবার কত ভক্তি ও শ্রদ্ধা ছিল। বাবা প্রচলিত অর্থে সুশিক্ষিত ছিলেন না, কিন্তু দেশপ্রেম ও জাতীয়বাদী চেতনা তার মনে সুসংহত ছিল। বাবা বঙ্গবন্ধুকে সশরীরে দেখেননি, না দেখেই তার সুকৃতির কাছে মাথা নত করে মনপ্রাণ সপে দিয়েছিলেন। আমার বাবা চলে গেছেন অনেকদিন হলো। বঙ্গবন্ধুর প্রয়াণ দিবস এলেই সেই স্মৃতিগুলো মনের ক্যানভাসে বারবার উকি দেয়। কোন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ এসে গেলে বাবার এই অনুভূতিগুলো মনে হলে কান্না চেপে রাখতে পারি না । সেই স্মৃতিগুলোকে ছাপার অক্ষরে ধরে রেখে চিরজাগরূক করে রাখার জন্য এই লেখার তাড়না অনুভব করেছি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আমার জনক যাদব সিংহ-দু’জনের প্রতি সহ¯্র প্রণতি জানাই।
রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময় বাবা দেয়ালের দিকে মুখ করে স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে বলেছিলেন-‘আজ তোমাকে যারা হত্যা করল তারা কোনদিন সুখে থাকতে পারবে না। আরো করুণভাবে তাদের মৃত্যু হবে। ভগবান অবশ্যই এর বিচার করবেন।’
সুজিতা সিনহা, প্রধান শিক্ষক, গোবর্ধ্বনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার।
মন্তব্য করুন