বন্ধু দিবস: ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
এহসান বিন মুজাহির :
আজ বিশ্ব বন্ধু দিবস। প্রতি বছর আগস্ট মাসের প্রথম রবিবার বিশ্বজুড়ে বন্ধু দিবস উদযাপিত হয়। ১৯৩৫ সাল থেকে বন্ধু দিবস পালনের প্রথা শুরু হয়। জানা যায় ১৯৩৫ সালে আমেরিকার সরকার এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। দিনটি ছিল আগস্টের প্রথম শনিবার। তার প্রতিবাদে পরের দিন ওই ব্যক্তির এক বন্ধু আত্মহত্যা করেন। এরপরই জীবনের নানা ক্ষেত্রে বন্ধুদের অবদান আরতাদের প্রতি সম্মান জানানোর লক্ষেই আমেরিকান কংগ্রেসে ১৯৩৫ সালে আগস্টের প্রথম রবিবারকে বন্ধু দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেন। এর পর থেকে দেশে-বিদেশে এদিবসটি পালিত হয়ে আসছে। বক্ষমান নিবন্ধে বন্ধু নির্বাচনে কী বলে ইসলাম এবিষয়ে কিছু আলোকপাতের করবো। সমাজে বসবাস করতে হলে বন্ধুর প্রয়োজন আছে। পারস্পরিক সম্পর্ক, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির মায়াজাল মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বের আবহ সৃষ্টি করে। খাঁটি অলংকারের চেয়ে খাঁটি বন্ধুর মূল্য অনেক বেশি। কারণ অলংকারের বাস শরীরে, মনের মধ্যে নয়। কিন্তু একজন ভালো বন্ধু বাস করে মনের মধ্যে, চেতনার গহীনে। বন্ধু তো বানাতে হবে তাই বলে তো যাকে তাকে বন্ধু বানানো যায় না। কারণ, জীবনে বন্ধুর প্রভাব পড়ে। একজন ভাল বন্ধু একজন খারাপ মানুষকে ভাল বানাতে সাহায্য করতে পারে পক্ষান্তরে খারাপ বন্ধু একজন ভাল মানুষকে নিয়ে যেতে পারে অধ:পতনের অতল তলে। বন্ধুত তৈরীর আগে অবশ্যই যাচাই-বাছাই করা আবশ্যক। মানবজীবনে আদর্শ বন্ধু নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ইসলামে বন্ধু নির্বাচনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এবিষয়ে পবিত্র কুরআনে বহু আয়াত ও হাদিসে বহু বাণী উল্লেখ করা হয়েছে। বন্ধু নির্বাচন বিষয়ে সুরা আলে ইমরানের ২৮ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন-‘মুমিনগণ যেন অন্য মুমিনকে ছেড়ে কোনো কাফিরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। আর যারা এরূপ করবে, আল্লাহর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক থাকবে না’।
আল্লাহপাক আরও এরশাদ করেন-‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও’।'(সুরা তাওবা:১১৯)
আল্লাহ আরও বলেন-হে মুমিনগণ! তোমরা ইয়াহুদী ও নাসাদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা পরস্পরে বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভূক্ত হবে। আল্লাহ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না (সূরা মায়িদাহ ৫১)
হজরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন-‘ভালো এবং দুষ্ট বন্ধু মিশক (সুগন্ধি) বহনকারী ও হাঁপরে ফুঁকদাতা (কামার) ব্যক্তির মতো। মিশক বহনকারী ব্যক্তির অবস্থা তো এমন যে সে হয়তো এ মিশক্ তোমাকে উপহার দেবে অথবা তুমি তার থেকে তা খরিদ করবে অথবা তুমি তার থেকে এর সুঘ্রাণ লাভ করবে। আর হাপরে ফুঁকদাতা ব্যক্তি হয়তো সে তোমার কাপড় জ্বালিয়ে দেবে কিংবা তুমি তার কাছ থেকে দুর্গন্ধ পাবে।’ (বুখারি )
হজরত রাসুলুল্লাহ (স) এরশাদ করেন-‘মুমিন ব্যতিত অন্য কাউকে সঙ্গী বানাবে না’। (তিরমিজি)
হজরত রাসুলুল্লঅহ (সা.) বলেছেন-‘অসৎ সঙ্গীর চেয়ে একাকিত্ব ভালো। আর একাকিত্বের চেয়ে সৎ সঙ্গী ভালো’। (বুখারি)
হজরত আবু হুরাইরা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘এক ব্যক্তি নিজ গ্রামের বাইরে অন্য গ্রামে তার ভাইর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, ফলে তার রাস্তায় আল্লাহ তায়ালা এক ফেরেশতাকে পাহারাদার হিসাবে নির্ধারণ করেন, অতপর যখন সে তার নিকটে পৌঁছে, তখন ফেরেশতাগণ বলে, কোথায যাচ্ছ? সে উত্তরে বলে, এই গ্রামে এক ভাইয়ের কাছে যাচ্ছি। ফেরেশতা বলে, ওর প্রতি তোমার কোনো অনুগ্রহ আছে কি, যা তুমি সম্পাদন করতে যাচ্ছ? সে বলে, না, কিন্তু আমি তাকে আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবাসি। ফেরেশতা বলে, আমি তোমার নিকট আল্লাহর দূত, আল্লাহ তোমাকে ভালবেসেছেন, যেমন তুমি তাকে আল্লাহর ওয়াস্তে ভালসেছো।’ (মুসলিম)
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন-মানুষ তার বন্ধুর ধর্ম (স্বভাব-চরিত্র) দ্বারা প্রভাবিত। সুতরাং সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে তা যেন অবশ্যই যাচাই করে নেয়’। (তিরমিজি)
হজরত আলী (রা.) বলেন- যে ব্যক্তি চিন্তা-ভাবনা করে যথাযথ বিচার-বিশ্লেষণ করে বন্ধু নির্বাচন করবে, তাদের বন্ধুত্ব বজায় থাকবে এবং তাদের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর হবে।
হজরত ইমাম গাজালি (রাহ.) বলেন তিনটি গুণ যার আছে তাকে বন্ধ বানাতে হবে। গুণগুলো হলো: এক. বন্ধুকে হতে হবে জ্ঞানী, বিচক্ষণ। দুই. বন্ধুর চরিত্র হতে হবে সুন্দর ও মাধুর্যময়। তিন. বন্ধুকে হতে হবে নেককার, পূণ্যবান। অথ্যাৎ- ‘বুদ্ধিমত্তা ও সৎ স্বভাবের অধিকারী হওয়া এবং পাপাচারী, বেদআতি ও দুনিয়াসক্ত না হওয়া।
হজরত ইমাম জাফর সাদিক (রা.) বলেন- পাঁচ ব্যক্তিকে বন্ধু বানানো যাবে না। এক. মিথ্যাবাদি। দুই. নির্বোধ। তিন. কৃপণ। চার. কাপুরুষ। পাঁচ. ফাসেক ব্যক্তি।
পরিশেষে বলা যায় বন্ধু নির্বাচন মানজীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বন্ধুত্বর প্রথম ধাপ হচ্ছে বন্ধু চয়ন। কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করার পূর্বে আমাদের তার সম্পর্কে জানা উচিৎ, যে আমরা কার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে চলেছি। যদি কেউ এই ধাপেই ভুল করে বসে, তাহলে তার পরিণাম ভয়যঙ্কর হতে পারে। মনে রাখতে হবে ‘সৎ সঙ্গে সর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’। সৎ সঙ্গ সৎ বানায় আর অসৎ সঙ্গ অসৎ করে তোলে। তাই বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনাগুলো সামনে রেখে বন্ধং নির্বাচন করবো। আল্লাহ আমাদের আমলের তািেফক দান করুন।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
মন্তব্য করুন