বন্যায় মৌলভীবাজারে ২০ ইউনিয়ন প্লাবিত, পানিবন্দি লক্ষাধিক মানুষ

June 19, 2024,

মছব্বির আলী/মাহফুজ শাকিল॥ গত কয়েকদিনের ভারী বর্ষণে, উজানের পাহাড়ি ঢল ও নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় হঠাৎ করে মৌলভীবাজার জেলার ৫ উপজেলার প্রায় ২০টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এতে ওই পাঁচ উপজেলার প্রায় কয়েক শতাধিক গ্রামের লোক পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এছাড়া জেলার সাতটি উপজেলারই নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তন্মধ্যে বড়লেখা উপজেলার ৪টি, জুড়ি উপজেলার ৩টি, কুলাউড়া উপজেলার ৩টি, সদর উপজেলার ৪টি এবং রাজনগর উপজেলার ২টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়। পানিবন্দি মানুষের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে খোলা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রে। এছাড়া পশু কোরবানি দিতে গিয়েও চরম বিড়ম্বনায় পড়েন মানুষ। বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করায় আশ্রয়কেন্দ্রে ছুঁটছে বন্যা কবলিত এলাকার লোকজন। বন্যা আতঙ্কে নির্মুঘ রাত পার করছেন হাজার হাজার মানুষ।

জানা যায়, ঈদুল আযহার দিন ভোর থেকেই জেলার বিভিন্ন উপজেলায় টানা বৃষ্টিপাত হয়। এতে করে নিম্নাঞ্চলের রাস্তা ঘাট প্লাবিত হলে ঈদের দিনে টানা বৃষ্টিপাত ও বন্যার কারণে মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছেন। অনেক ঈদগাহে পানি উঠে যাওয়ায় ঈদের নামাজ হয় উচুঁ স্থান ও মসজিদে। এতে করে জেলার প্রায় সাতটি উপজেলার প্রায় ২০টি ইউনিয়নের ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন।

সোমবার রাতে প্লাবিত হয়ে যায় কুলাউড়া উপজেলা পরিষদ এলাকা ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। মঙ্গলবার সারাদিন বৃষ্টি হওয়ার পর পৌর শহরের মাগুরা, সাদেকপুর, বিহালা, সোনাপুর, কাদিপুর ইউনিয়নের ছকাপন, মৈন্তাম, ভাগমতপুর, গুপ্তগ্রাম, তিলকপুর, ভূকশিমইল ইউনিয়নের সাদিপুর, কুরবানপুর, মুক্তাজিপুর, জাবদা, কালেশার, কাইরচক, চিলারকান্দি, কানেহাত, জয়চন্ডী ইউনিয়নের ঘাঘটিয়া, মিরবক্সপুর, কামারকান্দি, কুঠাগাঁও, কুলাউড়া সদর ইউনিয়নের দেখিয়ারপুর, কুলাউড়া গ্রাম, বনগাঁও, গাজিপুর আংশিক, পুরন্দপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ইউনিয়নে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও প্লাবিত হয়।

এদিকে পানিবন্দি মানুষদের খোঁজখবর নিতে হাকালুকি হাওর তীরবর্তী ভূকশিমইল ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন মৌলভীবাজার-২ কুলাউড়া আসনের সংসদ সদস্য শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল। এদিকে জুড়ী উপজেলার জায়ফরনগর ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ড ও পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নের ২টি ওয়ার্ড প্লাবিত হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষের মাঝে রান্না করা খাবার ও শুকনো খাবার বিতরণ করেন জুড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কিশোর রায় চৌধুরী মনি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুসিকান্ত হাজং।

শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, সোমবার সকালে মাত্র ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। মঙ্গলবার আজ বেড়ে গিয়ে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত ১২৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আগামী ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টায় এই অঞ্চলে ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) মৌলভীবাজার সূত্রে জানা গেছে, সোমবার বিকেলে মৌলভীবাজারের কুশিয়ারা নদীর শেরপুর পয়েন্টে পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই হয়ে প্রবাহিত হয়েছে। যার কারণে ওই এলাকার কিছু জায়গা প্লাবিত হয়েছে। কয়েকটি ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।

জেলা প্রশাসনসূত্রে জানা যায়, জেলার বড়লেখা উপজেলার ৪টি, জুড়ি উপজেলার ৩টি, কুলাউড়া উপজেলার ৩টি, সদর উপজেলার ৪টি এবং রাজনগর উপজেলার ২টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়। পানি বৃদ্ধির ফলে বন্যাক্রান্ত উপজেলাসমূহে সকল ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে জুড়ি, বড়লেখা এবং কুলাউড়া উপজেলায় বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ভুক্তভোগী মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।

কুলাউড়ার রাবেয়া আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা কাদিপুর ইউনিয়নের মৈন্তাম গ্রামের আক্কাস আলী (৪৫) বলেন, পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আমার ঘরের ভেতর হাঁটুপানি। একটু পানি বাড়লেই বিছানায় পানি উঠবে। তাই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঈদের দিন বিকেলে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছি। কখনো কল্পনাও করিনি এইভাবে নিজের বাড়ি ছাড়া হয়ে ঈদ করবো। এখানে কুলাউড়া ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারন সম্পাদক এম আতিকুর রহমান আখইকে শুকনো খাবার করতে দেখা দেখা গেছে।

ভূকশিমইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির বলেন, হাকালুকি হাওরের পানি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় আমার ইউনিয়নের ২২টি গ্রামই প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি মানুষের জন্য ইউনিয়নের বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৭০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। শহরের সাথে প্রধান সড়কের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথে। প্রশাসনের নির্দেশনা পেয়ে সরকারের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার বিতরণ করছি।

কাদিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাফর আহমদ গিলমান বলেন, পানি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় আমার ইউনিয়নের ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি মানুষের জন্য ইউনিয়নের বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ৬টি আশ্রয়কেন্দ্র মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় ৪০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।

কুলাউড়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ শিমুল আলী বলেন, কুলাউড়ায় এখন পর্যন্ত ১৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে খোলা হয়েছে। মঙ্গলবার রাত ৯টা পর্যন্ত বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ১২৭টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।

জুড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুসিকান্ত হাজং বলেন, জুড়ী উপজেলায় ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে দুটি ইউনিয়ন বেশি প্লাবিত হয়েছে। ওই দুই ইউনিয়নের পানিবন্দি ৬৫টি গ্রামের ১৬০টি পরিবার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে রান্না করা খাবার খিঁচুড়ি ও পরিষদের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।

রাজনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুপ্রভাত চাকমা বলেন, রাজনগরে ২৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে এখন পর্যন্ত ১৩০টি পরিবার উঠেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

মৌলভীবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাসরিন চৌধুরী বলেন, সদর উপজেলার ৪টি ইউনিয়ন প্লাবিত হলেও অস্থায়ীভাবে উপজেলার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেনি মানুষ।

জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম বলেন, বন্যাকবলিত উপজেলার ইউএনওদের সার্বক্ষণিক বন্যা পরিস্থিতি মনিটরিং এবং কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছি এবং আশ্রয়কেন্দ্র সমূহে প্রয়োজনীয় ঔষধসহ খাবার ও পানীর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। আরও বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস থাকায় আমরা সব ধরণের প্রস্তুতি নিয়েছি। জেলার প্রতিটি উপজেলার ইউএনওদের নিয়ে কমিটি করা হয়েছে। সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হচ্ছে।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com