বন্যার্ত মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসার এখনই সময়
এহসান বিন মুজাহির॥ করোনাভাইরাস মহামারি পরিস্থিতির মধ্যে বন্যায় বিপর্যস্ত বিভিন্ন জনপদ। দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর পূর্বের বিভিন্ন জেলায় ভয়াবহ বন্যার কারণে এসব এলাকার বেশিরভাগ বাড়ি-ঘর, রাস্তাা-ঘাট, ফসল, মাছ ও স্থাপনা অথৈ পানিতে তলিয়ে গেছে। অসংখ্য মানুষ বাড়ি-ঘর ছেড়ে অন্যত্র উঁচু অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকের কোমর সমান পানি পাড়িয়ে শিশু কিংবা পশু ঘাড়ে নিয়ে যাওয়ার কিংবা ঘরের চালে আশ্রয় নিয়েছেন। এ অবস্থায় বন্যাকবলিত অঞ্চলের অসহায় বানভাসি মানুষ কতটা দুঃখ-কষ্টের মধ্যে পড়েছেন তা সহজেই অনুমেয়। বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতির কারণে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এসব এলাকার ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত বানভাসি মানুষ অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় ও চিকিৎসার অভাবে অর্ধাহারে-অনাহারে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে দিন যাপন করছেন। বন্যাদুর্গত অঞ্চলে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের অভাবে তারা সুচিকিৎসা পাচ্ছে না। দেশের প্রধান নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় প্রবল স্রোতে পানির সংযোগ পাইপ, গভীর নলকূপ ও কুয়া চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সর্বত্র বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। চাল, ডাল, আটা, সবজি, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। অনেক এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে সাপসহ বিষাক্ত প্রাণির উপদ্রব। বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট বাড়ছে। বন্যাদুর্গত বিভিন্ন এলাকায় পানিবাহিত নানা ধরনের রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে। সবকিছু মিলিয়ে হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য।
জাতিসংঘের অফিস ফর দ্য কো-অর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্সের (ওসিএইচ) তথ্যমতে-বন্যায় এখন পর্যন্ত দেশের ১৮টি জেলার ২৪ লাখেরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ঘরবাড়ি ছেড়ে সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে অন্তত ৫৬ হাজার মানুষ। দেশে বন্যার প্রভাবে এ পর্যন্ত অন্তত ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ বাড়িঘর। ১৯৮৮ সালের পর বাংলাদেশে এবারের বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদি রূপ লাভ করতে পারে। এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছে সরকারি সংস্থা বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডব্লিউসি)।
বন্যা পরিস্থিতির অবনতির কারণে অসহায় মানুষ যখন পানিবন্দী অবস্থায় জীবন যাপন করছেন, তখন সমাজের বিত্তবানদের বন্যার্ত মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসা মানবিক দায়িত্ব। বানভাসি মানুষের কষ্ট লাঘবে টাকাপয়সা, খাদ্য, বস্ত্র, পানি, ওষুধসহ যার যা কিছু আছে তা নিয়েই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্যাদুর্গতদের সাহায্যে এগিয়ে আসার এখনই সময়।
অসহায়-বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়ানোও অনেক সওয়াবের কাজ। এটা অন্যতম একটি ইবাদতও বটে। পবিত্র কুরআন কারিমে এরশাদ হয়েছে-‘তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি তথা তার আহবানে সাড়া দিয়ে দরিদ্র, এতিম ও বন্দিদের খাদ্য দান করে’। (সূরা দাহর : ৮)। আল্লাহ আরও এরশাদ করেন-‘তাদের (বিত্তশালী) ধনসম্পদে অভাবগ্রস্তও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে। (সূরা জারিয়াত : ১৯)। হজরত রাসূলুল্লাহ(সা.) এরশাদ করেন-যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ দূর করবে, আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ দূর করে দেবেন। (বোখারি : ২৪৪২)। হজরত রাসূল (সা.) বলেছেন-‘বান্দা যতক্ষণ তার ভাইকে সাহায্য করে, আল্লাহ ততোক্ষণ বান্দাকে সাহায্য করে থাকেন’। (মুসলিম : ২৩১৪)। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন-‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুনিয়াতে মানুষকে খাদ্য দান করেছে, কেয়ামতের দিন তাকে খাদ্য দান করা হবে। যে আল্লাহকে খুশি করার জন্য মানুষকে পানি পান করিয়েছে, তাকে কেয়ামতের দিন পানি পান করানো হবে’। (আবু দাউদ : ১৩৪৬)। হজরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন-‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন,যে তার বান্দাদের প্রতি দয়া করে’। (বোখারি : ১৭৩২)। রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন-‘অসুস্থ লোকের সেবা করো, ক্ষুধার্তকে অন্ন দাও এবং বন্দিকে মুক্ত করো। (বোখারি : ৫৬৪৯)। হজরত রাসূল (সা.) আরো বলেন-যে ব্যক্তি দুনিয়াতে অপরের একটি প্রয়োজন মিটিয়ে দেবে, পরকালে আল্লাহ তার ১০০ প্রয়োজন পূরণ করে দেবেন এবং বান্দার দুঃখ-দুর্দশায় কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ালে আল্লাহ তার প্রতি করুণার দৃষ্টি দেন’। (মুসলিম : ২৫৬৬)।
হজরত নোমান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন-‘সব মোমিন একই ব্যক্তি সত্তার মতো। যখন তার চোখে যন্ত্রণা হয়, তখন তার গোটা শরীরই তা অনুভব করে। যদি তার মাথাব্যথা হয়, তাতে তার গোটা শরীরই বিচলিত হয়ে পড়ে’। (মুসলিম : ২৫৮৬)। হজরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) এরশাদ করেন-কেয়ামত দিবসে নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা বলবেন, হে আদম সন্তান, আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমার সেবা করোনি, বান্দা বলবে হে আমার প্রতিপালক। আপনিতো বিশ্বপালনকর্তা কিভাবে আমি আপনার সেবা করব? তিনি বলবেন তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, অথচ তাকে তুমি দেখতে যাও নি। তুমি কি জান না, যদি তুমি তার সেবা করতে তবে তুমি তার কাছেই আমাকে পেতে, হে আদম সন্তান, আমি তোমার কাছে আহার চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি আমাকে আহার করাও নি। বান্দা বলবে হে আমার রব, তুমি হলে বিশ্ব পালনকর্তা, তোমাকে আমি কীভাবে আহার করাব? তিনি বলবেন, তুমি কি জান না যে, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাদ্য চেয়েছিল কিন্তু তাকে তুমি খাদ্য দাও নি। তুমি কি জান না যে, তুমি যদি তাকে আহার করাতে আজ তা প্রাপ্ত হতে হে আদম সন্তান তোমার কাছে আমি পানীয় চেয়েছিলাম, অথচ তুমি আমাকে পানীয় দাও নি। বান্দা বলবে, হে আমার প্রভু তুমি তো রাব্বুল আলামীন তোমাকে আমি কীভাবে পান করাব? তিনি বলবেন তোমার কাছে আমার অমুক বান্দা পানি চেয়েছিল কিন্তু তাকে তুমি পান করাও নি। তাকে যদি পান করাতে তবে নিশ্চয় আজ তা প্রাপ্ত হতে। (মুসলিম : ৬৭২১)। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও এরশাদ করেন, মোমিনরা পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে এক দেহের মতো। দেহের কোনো অঙ্গ আঘাতপ্রাপ্ত হলে পুরো দেহ সে ব্যথা অনুভব করে’। (বোখারি : ৬০১১)। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুহূর্তে অসহায় মানুষেল পাশে দাঁড়ানো দলমত-নির্বিশেষে সব শ্রেণি পেশার মানুষের নৈতিক দায়িত্ব।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও শিক্ষক
মন্তব্য করুন