বন্যার্ত মানুষের পাশে শ্রীমঙ্গলের বরুণা মাদরাসা
এহসান বিন মুজাহির : টানা বৃষ্টি ও ভারতের উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে ভয়াবহ বন্যায় মৌলভীবাজার জেলায় পানিবন্দি তিন লক্ষাধিক মানুষ। চলমান বন্যা পরিস্থিতিতে বসে নেই মৌলভীবাজারের আলেম সমাজ। জেলায় বন্যার্ত পরিবারের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বরুণা মাদরাসা ও টিম আল খলীল।
পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার, ত্রাণ সহায়তাসহ নানা উদ্যোগ নিয়ে বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে শ্রীমঙ্গলের ঐতিহ্যবাহী বরুণা মাদরাসা ও আল খলীল এডু্েকশন এন্ড কালচারাল সেন্টার। বন্যার প্রথম দিন থেকে পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার, শুকনো খাবার, রান্না খাবার, জরুরি ওষুধসহ নানা তৎপরতা অদ্যাবধি অব্যাহত রেখেছে বরুণা মাদরাসা ও টিম আল খলীল।
জানা যায়, সিলেট বিভাগের বরেণ্য বুজুর্গ, শায়খুল আরব ওয়াল আজম মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানি (রহ.) এর খলিফা,মুজাদ্দিদে যামান আল্লামা শায়খ লুৎফুর রহমান বর্ণভী (রহ.) প্রতিষ্ঠিত ও ফেদায়ে ইসলাম শায়খুল হাদিস আল্লামা শায়খ খলীলুর রহমান হামিদি (রহ.) এর স্মৃতিবিজড়িত মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের বহুমুখী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া লুৎফিয়া আনোয়ারুল উলুম হামিদনগর বরুণা টাইটেল মাদরাসাটি ১৯৪১ সালে যাত্রা শুরু করে।
মাদরাসাটি শুরুলগ্ন থেকে দ্বীনি শিক্ষার প্রচার-প্রসারের পাশাপাশি ‘আর্তমানবতার কল্যাণে’ অরাজনৈতিক সংগঠন আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করে বহুমুখী কার্যক্রম চালু করে। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বরুণা মাদরাসাটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ‘লঙ্গরখানা’। একাত্তরের কঠিন সময়ে হাজার হাজার নিপীড়িত মানুষের আশ্রয় ও অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিল এই বরুণা মাদরাসা।
টিম আল খলীলের অন্যতম সদস্য মাওলানা মাহফুজুর রহমান হুজাইফা বলেছেন, গত পাঁচ দিন ধরে দিন-রাত বন্যার্তের সেবায় ছিলাম। ত্রাণের বস্তা মাথায় তুলে, হাটু, কোমরসমান পানি মাড়িয়েও বিভিন্ন ইউনিয়নে খাবার পৌছে দেই আমরা।
বরুণা মাদরাসার স্বেচ্ছাসেবক টিমের আরেক সদস্য মাওলানা মুছলেহ উদ্দিন বলেন, বরুণা মাদরাসা ও আল খলীলের পক্ষ থেকে বন্যার্ত মানুষের কাছে ত্রাণ পৌছাতে আমরা অনেক জায়গা বুক, হাটুঁ সমান পানি মাড়িয়ে, কখনো পায়ে হেঁটে, কখনে নৌকাযোগে গিয়ে ত্রাণ পৌছে দেই।
জনপ্রিয় উর্দু নাশিদ শিল্পী শেখ এনাম বলেন, মানুষ মানুষের জন্য। ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে আমি মৌলভীবাজার, ফেনীসহ বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকায় পানিবন্দি মাানুষকে নৌকা নিয়ে উদ্ধার করি, এরপর আমরা দুর্গত মাানুষের দুয়ারে দুুয়ারে ত্রাণ পৌছে দেই। উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণকালে অনেক এলাকার মানুষের দুঃখ দুর্দশা দেখে খুব কষ্ট হতো। হঠাৎ বন্যায় কারো ঘরের-ভেতরে কোমরসমান পাানি। সড়কে বুুকসমান পানি। তবে বন্যার্তদের পাশে দাাঁড়াতে পেরে ভাল্লাগার কথাও জানান তরুণ এ নাাশিদ শিল্পি।
টিম আল খলীল ও বরুণা মাদরাসার অন্যতম জিম্মাদার মাওলানা সৈয়দ আতহার জাকওয়ান বলেন, বরুণা মাদরাসার কর্তৃপক্ষের নির্দেশে টিম আল খলীল ও বরুণা মাদরাসার ব্যবস্থাপনায় ইতোমধ্যে আমরা বন্যাকবলিত মৌলভীবাজার টু শমশেরনগর নগর রোড, মাতারকাপন, শিমুলতলা বাজার, রাজনগর উপজেলার কদমহাটা, কামারচাক, কড়াইয়া, তাড়াপাশা, কমলগঞ্েেজ পতনউষার, রুপশপুর, রসুলপুর, বলরামপুরসহ বিভিন্ন উপজেলায় বন্যার্ত মানুষের পাশে শুকনো খাবার, খাদ্যের বস্তা, রান্না করা খাবার, পানি, এবং ত্রাণ বিতরণ করেছি। এছাড়া পানিবন্দিদের উদ্ধার, বন্যার পানি থেকে সড়ক, বাড়িঘর, দোকানপাঠ বাঁচাতে রাতভর পাহারা ও বাঁধ নির্মাণে সড়কে বালির বস্তা ফেলে স্বেচ্ছাসেবকের কাজও করে বরুণার ছাত্ররা।
রাজনগরে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি পরিবারের সাথে আলাপকালে তারা জানান, আমরা কয়েকদিন ধরে রান্না করতে পারছি না। এ পর্যন্ত আমাদের কাছে যাদের ত্রাণ বেশি কাজে এসেছে তারা হলেন বরুণা মাদরাসার হুজুররা। আমরা তাদের জন্য দোয়া করি।
কমলগঞ্জের উপকারভোগী একটি পরিবার জানান, শুকনো খাবার অনেকে নিয়ে এসেছেন কিন্তু এ পর্যন্ত রান্না করা খাবার বা ভারী খাদ্য কেউ নিয়ে আসেননি। তবে টিম আল খলীল ও বরুণা মাদরাসার পক্ষ থেকে পেয়েছি। আমরা শোকরিয়া আদায় করি।
বরুণা মাদরাসার শুভাকাঙ্খী শিক্ষক আশিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, বন্যার্ত মানুষের অবর্ননীয় দুর্ভোগ আর বিপন্নতা দেখলে চুখে পানি চলে আসে। দেশ ও মানুষের দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বরুণার উদ্যোগ ও সহায়তামূলক তৎপরতা সোনার হরফে লিখে রাখার মতো। বানভাসি মানুষের প্রতি সহযোগিতার ধারাবাহিকতা যেন অব্যাহত থাকে। বন্যার্ত মানুষের সহায়তার জন্য বরুণা মাদরাসার নানা উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয়।
বন্যায় আল খলীল এডু্েকশন এন্ড কালচারাল সেন্টার ও বরুণা মাদরাসার তৎপরতা জানতে চাইলে জেলার প্রাচীনতম দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বরুণা মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল,দ্বীন টিভি ইউকের চেয়ারম্যান ও লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা আল-খলীল ফাউন্ডেশনেরও চেয়ারম্যান মাওলানা শেখ বদরুল আলম হামিদী বলেন, বরুণা মাদরাসাটি জন্মলগ্ন থেকে নানা ধরণের মানবসেবা কার্যক্রম শুরু করে অদ্যাবধি অব্যাহত রেখে চলেছে। দেশের যেকোনো দুর্যোগ দুর্বিপাকে বরুণা মাদরাসা নানা উদোগের মাধ্যমে এগিয়ে আসে।
সম্প্রতি মৌলভীবাজার জেলার মৌলভীবাজার সদর, রাজনগর, কমলগঞ্জসহ বিভিন্ন উপজেলায় বন্যার্ত মানুষের পাশে দিনরাত সেবা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে টিম আল খলীল ও বরুণা মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের কয়েকটি টিম। ভয়াবহ বন্যা শুরু হলে টিম আল খলীল ও বরুণার ছাত্র শিক্ষকরা নৌকা নিয়ে পানিবন্দিদের উদ্ধার করেন।
পরবর্তীতে যে এলাকায় শুকনো খাবার দররকার সেখানে শুকনো খাবার পৌছে দেন। যেসব বন্যাকবলিত এলাকায় খাদ্য, ত্রাণ বা রান্না খাবার দরকার স্বেচ্ছাসেবকরা বুকসমান পানি, হাটুসমান পানি মাড়িয়ে কখনো বা নৌকাযোগে এসব ত্রাণ-খাদ্য মানুষের বাড়ি-ঘরে পৌছে দেন। আজ অদ্যাবধি অব্যাহত রয়েছে। মৌলভীবাজার জেলা এবং ফেনীসহ বিভিন্ন জেলায় আমাদের সেবা অব্যাহত রয়েছে।
সাম্প্রতিক বন্যায় বরুণার তৎপরতা জানতে চাইলে বরুণা মাদ্রাসার নায়েবে সদরে মুহতামিম মাওলানা শায়খ নূরে আলম হামিদী বলেন, মানবিক কার্যক্রম করা ইসলামের শিক্ষা। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ যেকোনো বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে আমরা সাধ্যমত থাকার চেষ্টা করি। আমরা এবারের বন্যায়ও বানভাসিদের পাশে থাকার উদ্যোগ নেই। দেশ-বিদেশ থেকে আমাদের হিতাকাঙ্খীরা আমাদের ফান্ডে অনুদান দিয়ে অংশ নেন। তাছাড়া আর্তমানবতার সেবা আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্যেরও অংশ। সেবাপ্রদানের ক্ষেত্রে আমরা মুসলিম-অমুসলিম বাছ-বিচার করি না। যেখানেই দুর্যোগ ও দারিদ্র্যের খবর শুনতে পাই, সুযোগমতো সাধ্যের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করি।
গাজী মাাওলানা শেখ নূরে আলম হামিদী আরও বলেন, প্রবাসে থাকার কারণে দেশের মানুষের এমন দুঃখ দূর্দশা দেখে অনেক কষ্ট হয়। মনটা পড়ে থাকে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য। নিজ জেলা মৌলভীবাজারের মানুষ ভয়াবহ বন্যা কবলিত। নিজে উপস্থিতি হতে না পারলেও মৌলভীবাজারে বন্যার প্রথম দিন থেকে বরুণা মাদরাসার শিক্ষক-ছাত্রদের মাধ্যমে আমরা কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবক টিম গঠন করে বন্যাকবলিত এলাকায় পানিবন্দিদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা, পর্যায়ক্রমে শুকনো খাবার, রান্না খাবার ও খাদ্য-ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। যারা যেভাবেই সহযোগিতা করেছেন রাব্বে করিম সবাইকে উত্তম বদলা দান করুন।
বরুণার মাদরাসার সদরে মুহতামিম মাওলানা সাইদুর রহমান বলন, মানবসেবা তো ইসলামের অন্যতম একটি নির্দেশনা। যেকোনো দুর্যোগে এগিয়ে আসা আলেমদের জন্য এটি একটি দায়িত্বও বটে। প্রত্যেককেই যার যার অবস্থান থেকে এ কাজে শামিল হওয়া উচিত। তিনি বলেন ত্রাণ বিতরণসহ যেকোনো মানবসেবায় আলেমদের অংশগ্রহণ সমাজে ব্যাপক কল্যাণ বয়ে আনবে। এর দ্বারা মসজিদ-মাদরাসাগুলো আরও লাভবান ও প্রভাবপূর্ণ হবে বলেও তিনি জানান।
মন্তব্য করুন