বহু মাত্রিক প্রতিভার অধিকারি সব্য সাচী মীর লিয়াকত : বীরের বেশে তাঁর পথ চলা
মুজিবুর রহমান মুজিব॥ মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ট জীব। আশরাফুল মকলুখাত। সনাতনী শাস্ত্রানুসারে নর রুপী নারায়ন। মানুষের মেধা ও মনন-প্রজ্ঞা ও পান্ডিত্য শিক্ষা ও জ্ঞান মানুষকে প্রানীকুলের মধ্যে শ্রেষ্টত্বের আসনে বসিয়েছে। মহান ¯্রষ্টার সৃষ্ট শ্রেষ্ট জীব এই মানুষের জীবন খুব ক্ষনস্থায়ী। অনির্ধারিতও।
জন্ম থেকে মৃত্যুর মধ্যবর্ত্তী-অন্তবর্ত্তী কালীন সময়ের নাম জীবন। দেওয়ানী আইনের পরিভাষায় এই অন্তবর্ত্তীকালীন সময়কে “অফরহঃধৎরস চবৎরড়ফ” বলা যেতে পারে।
এই ক্ষনস্থায়ী পৃথিবী-স্বল্পকালীন মানবজীবনে কিছু মহৎ মানুষ-আদর্শ মানুষ দেশ জাতি- তথা মানব কল্যানে এমন কিছু করে যান যার জন্য তাঁকে দেশ ও জাতি চীরকাল স্মরন করেন কৃতজ্ঞতায়-শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায়। সব্যসাচী লেখক-সহজ সরল সাদা মনের মানুষ মীর লিয়াকত তেমনি একজন মহৎ মানুষ। সৎ মানুষ। বানিজ্যায়ন-দুবৃত্তায়ন-ভ্রষ্টাচারের বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মাঝে একজন মীর লিয়াকত চাই চাই খাই খাই কালচার পরিহার করে পেশা হিসাবে বেছে নেন মহান পেশা শিক্ষকতাকে। একজন আদর্শ শিক্ষক-মানুষ তৈরীর মহান কারিগর হিসাবে একটি জ্ঞান ভিত্তিক উন্নত আদর্শ সমাজ বিনির্মানে কাজ করেছেন-করছেন। ষাটের দশকে উন্নত ও আধুনিক চিন্তাধারার পাকিস্তানে পড়ুয়া চিন্তাশীল যুবক মীর লিয়াকত সংঘঠক হিসাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে স্বাধীনতা উত্তরকালে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্ভোদ্ধ প্রাণবন্ত উচ্ছল তরুন ব্যবসা বানিজ্য ও অর্থ কড়ির পিছনে না ঘুরে স্বল্প মাইনার শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছেন। কলম সৈনিক হিসাবে সাহিত্য সাময়িকী বিকীরন প্রকাশ শুরু করে আমাদের প্রায়ান্ধকার জীবন ও জগতকে আলোকিত করেছেন-সাংস্কৃতিক জীবনকে বাঙময় ও প্রাণময় করে তুলেছিলেন। এহেন ষাটোর্ধ প্রানবন্ত তরুন কর্ম্মবীর মীর লিয়াকত এর জীবন দর্শন সংক্রান্ত এক খানাজীবনী গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে যেনে আন্তরিকভাবে আনন্দিত হলাম। উদ্যোক্তাদের এই মহতি উদ্যোগের প্রশংসা করলাম। প্রকাশিতব্য সংকলন প্রকাশে সহযোগিতার আশ^াস দিলাম। আমার দেখা মীর লিয়াকত তাঁর বহুমাত্রিক প্রতিভা তার বিপুল রচনা সম্ভার এবং বিস্তৃত কর্মময় জীবনের উপর কিঞ্চিত আলোকপাতের কথা দিলাম। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ঢাকাস্থ জালালাবাদ এসোসিয়েশন এর বার্ষীক সাধারন সভা ও নির্বাচন উপলক্ষে সংস্থার আজীবন সদস্য হিসাবে ঢাকায় যাই। বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা, আনন্দ, উচ্ছাস এর মাধ্যমে দারুন জমে উঠেছিল সুসজ্জিত ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট ও আশপাশের এলাকা। চার সহ¯্রাধিক ভোটার এর মধ্যে সৌভাগ্য বশতঃ ভোটার নাম্বার ওয়ান হিসাবে ভোট দিয়ে সামিল হই বৃহত্তর সিলেটিদের মিলন মেলায়। এখানেই সাক্ষাত সব্য সাচী মীর লিয়াকত এর সঙ্গেঁ। মফস্বল প্রেমিক মীর লিয়াকত অধুনা বসত করছেন রাজধানী ঢাকায়। মাথার মধ্যভাগে টাক ছাড়া গোলবাটা মুখ, স্বপ্ন ভরা দুই মায়াবী চোখ, কাধ অবদি ছড়ানো বাবরি চুল আর ফর্সা চেহারার মীর লিয়াকত ঠিকই আছেন। বেশ কিছুদিন পর দেখা। শিশু-যুবাদের মত একে অন্যকে জড়িয়ে ধরলাম। আবেগে আনন্দে কোলাকোলি করলাম। সব্যসাচী লেখক সাংস্কৃতিক সংঘঠক মীর লিয়াকত ব্যাক্তিগতভাবে মানুষ হিসাবে ও চমৎকার। বন্ধু বৎসল। বিনয়ী। স্বজ্জন। সহজ-সরল। কি হনুরে ভাব নেই। বরং মুখে এক চিলতে মায়াবী মিষ্টি হাসি লেগে আছে সব সময়। স্বপ্নময় দুই চোখ আকর্ষনীয়। ব্যবহার-আদব-তামিজ অপূর্ব। চমৎকার। তার শিষ্টাচার সৌজন্য বোধ ও বিনয়াচরন আমাকে বিমুগ্ধ করে। বিমোহিত করে। তাঁর সঙ্গে আমার কোন আত্বীয়তা নেই তবুও তিনি আমার আত্বার আত্বীয়। তিনি আমার রাজনৈতিক মিত্র কিংবা কেডার-গডফাদার কিংবা আমার ব্যাবসায়ীক অংশীদার নন (মূলত আমরা দু’জন কোন ব্যাবসায়ী নই। পেশাগত ভাবে আমরা দুই জন ভিন্ন পেশার মানুষ) তবুও তিনি আছেন আমার অন্তরে-অনুভবে-হৃদয়ের কাছাকাছি। তাঁর সৃষ্টিশীল-মননশীল কাজ সমূহ, তার প্রকৃতি ও মানব প্রেম, মানবিক জীবনবোধ আমাকে বিমুগ্ধ করে। বিমহিত করে। শমসের নগরের মতি মঞ্জিল থেকে মৌলভীবাজার পৌর এলাকাধীন মুসলিম কোয়ার্টার এর রসুলপুর হাউস বেশ দুরে হলেও কাজের মানুষ-কথার মানুষ-আমার মনের মানুষ মীর লিয়াকত সদা সর্বদা আছেন আমার হৃদয়ের কাছাকাছি। শুরুতেই মীর লিয়াকত আলীর সুস্বাস্থ্য, দির্ঘায়ু, পারিবারিক কল্যান এবং লেখালেখির জীবনের সাফল্য কামনা করি।
সব্যসাচী মীর লিয়াকত আলীর সঙ্গেঁ আমার পরিচয় সেই ষাটের দশকেই। তিনি আমার কঞ্চিত কনিষ্ট। আমি সত্তোর পেরিয়েছি। তিনি হয়ত পেরিয়েছেন ষাট। আমি ষাটের দশক থেকে রাজনীতি সাহিত্য, সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা ও সামাজিক কর্মকান্ডের সঙ্গেঁ জড়িত। ফলতঃ প্রত্যেকটি উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যন্ত আমার আসা যাওয়া ও যোগাযোগ ছিল। ঐ দশকে আমি প্রথমত মৌলভীবাজার কলেজ শাখা অতঃপর মহকুমা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম। তখন নিবর্তন মূলক পাক রাজনীতির কারনে আওয়ামীলীগ শক্তিশালী ও সংঘঠিত সংগঠন ছিলনা, ফলত আওয়ামীলীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগকেই রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে হত। আমাদের উপজেলা সমূহের মধ্যে আমাদের নিকট প্রতিবেশী কমলগঞ্জ একটি রাজনৈতিক সচেতন এলাকা। একাধিক চা বাগান এবং হাওর করাইয়ার কৃষক আন্দোলন এলাকার রাজনৈতিক গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। সমশেরনগর কমলগঞ্জের একটি ইউনিয়ন হলেও শিক্ষা-দীক্ষা-রাজনীতি অর্থনীতি এবং রেলষ্টেশনের কারনে জনপদটি ঐতিহ্য মন্ডিত ও গুরুত্বপূর্ন। একাত্তোরের মহান মুক্তিযুদ্ধে কমলগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সংগ্রামী জনতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। সেই দশকে ছাত্রজীবনে কমলগঞ্জ আমার দুইজন শ্রদ্ধেও নেতা ছিলেন ডাঃ চেরাগ উদ্দীন এবং নেতা গফুর হিসাবে পরিচিত আব্দুল গফুর। স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং মরহুম সাংসদ মোঃ ইলিয়াস ও আমার একজন শ্রদ্ধেও নেতা। তাঁর মূল বাড়ি কমলগঞ্জ হলেও তিনি সপরিবারে শ্রীমঙ্গল শহরে বসবাস করতেন। সমশেরনগরে নেতা গফুর ভাইর বাসায় আমার আসা যাওয়া ছিল। রাজনৈতিক কার্য্যক্রম ছাড়াও সমশের নগরে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ছিল। সমশের নগরের মীর লিয়াকত আলী মাঠ কাঁপানো শ্লোগান দেয়া তুখোড় রাজনৈতিক নেতা না হলেও সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের একজন নিবেদিত প্রাণ নেতা ও সংঘঠক ছিলেন। একাত্তোরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় করাচী বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় মীর লিয়াকত পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে স্বদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সংঘঠক হিসাবে কাজ করেছেন। স্বাধীনতা উত্তরকালে সফল শিক্ষাজীবন শেষে শিক্ষকতা জীবন দিয়ে কর্ম্মজীবন শুরু করে সমশেরনগরেই বসবাস করেছেন। ঢাকায় গিয়ে সাংবাদিকতা এবং জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার নেতৃত্বভার নিলেও প্রিয় সমশের নগরের মাটি ও মানুষের মায়ায় ফিরে এসেছেন। যেভাবে সুরমা পারের কবি দিলওয়ার ঢাকায় জাতীয় দৈনিক গনকন্ঠের সম্পাদকীয় দায়িত্বভার ছেড়ে দিয়ে ভার্থখলা খান মঞ্জিলে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছিলেন।
একটি ইউনিয়ন-সমশেরনগরে বসবাস করলেও কর্মবীর মীর লিয়াকত মহান পেশা শিক্ষকতার পাশাপাশি সাংবাদিকতা পত্র পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখা, গ্রন্থ রচনা ও প্রনয়ন, নাটক, কবিতা ও গান রচনা, সুর আরোপ ও সঙ্গীঁত পরিবেশনে প্রশংসনীয় অবদান রাখেন। সাহিত্যের সকল শাখায় তিনি অবাধ বিচরণ করেছেন। পাঠক প্রিয়তা পেয়েছেন। কবি হিসাবেও তিনি জীবন ঘনিষ্ট। সংবেদনশীল। দেশ, মাঠি ও মানুষ, প্রেম, প্রকৃতি মানবের চাওয়া পাওয়া হৃদয়ানুভূতি আনন্দ বেদনার কথা ও কাহিনীর বিমূর্ত প্রকাশ তাঁর রচনায়। তাঁর রচনাগুলির মধ্যে যেমন যেখানে জীবন, আমাকে নিয়ে চল, ভালোবাসার নীল সারথী, সঙ্গীত শতক, সুরমা, চন্দ্র বিন্দু, প্রসঙ্গঁ নির্য্যাস তাঁর উজ্জল প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে। জীবন ঘনিষ্ট কবি মীর লিয়াকত সনেট, রচনায় ও মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। রিমান্ডের উকিল সনেটে তিনি বলেন-
“তোমাকে দেখার আগে ভার সাম্যহীন ছিলাম না
একটা দুধেলগাই ছাড়া আর ছিলনা কিছুই
পাখিরা নিজঘর করে, ইটের গাঁথুনী লাগেনা
কি হতে চাই বুঝিনা ঐ চড়–ই না শিল্পী বাবুই।
কেরোসিন অবস্থা যখন ডাকছে বেহায়া কোকিল
যৌবন খুঁজিনা আমি খুজি শুধু রিমান্ডের উকিল”।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আধিুনক কালে প্রয়াত সৈয়দ সামসুল হক কে বলা হত সব্যসাচী। সাহিত্যে সকল শাখায় সৈয়দ হক দাপটের সঙ্গেঁ বিচরন করে নিজ স্থান করে নিয়েছেন। আমাদের মীর লিয়াকত কে তার সঙ্গেঁ তুলনা করব না কারন প্রয়াত সৈয়দ সামশুল হক বড় মাপের উচু মানের বহুমাত্রিক প্রতিভাবান লেখক ছিলেন। তাই তিনি যথার্থই সব্য সাচী সৈয়দ হক। আমাদের মীর লিয়াকত সৈয়দ সামশুল হক এর মত সাহিত্যের সকল শাখায় স্বচ্ছন্দে – অবাধ বিচরন করেছেন করছেন। তার বহুমাত্রিক প্রতিভা ও বিপুল রচনা সম্ভারের চুড়ান্ত মূল্যায়নের সময় এখনও আসেনি-পাঠক এবং কাল-মহাকাল-তার বিচার বিশ্লেসন বিবেচনা করবেন। এখনও তিনি উচ্ছল তারুন্যের দিপ্তীতে ভরপুর। লিখছেন দু’হাতে। এখন তার এগিয়ে যাবার সুরের বিচিত্র বাহার ও স্বপ্নের জাল বুনার সময়।
আমার প্রিয় কবি প্রিয় লেখক প্রিয় শিল্পী সর্ব্বোপরি আমার প্রিয় মানুষ মীর লিয়াকত আলীর সুস্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু পারিবারিক কল্যান এবং শিল্পী জীবনের সাফল্য কামনা করি।
আশির দশকে তাঁর একটি অনুষ্টানে তাঁকে নিয়ে লেখা আমার একটি ছড়া দিয়েই শেষ করছি।
-লিয়াকত আলী মীর
গায়ে গতরে ছোট হলেও কাজে কর্ম্মে বীর-।
[ষাটের দশকের সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক সংঘঠক। একাত্তোরের মুক্তিযোদ্ধা। সিনিয়র এডভোকেট হাই কোর্ট। সাবেক সভাপতি মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব]
মন্তব্য করুন