বাঁশের চালীতেই জীবন চলে
ইমাদ উদ দীন॥ বাঁশের চালীতে পানির উপররেই জীবন ওদের। নাওয়া ,খাওয়া, রান্নাবান্না, ঘুম আর আয় রোজগার সবই ওখানে। পানির উপরেই ভাসমান জীবন তাদের। কয়েক হাজার বাঁশ। একসাথে বেঁধে (চালী বানিয়ে) গাঙ্গ, হাওর আর ছোট বড় নদী পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে ছুটে চলা। জেলার জুড়ীর কন্টিনালা, কুলাউড়ার ফানাই ও মনু নদী আর হাকালুকি হাওরে এখন এই দৃশ্য। বর্ষা মৌসুম থাকায় চারিদিকে থৈ থৈ জলরাশি। ৫০-৬০ফুট গভীর পানির ¯্রােত আর প্রবল বাতাসের কর্কশ শব্দ।সাথে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ,বৃষ্টি,রোদ আর ভয়ংকর ছোট বড় টেউ। ওরা জানাল এরকম বিপদ সংকুল পরিবেশ সবময়ই। পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে ওরা ভয় কে জয় করে। অথৈই জলে ভেসে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকে জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার প্রাণপণ প্রচেষ্ঠা চালায়। নৌকা যুগে জুড়ীর কন্টিনালা নদী হয়ে হাকালুকি হাওরের ওয়াচ টাওয়ার যাওয়ার পথে রাবার ড্যাম এলাকায় দেখা মেলে ভাসমান বেশ কয়েকটি ছোট বড় বাঁশের চালীর।
এসকল চালীর দায়িত্বে থাকা মাঝিদের সাথে কথাবলে জানা গেল এ পেশার আদ্যোপান্ত। এসব মাঝি মাল্লাদের মধ্যে দলপতি শহীদ মিয়া (৩৮) মানবজমিনকে জানালেন এ পেশার নেপথ্য কথা। মূলত শেকড়ের টানেই বাপদাদাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে তারা পড়ে আছেন এ পেশায়। তারা কেউ সিলেট অঞ্চলের না হলেও সিলেটের পাহাড়ী এলাকার বাঁশ মহাল থেকে বাঁশ ক্রয় করে তা নদী পথে ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করেন তারা। তাদের মধ্যে যাদের এ ব্যবসায় পুঁজি খাটানোর মত আর্থিক যোগান আছে তারা নিজেই দেখভাল করেন নিজের ব্যবসা। আর যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো নেই, তারা (মহাজনের) ব্যবসায়ীদের বাঁশ নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিয়ে শ্রমের বিনিময়ে প্রাপ্ত টাকা দিয়েই চালান তাদের ঘর সংসার। তিনি জানালেন বর্ষা মৌসুমে উত্তাল নদী পথে এ সকল বাঁশ গন্তব্যে পৌঁছানো অনেক ঝুঁকি ও কষ্টকর। এসব জেনে বুঝে তারা এ ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় আছেন পেটের দায়ে। বর্ষা মৌসুম ছাড়া এসকল বাঁশ নদী পথে ঢাকায় নেওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ শুষ্ক মৌসুমে নদী ,গাঙ্গ ও হাওর নাব্যতা হ্রাসে পানি হীন চর জেগে হয়ে উঠে ধূ ধূ মরুভূমি। আজ
থেকে ২০-২৫ বছর আগে উভয় মৌসুমে বাশেঁর চালী গুলো ঢাকায় নিয়ে যাওয়া গেলেও এখন সেটা শুধু অতীত স্মৃতি। তাই বছরের ৮-৯ মাসই এ পেশায় তাদের জমজমাট আয় রোজগার। চালী মাঝি মো: সিরাজ, মোশারফ-১,মোশারাফ-২, আফজাল, আলী হোসেন, তফজ্জুলসহ অনেকেই জানালেন ঢাকায় নদী পথে এসকল বাঁশ পৌঁছানো সড়ক পথের চাইতে খরচ কম পড়ে বলেই এখনও তাদের এপেশাটি জীয়ে আছে। সড়ক পথে এক দু’দিনে মাল ঢাকায় পৌঁছানো গেলেও বাঁশ প্রতি খরচ পড়ে ২০-২৫ টাকা। আর নদী পথে সময় যায় ১০-১২ দিন কিন্তু বাঁশ প্রতি খরচ পড়ে ৬-৮ টাকা। মাঝিরা জানালেন প্রবল বর্ষণে নদী কিংবা হাওরে বাতাস আর পানির টেউ বাঁশের চালী গুলোর বাধঁ গুলো খুলে যাওয়ার ভয় থাকে বেশি। এসময় তারা চালী গুলো না চালিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেন। আর তখন ওখানেই বাঁশের চালীর উপর কাটে তাদের রাতদিন। আবহাওয়া অনূকুলে থাকলে চালীর সাথে ইঞ্জিনের নৌকা বেধেঁ চালী গুলো অনেকটা দ্রুত চালানো যায়। তাদের দেওয়া তথ্যমতে ঢাকা পর্যন্ত মাল নেওয়ার জন্য তাদের সহজ ব্যবহার্য নদীপথ হল কন্টিনালা, ফানাই, হাকালুকি হাওর, সুরমা, কুশিয়ারা, বডটুল, মেঘনা, বুড়িগঙ্গা আর পদ্মা। চালী মাঝিরা জানালেন মহাজনের বিনিয়োগ অনুযায়ী তাদের বেতন নির্ধারণ হয়। তারপরও তারা মাসে ১২ থেকে ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসিক বেতন পান। জুড়ী উপজেলার বাঁশ মহালের ইজারাদার মামুনুর রশিদ জানান তার মহালসহ পাশ্ববর্তী মহাল থেকে মাখাল (মৃত্তিঙ্গা), মুলি ও খাঙ্গ জাতের বাঁশ পাইকাররা কিনে সড়ক বা নদীপথে চালী বানিয়ে বরিশাল,পটুয়াখালী,ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্তে নিয়ে যান। এক্ষেত্রে নদী পথে পরিবহন খরচ কম হওয়ায় অধিকাংশ ক্রেতাদের পচন্দ নদী পথে মাল গন্তেব্যে নিয়ে যাওয়ার। তিনিসহ অনান্য মহালদারের দাবী নাব্যতা হ্রাস হয়ে যাওয়া নদী,হাওর ও গাঙ্গগুলো খনন করার। তাহলে নৌপথে মালামাল দ্রুত ঢাকায় পৌঁছানো সম্ভব হবে এবং পরিবহন খরচও অনেকটা সাশ্রয়ী হবে।
মন্তব্য করুন