বাংলাদেশের সর্বপ্রথম গণআদালতে দুদু রাজাকারের প্রকাশ্যে গুলি করে মৃত্যুদন্ড কার্যকর
বিকুল চক্রবর্তী॥ রাজনগরের গণ আদালতের ধারাবাহিকতায় ৭৫’র বেদনাদায়ক পটপরিবর্তনের ১৭ বছর পর বাঙালি জাতি আবারো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের গণআদালত গঠনের মাধ্যমে। নতুন প্রজন্ম শাহবাগের থেকে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার প্রত্যয় নিয়ে মানবতাবিরোধি যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে এক অভূতপুর্ণ শান্তিপুর্ণ আন্দোলন করে, যার ফলে রাজাকার শিরোমণিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে সোনার বাংলা হয় কলঙ্কমুক্ত ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দীপ্ত পায়ে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত বছরে মৌলভীবাজার জেলা হানাদার মুক্ত হওয়ার পরপরই বাংলাদেশে একটা ঐতিহাসিক মৃত্যুদন্ডের রায় কার্যকর হওয়া গণআদালত হয় মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলায়। গণ-আদালতের রায়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয় রাজাকার শিরোমণি দুদু মিয়ার। আর এই রায়ের ধারাবাহিকতায় দেশ ব্যাপী বিভিন্ন গণ-আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য শহীদ জননী জাহানারা ইমামের গণ-আদালতের রায় ঘোষনা, গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন প্রভৃতি। যেগুলোতে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলো স্বাধীনতা বিরোধি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে। প্রয়োজনে স্বাধীনতার সুফল রক্ষায় বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লড়াইয়ে ভবিষতেও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনেরও শক্তির আধার হবে ঐতিহাসিক এ রায় এমনটাই অভিমত স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের।
রাজনগরের গণআদালত ও রায়ের সমৃদ্ধ ইতিহাস থাকলেও এ নিয়ে তেমন আলোচনা বা বিশ্লেষণ জনসম্মুখে প্রকাশ পায়নি। ফলে নতুন প্রজন্মের নিকট আজও অজানা রয়ে গেছে দেশের অন্যতম একটি গণ আদালতের রায়ের ইতিহাস। সেই রায় ঘোষনার ৪৮ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, আজও বেঁচে আছেন এই রায়ে অংশ নেয়া অনেক গুণীজন। সম্প্রতি এই রায়ের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বেশ কয়েকজনের সাথে আলাপ করলে উঠে আসে কালের বিবর্তনে চাপা পড়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক সমুজ্জ্বল ইতিহাস।
১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর, (তারিখ নিয়ে কারো কারো মতান্তর রয়েছে) গণ-আদালতে দুদুর মৃত্যুদন্ডের ঐতিহাসিক এ জনরায় ঘোষিত হয় রাজনগর উপজেলার মুন্সিবাজার ইউনিয়নের মুন্সিবাজারের দক্ষিন পাশে বর্তমান খলাগাঁও করিমপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও খলাগাও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে, পাশের জমি ও সড়ক জুড়ে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে।
যে কারনে দুদু আসামী
রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে মুন্সিবাজার ও খলাগ্রাম এলাকায় বহু মানুষকে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করে পাকবাহিনী। আর তাদের সাহায্য করে স্থানীয় কিছু চিহ্নিত রাজাকার। মুন্সিবাজার এলাকার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান বারিক মিয়ার অন্যতম সহযোগী ছিলো দুদু রাজাকার। নয় মাস প্রলয়ঙ্করী তান্ডব চালিয়ে দুদু রাজাকার মুন্সিবাজারের বনেদী হিন্দু পরিবার যা বর্তমানে ‘ধরের বাড়ি’ নামে পরিচিত, (সে সময় রাজবাড়ী ও জমিদার বাড়ি বলে পরিচিত ছিলো) সে বাড়িতে গণহত্যা চালায়। খলাগ্রামের বহু মানুষকে ধরে তুলে দেয় পাক হানাদার বাহিনীর হাতে। পাক হানাদারবাহিনীর এদেশীয় দোসররা মায়ের কাছ থেকে ছেলেকে নিয়ে যায়, স্ত্রীর কাছ থেকে স্বামীকে আর সন্তানের সামনে থেকে বাবাকে নিয়ে লোহাউনি পাহাড়, ধরের বাড়ি, লঙ্গুর পুল এবং মৌলভীবাজার চাঁদনী ঘাটের ব্রীজে লাইন ধরিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে, শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি এ যুদ্ধাপরাধীর দল নিজে ও পাক আর্মি দ্বারা বহু মা ও বোনকে ধর্ষণ- নির্যাতন করায়। যে ঘটনার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত এই দুদু রাজাকার।
বালিগাঁও যুদ্ধ ও দানুমিয়াকে হত্যা:
৭১’ সালের যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম ঘাঁটি ছিলো রাজনগরের বালিগাঁওয়ের শহীদ দানু মিয়ার বাড়ি। দানু মিয়া লন্ডনে অবস্থান করে জাহাজে চাকুরী করতেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চলে আসেন দেশে। সবাইকে সংগঠিত করে যুদ্ধে পাঠান এবং মধ্যবর্তী সময়ে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা দেশে এসে তাঁর বাড়িতেই আশ্রয়নেন। খবর পেয়ে দুদু রাজাকার হানাদার বাহিনীকে নিয়ে যায় দানু মিয়ার বাড়িতে। সেদিন অপারেশন করতে দেশে আশা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে গেরিলা যুদ্ধা প্রয়াত সমাজকল্যান মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলীও দানু মিয়ার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দুই গাড়ি পাকিস্তানীবাহিনী নিয়ে দুদুসহ অনান্য রাজাকাররা তার বাড়ির দিকে আসছে দেখে দানু মিয়া পাকবাহিনীকে গুলিকরে প্রতিহত করে আশ্রয় নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। দানু মিয়া একাই অন্যদের বাঁচাতে যে সাহসী ভূমিকা নিয়েছিলেন তা ইতিহাসের পাতায় স্মরনীয় হয়ে থাকবে। দানু মিয়া যখন পাকবাহিনীকে প্রতিহত করে সময় ক্ষেপন করেন তখন আত্ম রক্ষার্থে তার বাড়িতে আশ্রয়নেয়া মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসীন আলী ( প্রয়াত সমাজ কল্যাণ মন্ত্রি) পালিয়ে দানু মিয়ার পুকুরে নেমে আত্মগোপন করেছিলেন। কিন্তু সবাইকে পালাতে সাহায্য করলেও দুদু রাজাকারসহ অন্যরা ধরে ফেলে দানু মিয়াকে এবং হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। পরবর্তীতে নিয়তিতে যা ছিলো তাই হলো। দানু মিয়া পাকবাহিনীর হাতে হত্যার শিকার হন। সেদিন দানু মিয়াকে ধরে নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি তারা দানু মিয়ার বাড়িঘর লুটপাট করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় রাজাকার দুদুও তার সঙ্গীয়রা। এভাবে দুদু রাজাকারও সঙ্গীয়রা ধরে নিয়ে যায় একের পর এক মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষদের, চালায় নারকীয় নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ। তারা অসংখ্য নারীর উপর চালায় পৈচাশিক নির্যাতন।
ধরের বাড়ি হত্যাযজ্ঞ:
রাজনগর উপজেলার মুন্সিবাজার ইউনিয়নের জমিদার বাড়ী। অনেকে ধরের বাড়ি বলেও জানেন। ১৯৭১। দেশে তখন তুমুল যুদ্ধ চলছে চারিদিকে। অনেকে দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিলেও এলাকার মানুষের প্রতি অগাধ ভালবাসায় ও মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হওয়া ধরের বাড়ির (জমিদার বাড়ির) লোকজন খুব একটা দেশ ছাড়েননি। পাকবাহিনী বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে মুক্তিকামী মানুষদের ধরে নিয়ে হত্যা করছে এমন খবরও বাড়ির লোকজনের কাছে প্রতিনিয়ত আসছে। তদুপরি তারা সে দিন ধারনা করেছিলেন আসলে তারা পালিয়ে গিয়ে আত্ম রক্ষা করতে পারবেন। এভাবেই কেটে যায় ৯মাস। কিন্তু বিধিব্যাম এলাকার কুখ্যাত রাজাকার দুদু মিয়া তাদের দিকে পৈচাশিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো সে এই দৃষ্টি আর সরাতে পারেনি। বিজয়ের আলো দেখতে আর বাকী ছিলো ১৮ দিন। ১৯৭১ এর ২৯ নভেম্বর দুদু রাজাকার সকালে বাড়ির বড়কর্তা সুরীতি মোহন ধরকে গিয়ে জানায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আসবে এই এলাকায় আপনারাতো এই এলাকার জমিদার। আপনাদের বাড়িতে তাদের একটু চা পানের ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। সরলমনা ধরবাবু তাতে সম্মতহন। বিকেল বেলা রাজাকার বারিক মিয়া, দুদু মিয়া পাকবাহিনী নিয়ে প্রবেশ করে ধরের বাড়ি। সবাইকে বাড়িতে ডাকে। সবাই যখন বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করেন তখন প্রকাশ পায় তাদের আসল রুপ। নিমিষেই বিভিশিখা রুপ ধারণ করে পাক বাহিনী অকাতরে গুলি করে হত্যা করে এ জমিদারবাড়ীর সকল পুরুষদের। মহিলারা তখন শিশু কিশোরদের নিয়ে আত্মরক্ষার্থে পেছনে দিয়ে পালান। পরে রাজাকাররা ধরের বাড়িতে চালায় লুঠপাঠ। লুঠপাট শেষে বাড়িতে আগুন দিয়ে তারা চলে যায়।
রাজাকার দুদু ও তার সংগীয় রাজাকারদের দ্বারা মুন্সিবাজার ইউনিয়নে ধরের বাড়িতে গণহত্যায় নিহতরা হলেন, সুরীতি মোহন ধর চৌধুরী, সুশীতল ধর চৌধুরী, শ্যামল ধর চৌধুরী, শতদল ধর চৌধুরী, শ্যামল ধর চৌধুরী, সজল ধর চৌধুরী, সুকেশ রঞ্জন ধর চৌধুরী, অরবিন্দ ধর চৌধুরী, অখিল ধর চৌধুরী, প্রতাপ পুরকায়েস্থ, যতীন্দ্র মোহন ঘোষ, পরিমল দাস, বিজয় দাস, নরেন্দ্র দেব, ও খিরোদ দেব ।
এ ছাড়াও মুন্সিবাজার ও উত্তর ভাগ ইউনিয়নে গণহত্যায় বাকী নিহতরা হলেন, সনথ চক্রবর্তী, রফিকুল ইসলাম, নবজাত আলী, বাদশাহ মিয়া, ছানা শীল, বাবুল দেব, ভবতোষ দাশ, মহিতোষ দাশ, বনমালী দাশ, নগর কান্তি দাশ, নরেশ সুত্রধর, খোকা সুত্রধর, অসিত দেব, বটুল পাটনী, ডা: জামিনী মোহন দেব, তারা মিয়া, কুরবান আলী ও দানু মিয়াসহ অজ্ঞাত আরো কয়েকজন। যে কারণে মানুষ দুদুসহ রাজনগরের রাজাকার আলবদর আল সামছদের উপর ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন।
বাঙ্গালি জাতির স্বাধীনতা লাভের মহানায়ক, মহান স্বাধীনতার ঘোষক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে দেশকে শত্রুমুক্ত করার শপথে বলীয়ান মুক্তিকামী বাংলার জনগণ যুদ্ধের একপর্যায়ে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তা নিয়ে নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রাম ও বহু ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে ছিনিয়ে আনে বিজয়। ৭১’ সালের ৫-৮ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর তোপের মুখে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মৌলভীবাজার জেলার সবগুলো এলাকা ছেড়ে পিছু হটতে থাকে সিলেটের দিকে। এদিকে ৬ ডিসেম্বর চুড়ান্তভাবে রাজনগর হানাদারমুক্ত হলে স্বজনহারা মানুষেরা রাজাকারদের ধরতে মরিয়া হয়ে উঠেন।
যেভাবে ধরা পড়ে দুদু
মুক্তিযুদ্ধের ৪ নং সেক্টরের সাব সেক্টর – ৪ এর কোম্পানী কমান্ডার মুহিবুর রহমান চৌধুরী জানান, দুদু রাজাকার আত্মগোপন করে থাকার চেষ্টা করে কিন্তু স্থানীয় মুক্তিকামী মানুষ তাকে যেভাবে খুঁজছিলো তার পক্ষে এলাকায় লুকিয়ে থাকা সম্ভব ছিলো না, এ ব্যাপারটি বুঝতে পেরে রাজাকার দুদু সিদ্ধান্ত নেয় জীবন বাঁচাতে মৌলভীবাজারে গিয়ে আত্মসমর্পন করবে।
তিনি জানান, একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর দুদু রাজাকার একটি বোরকা পড়ে মৌলভীবাজারের দিকে রওয়ানা হয়। গ্রামের ভেতরের মেঠোপথ ধরে মৌলভীবাজার যাওয়ার পূর্বে মহল্লাল এলাকায় লোকজন তার পায়ে পুরুষ মানুষের জুতো দেখে সন্দেহ করেন। এ সময় বোরকা খোলে দেখেন পুরুষ মানুষ, সাথে আশপাশের লোক জড়ো হলে অনেকেই তাকে চিনে ফেলেন। তখন সে জানায় আত্মসমর্পন করতে যাচ্ছে। লোকজন তাকে ধরে মৌলভীবাজার জেল হাজতে প্রেরণ করে। মতান্তরে মুন্সিবাজার নোয়া টিলার গণহত্যায় শহীদ নজাবত আলীর ভাই বর্তমান এন আর বি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ফারাসাত আলী জানান, দুদু একটি রিক্সায় করে পালিয়ে যাচ্ছিল, মহল্লাল এলাকায় তাঁর চাচা নোয়া টিলার বাবুল মিয়া পর্দা টাঙ্গানো একটি রিক্সায় পুরুষ মানুষের পা দেখতে পান। তখন সন্দেহ হলে তাঁর চাচা উপস্থিত লোকজনদের নিয়ে রিক্সার পর্দা খোলে দেখেন দুদু রাজাকার তখন তারা দুদুকে ধরে দেন।
খলাগ্রামের প্রখ্যাত আইজীবী অ্যাডভোকেট শান্তিপদ ঘোষ মতি জানান, দুদু আটকের এ খবর দ্রুত চলে যায় তাঁর অত্যাচারের দুঃস্মৃতি বিজড়িত মুন্সিবাজারে, সাথে সাথেই খলাগ্রাম, বালিগাঁও, মুন্সিবাজারসহ আশপাশের গ্রামের হাজার হাজার মানুষ বের হয়ে পড়েন রাস্তায় এবং দুদুকে ধরে এনে প্রকাশ্যে জনতার বিচার ও রায়ের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
এ সময় কোম্পানী কমান্ডার মুহিবুর রহমান ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তার বাহিনী নিয়ে সিলেটে যাওয়ার জন্য মুন্সিবাজার এলাকায় অস্ত্র সংগ্রহ ও সাথী যোদ্ধাদের জড়ো করছিলেন। অস্ত্রসহ মুক্তিযোদ্ধারা যখন ওই জায়গাটি অতিক্রম করছিলেন তখন জনতা তাদের পথ রোধ করেন। মুহিবুর রহমান জানান, উপস্থিত হাজারো জনতা দুদু মিয়াকে ধরে এনে জনতার আদালতে বিচারের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন তাকে ও তার পুরো বাহিনীকে। কোন ভাবেই তারা লোকজনকে বুঝিয়ে সিলেটের দিকে রওয়ানা দিতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়ে মুহিবুর রহমান ওয়ারলেসযোগে মৌলভীবাজারে উর্ধতন কর্মকর্তা সাব সেক্টরের দায়িত্বে থাকা কে. হামিদ (মিত্র বাহিনীর অফিসার) ও বাংলাদেশের লে. ওয়াছিউর জামানকে (ফাস্ট আর্মি কমিশন) অবগত করেন। তারা প্রথমে শুনে উর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে ফের সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে জানান, কিছুক্ষন পর ওয়ারলেসযোগে ফিরতি মেসেজ আসে। সেখান থেকে মৌলভীবাজারে লোক পাঠিয়ে রাজাকার দুদুকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
এই বিষয়টি সহজ করেন প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান ও মীর্জা আজিজ বেগসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক।
বর্তমান মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান জানান, সে সময় গণদাবীকে মুল্যায়ন করে একজন সুবেদারের সাথে কয়েকজন ফোর্সসহ দুদুকে মুন্সিবাজারে প্রেরণের সিন্ধান্ত দেন । সেই মোতাবেক মুন্সিবাজার থেকে মো. ইলিয়াছ আলী, বাদশা মিয়া, সিরাজুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন মৌলভীবাজার এসে এক সেকশন ফোর্সসহ হাবিলদার মতিউর রহমানের নেতৃত্বে জেল থেকে দুদুকে নিয়ে যান মুন্সিবাজারের দক্ষিন পাশে বর্তমান খলাগাও করিমপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে।
যে ভাবে রায় কার্যকর হয়
সেখানে পূর্ব থেকেই লোকজন অবস্থান নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। সবার উপস্থিতিতে শুরু হয় বিচারকার্য। হাবিলদার মতিউর রহমান জনতাকে বলেন, দুদু রাজাকারের বিচার আপনারা যেভাবে চান সেভাবেই হবে। গ্রামের মুরব্বিদের নিয়ে শুরু হয় বিচারিক কাজ।
মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মুহিবুর রহমান চৌধুরী জানান, সেদিন বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক লন্ডন প্রবাসী ফিরোজ মিয়া, শহীদ ইয়াছিন আলীর পিতা ডা: সিকান্দর আলী, নোয়া টিলার হানিফ খা, কবির বক্স, শহীদ রফিকের বড়ভাই রইছ মিয়া, গুলিবিদ্ধ সোহরাব আলীর বড়ভাই সামাদ আলী, গয়াস পুরের কটু মিয়া, ছাত্রনেতা পানু সোম, মুসুরিয়ার সিরাজুল ইসলাম ও হীরা মিয়া, তেলী জুড়ির আতাউর রহমান চৌধুরী, দক্ষিন বালিগাও এর আজাদ আলী চৌধুরী, আব্দুল করিম, শশাংক বাবু প্রমূখ।
নিজ দেশের সাথে বেইমানি ও এদেশের মানুষকে নির্যাতনের হোতাপাকবাহিনীর এ চরকে খলাগ্রামে নিয়ে আসার পরপরই জনতা উত্তেজিত হয়ে লাথি থাপ্পর মারা শুরু হয়। এক পর্যায়ে তার পশ্চাৎদেশে (পায়খানার রাস্তা) বাঁশের চোখা লাঠি (সিলেটি ভাষায় ‘বেড়ার গড়ছি’) প্রবেশ করান মুক্তিযোদ্ধা ইসলাম মিয়া। মুক্তিযোদ্ধা ইসলাম মিয়া জানান, তিনি পাশের একটি বেড়া থেকে ‘গড়ছি’ এনে তার পশ্চাৎদেশে প্রবেশ করেন পরে বিচারকদের নির্দেশে তা আবার বের করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে এনে বিচারকরা শুরু করেন বিচার কার্য।
দুদুর সহায়তায় হত্যার শিকার পরিবার গুলোর কাছ থেকে উপযুক্ত স্বাক্ষ্য নিয়ে নানান মতান্তরের পর সবাই মিলে একত্রে রায় করেন স্কুলের দক্ষিন দিকে রাস্তার পাশে কোমর পর্যন্ত মাটি চাপা দিয়ে পাথর ছুড়ে এ গণশত্রুর মৃত্যু নিশ্চিত করা হবে। আর সেখানেই কবর রচিত হবে এবং কবরের উপর লেখা থাকবে কুখ্যাত রাজাকার দুদুর কবর। এ সময় গণ-আদালত স্থলে উপস্থিত দুদুর মা ও ভাই বিচারকদের বার বার অনুরোধ করেন, তাকে গুলি করে হত্যা করে লাশ তাদের দিয়ে দিতে।
তখন গণ-আদালতের বিচারকরা জনগণের কাছে “আপনারা কি চান জানতে চাইলে শিক্ষিত জনতা কিলহীম বলে চিৎকার দিতে কাকেন আর অধিকাংশ জনতা ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই বলে শ্লোগান দিতে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ফারাসাত আলী জানান, তখন পরিবারের আবেদনে পুনরায় বিচার শুরু করে রায় হয় গুলি করে হত্যা করার। আর গুলি করবে যে বাড়িতে সবচেয়ে বেশি হত্যাযজ্ঞ হয়েছে সে বাড়ির সবার ছোট ছেলে। সে মোতাবেক মুন্সিবাজার খলাগ্রামের ‘ধরের বাড়ি’তে সবচাইতে বেশি হত্যাকান্ড হয়, আর ধরের বাড়ির জীবিত পুরুষদের মধ্যে কিশোর সুভাষ ধর (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী) সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বিচারকরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, সুভাষ ধর তাকে গুলি করবেন।
রায় অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা সুভাষ ধরের হাতে তুলে দেন রাইফেল। সুভাষ ধর তাকে গুলি করতে গিয়ে গুলি টার্গেট ঠিক না হওয়ায় সে যাত্রায় সে বেঁচে যায়। পরে সিদ্ধান্ত হয় হাবিলদার মতিউর রহমানের সাথে আসা ০৭ (সাত) সদস্যের মধ্যে একজন গুলি করে হত্যা করবে। সে মোতাবেক ওই সেকশনের সদস্য কমলগঞ্জ উপজেলা নিবাসী আলতাফুর রহমান ব্রাশফায়ার করে তাকে হত্যা করেন। রায় কার্যকর হওয়ার পর দুদুর পরিবারের লোকজন লাশ নিয়ে তাদের বাড়িতে দাফন করেন।
কালের পরিক্রমায় এই গণরায়ের ৪৮ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু আজও এই ইতিহাস সংরক্ষিত হয়নি। সংরক্ষিত হয়নি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত সেই গণ-আদালতে রায়ের স্থানটিও। স্থানীয়দের দাবী, যুদ্ধাপরাধী রাজাকারের বিচারের রায় কার্যকর হওয়া (সম্ভবত) সর্বপ্রথম গণ-আদালতের এই স্থানটি সংরক্ষন করে সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করে কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যেতে বসা এ ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করে রাখার।
রাজনগর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সজল চক্রবর্তী জানান, রাজনগরের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় কোন স্থানই এখন পর্যন্ত সংরক্ষন হয়নি। ধরের বাড়ি ও পাঁচা গাও বধ্যভুমির জন্য বরাদ্দ আসলেও ভুমি জটিলতায় তা বিলম্ব হচ্ছে। তিনি জানান, মুন্সিবাজারের গণ-আদালত মুক্তিযুদ্ধের একটি অন্যতম দলিল। এই গণ-আদালতের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম গণ আদালত গঠন করে প্রতীকি ফাঁসি দেন একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধী গোলাম আজমসহ অনান্য রাজাকারদের। তৎপরে তরুণ প্রজন্মরা তৈরী করে গণজাগরণ মঞ্চ।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ও রাজাকারদের পুনরুত্থান
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু আল-বদর, আল-শামস ও রাজাকারসহ মানবতাবিরোধিদের বিচার শুরু করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। শুধু বন্ধ নয় নতুন শাসক এসে বিচার কাজ সম্পুর্ণরূপে বন্ধ করে আল-বদর, আল-শামস ও রাজাকারদের মুক্তি দেয়, অনেককে পুনর্বাসনেরও ব্যবস্থা করে। বন্ধ হয়ে যায় দুদুদের মতো স্বাধীন বাংলাদেশে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য। রাজাকাররা বীরদর্পে পূর্বে যেভাবে পাকিস্তানী বাহিনীর শক্তিতে মুক্তিকামী মানুষদের হত্যা, নির্যাতন ও অগ্নী সংযোগ করে, তেমনি নতুন এ সরকারের বলে বলিয়ান হয়ে পুনরায় তারা মুক্তিযুদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষদের আতংকের কারণ হয়ে উঠে।
২১ বছর পর পুনরায় গণআদালত
দুদু রাজাকারের গণ আদালতে রায় কার্যকরের ২১ বছর পর শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃতে বসে আরেকটি ঐতিহাসিক গণ-আদালত। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিনা বিচারে রাজাকাররা মুক্তি পাওয়ার ১৭ বছর অতিক্রান্তে ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠে। তবে ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমীর ঘোষণা করলে এই নরপশুকে নিয়ে বাংলাদেশে জনবিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। বিক্ষোভের অংশ হিসাবে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয় আর আহবায়ক করা হয় শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ প্রতিষ্ঠিত হয় গণ-আদালত। প্রতীকী বিচারের মাধ্যমে জামায়াতের তৎকালীন আমির গোলাম আযমের অপরাধ মৃত্যুদণ্ডের শামিল বলে রায় দেয় গণ-আদালত। এই কমিটি ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ ‘গণআদালত’-এর মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের নরঘাতক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে বসে ঐতিহাসিক গণ-আদালত। গণআদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দশটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ১২ জন বিচারক সমন্বয়ে গঠিত গণ-আদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদন্ডতুল্য বলে ঘোষণা করেন।
জাহানারা ইমাম গণআদালতের রায় কার্যকর করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। ওই গণআদালতের সদস্য ছিলেন ড. আহমদ শরীফ, মাজহারুল ইসলাম, এডভোকেট গাজিউল হক, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফী, সুফিয়া কামাল, শওকত ওসমান, লে. কর্ণেল (অবঃ) কাজী নুরুজ্জামান, লে. কর্ণেল (অবঃ) আবু ওসমান চৌধুরী ও ব্যারিস্টার শওকত আলী খান।
তৎকালীণ সরকার রায় কার্যকর করাতো দুরের কথা গণআদালত করার কারণে তৎকালীন সরকার ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে অ-জামিনযোগ্য ধারায় মামলা করে। পরবর্তীতে হাইকোর্ট তাদের জামিন মঞ্জুর করেন।
রাজনগর মুন্সিবাজারের জনগণের মতো নাছোরবান্দা জাহানারা ইমামও এর পিছু ছাড়েননি। তিনি ১২ এপ্রিল ১৯৯২ সালে এই রায় বাস্তবায়নের জন্য লাখো জনতার পদযাত্রার মাধ্যমে স্মারকলিপি নিয়ে জাতীয় সংসদের ঐ সময়ের স্পীকার, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া (বর্তমানে দুর্নীতি মামলার রায়ে কারান্তরীন) ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার কাছে পেশ করেন। সে সময় ১০০ জন সাংসদ গণআদালতের রায়ের পক্ষে সমর্থন ঘোষণা করেন। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সরকার ৩০ জুন ১৯৯২ সালে সংসদে ৪ দফা চুক্তিও করেছিলো। ২৮ মার্চ ১৯৯৩ সালে নির্র্মূল কমিটির সমাবেশে পুলিশ বাহিনী হামলা চালায়। পুলিশের লাঠিচার্জে গুরুতর আহত হন জাহানারা ইমাম।
গোলাম আযমসহ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে করা আন্দোলনকে সমর্থন দেয় ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকায় মুখ্য সংবাদ হয়ে উঠে এটি। যার ফলে আন্তর্জাতিক মহলেও এই আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে।
২৬ মার্চ ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা দিবসে গণ-আদালতের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জাহানারা ইমামের নের্তৃত্বে গণতদন্ত কমিটি ঘোষিত হয় এবং আরো আটজন যুদ্ধাপরাধীর নাম ঘোষণা করা হয়। এই ৮ জন জঘন্য যুদ্ধাপরাধী হলো আব্বাস আলী খান, মতিউর রহমান নিজামী, মোঃ কামরুজ্জামান, আব্দুল আলীম, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, মৌলানা আবদুল মান্নান, আনোয়ার জাহিদ ও কাদের মোল্লা।
২৬ মার্চ ১৯৯৪ সালে স্বাধীনতা দিবসে গণআদালতের ২য় বার্ষিকীতে গণতদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান কবি বেগম সুফিয়া কামাল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সামনে রাজপথের বিশাল জনসমাবেশে জাহানারা ইমামের হাতে জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্ট হস্তান্তর করেন। গণতদন্ত কমিশনের সদস্যরা ছিলেন শওকত ওসমান, কে এম সোবহান, সালাহ উদ্দিন ইউসুফ, অনুপম সেন, দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, খান সারওয়ার মুরশিদ, শামসুর রাহমান, শফিক আহমেদ, আবদুল খালেক এবং সদরুদ্দিন।
রাজাকার ও রাজাকার মদদপুষ্টদের গণ আদালতকে অবহেলা
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের রায় ও গণতদন্ত কমিটির এ কার্যক্রমকে রাজাকার ও রাজাকাদের সেল্টারদানকারীরা মনে করেছিলো এটি ছেলে খেলা। তারা হাস্যরসে তা উড়িয়ে দিয়ে বাংলার মাটিতে দাম্বিকতার সহিত চলতে থাকে। রাজাকাররা প্রভাব খাটিয়ে হয়ে যায় মন্ত্রি এমপি। তাদের গাড়িতে শোভিত হয় রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনা লাল সবুজ পতাকা। কিন্তু ইতিহাস কোন অন্যায়কারীদের ক্ষমা করেনা।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার বঙ্গবন্ধু তনয়ার ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল বিজয়
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ বিপুল ভোটে বিজয়ের মাধ্যমে ২০০৯ সালে সরকার ক্ষমতায় এসে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সাহসিকতার ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী ট্রাইবুনাল গঠন করে। যা ছিলো নির্বাচনী অঙ্গীকার। আন্তজার্তিক সকল মানদন্ড অনুসরণ করে সম্পন্ন হয় বিচারকার্য এবং রাজাকার শিরোমণিদের মৃত্যুদন্ড হয়। যা আজও অভ্যাহত।
রাজাকার কাদের মোল্লাকে শহীদ বলায় ব্যবস্থা
জঘন্ন নরঘাতক রাজাকার কাদের মোল্লার ফাঁসিদেয় আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী ট্রাইবুনাল। স্বাধীন বাংলদেশ এতে কিছুটা কলংকমুক্ত হয়। স্বস্তি পায় বাংলার মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনচেতা মানুষের হৃদয়। এই অবস্থায় সম্প্রতি দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা কাদের মোল্লাকে শহীদ বলে পুনরায় বাংলার মানুষকে আঘাত প্রাপ্ত করে। এতে দেশের জনগনের উত্তেজনা প্রশমিত করতে এবং তাদের এ হেন আচরণের আইনি ব্যবস্থা নিতে সংগ্রাম সম্পাদককে আটক করে পুলিশ। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের জন্য আনীত ৬টি অভিযোগের মধ্যে ৫টিতে দোষী সাব্যস্ত করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাহিনী নিয়ে ৩৪৪ জন নিরীহ ব্যক্তিকে হত্যা ও অন্যান্য অপরাধ সংগঠিত করেন। এর জন্য দোষী সাব্যস্ত করে আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করেন।
এদিকে এর রায়ে সন্তুষ্ট না হয়ে হাজার হাজার মানুষ ঐদিন ঢাকা শাহবাগে জড়িত হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। তার ফাঁসির দাবীতে চলতে থাকে টানা আন্দোলন। জন্মনেয় গণজাগরন মঞ্চ। তারা কাদের মোল্লার ফাঁসিসহ তার দল জামায়েত ইসলামীকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করার দাবী করেন। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ রেখে আন্দোলনের ১২দিন পর ১৭ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল‘স (সংশোধন) বিল, ২০১৩ জাতীয় সংসদে পাস হয়। পরবর্তীতে ৩ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষ তার সর্বোচ্চ শাস্তির আবেদন করে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করে। ১লা এপ্রিল থেকে আপিলের শুনানি শুরু হয়। কয়েক কার্য দিবসে শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সর্বোচ্চ আদালত মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় যাবজ্জীবনের পরিবর্তে কাদেরের মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয় দেশের সবোচ্চ আদালত। এ অবস্থায় যুদ্ধাপরাধী ও তাদের মদদপুষ্ট যারাই পুনরায় অন্যায় আবদার ও স্বাধীনতার পরিপন্থি কার্যক্রমে মাথা নাড়া দিবে, তাদের বাঁধা দেয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী বীর বাঙ্গালীরা রাজনগরের গণ আদালতের রায় কার্যকরের আন্দোলনের ন্যায় বার বার জেগে উঠবে।
এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ স্বাধীন বাংলাদেশ আজ উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের এই ধারাবাহিকতায় রাজনগর উপজেলায় মানবতাবিরোধি হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী ট্রাইবুনালে মামলা হলে বিচারের রায়ে রাজাকারদের ফাঁসির রায় হয়। যার মধ্যে অনেকে রয়েছেন পলাতক। রাজনগরবাসীর দাবী এই পলাতক আসামীদেরকে দেশে ফিরিয়ে এনে সকল আসামীর রায় কার্যকর করা এবং রাজনগর উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃরিতময় প্রত্যেকটি স্থান, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের স্মারক সংরক্ষন করা। একই সাথে তারা দাবী করেন রাজনগর উপজেলায় গণহত্যার শিকার শত শত পরিবার আজো দারিদ্রতার কষাঘাতে জরজড়িত। এই পরিবার গুলোকে সহায়তার পাশাপাশি মুল্যায়নের ব্যবস্থা গ্রহনে সরকার উদ্যোগ নিবেন।
মন্তব্য করুন