বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ : অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ না আন্তর্জাতিক
সৈয়দ আমির”জ্জামান॥ মিশন-২০২১ ও রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকারের যেমন নানা উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ঠিক তেমনি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক মিশন-২০২০ প্রণয়ন করেছে। আর তাই ভূ-অবস্থানগত কারণে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামরিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের গুর”ত্ব দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে। সেই সাথে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ চক্রান্তের আশঙ্কাও বাড়ছে। পরিকল্পিতভাবে জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসবাদ উস্কে বা চাপিয়ে দিয়ে উল্টো সেই সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে নয়া সাম্্রাজ্যবাদী যুদ্ধ আগ্রাসনের আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের টার্গেট এখন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ দখল করাও সেই টার্গেটেরই অংশ। আলোচনার মাধ্যমে দর কষাকষির পথে যখন বাংলাদেশের উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি, তখন ‘সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টি ও দমন’-এর পরিচিত কৌশলেই এগোচ্ছে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ। কিন্তু তাকে প্রতিরোধে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার করা দরকার। নিজ দেশে সন্ত্রাসবাদ কঠোর হাতে দমন করে এবং নতুন করে সন্ত্রাসবাদের বিস্তার রোধ করেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা বাংলাদেশের জন্য জর”রি। সেটাই হবে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের বির”দ্ধে যথোপযুক্ত ও সঠিক কৌশল। এখানে সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিয়ে ও ধর্মের মুখোশ পড়ে জঙ্গীবাদীরা সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটানোর প্রয়াস চালাচ্ছে। সেই মুখোশ খুলে দিয়ে সন্ত্রাসবাদ নির্মূল জর”রি জাতীয় কর্তব্য। সন্ত্রাসবাদের সাথে আপোসের কোনো সুযোগ নেই। এর ফল শুভ হওয়ার কোনোই কারণ নেই। অন্যদিকে সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী বৈশ্বিক যুদ্ধ চক্রান্তের সাথে ঢাকাকে যুক্ত করার সুযোগ নিতে চায় আমেরিকা। আর মধ্যপ্রাচ্য স্টাইলের এই আন্তর্জাতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই তাদের লক্ষ্য পূরণ হবে। বাংলাদেশ নিশ্চয়ই সে সুযোগ সাম্রাজ্যবাদী বৈশ্বিক শয়তানের হাতে তুলে দিতে পারে না।
পুরো এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণ ও খবরদারি প্রতিষ্ঠা করার জন্যই এই ব-দ্বীপে অবস্থান পাকাপোক্ত করতে চায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। বিশেষ করে মস্কোভিত্তিক নয়া রাজনৈতিক কেন্দ্র, বেইজিংভিত্তিক নয়া শক্তিশালী অর্থনৈতিক কেন্দ্র, ভারত-বাংলাদেশের মতো উদীয়মান শক্তিশালী অর্থনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে না পারলে বিশ্ব রাজনীতি-অর্থনীতি-সামরিক ক্ষেত্রে মার্কিনীদের মোড়লিপনা চ্যালেঞ্জের মুখে থাকবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক যুগের অবসানের পর থেকেই পুরো বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামরিক ক্ষেত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। একের পর এক দেশ দখল করে নয়া উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত করেছে তারা। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী বৈশ্বিক যুদ্ধ’-এর মোড়কে তারা দেশগুলোর মানুষের উপর অমানবিক যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। অথচ আল কায়েদা থেকে শুর” করে হালের ইসলামিক স্টেট (আইএস) তাদেরই সৃষ্টি। চোরকে চুরি করতে বলে চোরের হাত থেকে রক্ষার নামে গৃহস্থের ঘর দখলের রাজনীতি এখন মার্কিন মোড়লদের রাজনৈতিক অস্ত্র। কিন্তু সম্প্রতি সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যে আইএস দমনের নামে দেশ দখলের উপনিবেশবাদী চক্রান্তের বির”দ্ধে বাধা হয়ে দাঁড়ায় রাশিয়া। সিরিয়ার আসাদ সরকার উৎখাত না করে বরং ওই সরকারকে সহযোগিতার নীতিতে আইএস দমনে এগিয়ে আসে দেশটি। এর মধ্যদিয়ে বৈশ্বিক রাজনীতিতে মার্কিনীদের একক আধিপত্য কিছুটা হলেও ক্ষুণœ হয়। অন্যদিকে চীনের মতো অপর বৃহৎ সামরিক শক্তির দেশও এই প্রশ্নে মার্কিনীদের খুব একটা মিত্র হিসেবে কাজ করছে না। আর বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চীন তো রীতিমতো মার্কিনীদের চ্যালেঞ্জই করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বশংবদ বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এডিবি’র এর মতো সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বির”দ্ধে ব্রাজিল-রাশিয়া-ভারত-চীন-দক্ষিণ আফ্রিকার নেতৃত্বে ব্রিকস ব্যাংক এবং চীনের নেতৃত্বাধীন এশিয়ান ইনফ্রাসট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ দুটি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ব অর্থনীতিতে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এডিবিকে চ্যালেঞ্জ জানাবে। ভারত-বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো শুর” থেকেই নতুন এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশসহ অপর ১০টি দেশ ভবিষ্যতের বৈশ্বিক অর্থনীতির নয়া শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। এ দেশগুলোকে একত্রে ‘নেক্সট ইলেভেন’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে এই অঞ্চলে খুব একটা স্বস্তিতে নেই মার্কিনীরা। ফলে এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের নয়া কেন্দ্র স্থাপন তাদের জন্য অতীব জর”রি হয়ে পড়েছে। ভূ-অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে সেই কেন্দ্র স্থাপন করতে পারলে মার্কিনীদের জন্য কাজটা সহজ হবে।
সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের ভূমিতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনা মার্কিনীদের বেশ পুরনো। কিন্তু এখনো পর্যন্ত খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারে নি তারা। বরং সাম্প্রতিক সময়ে বর্তমান সরকারের হাতে কয়েক দফা হেনস্থাই হতে হয়েছে। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল এবং দোষী সাব্যস্ত হওয়া শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদন্ড ঠেকাতে মার্কিনীদের শেষ চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। অপরদিকে পদ্মা সেতুতে কল্পিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মার্কিন বশংবদ বিশ্বব্যাংক যখন অর্থায়ন বন্ধের ঘোষণা দেয়, তখন সাম্রাজ্যবাদী অর্থলগ্নীকারী ওই প্রতিষ্ঠানের গালে থাপ্পড় মেরে সম্পূর্ণ নিজের টাকায় পদ্মাসেতু নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে শেখ হাসিনার সরকার। এছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন মার্কিনীদের বিরোধী ভূমিকার কথা এবং পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পিছনে তাদের ভূমিকার কথাও সর্বজনবিদিত। আগে বাংলাদেশের সরকার ও ক্ষমতাসীনরা ‘ভাসুর’ জ্ঞানে মার্কিনীদের নাম মুখে না আনলেও এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুর” করে সরকারের একাধিক মন্ত্রী ওইসব ঘটনার জন্য মার্কিনীদের দায়ী করে সরাসরি বক্তৃতা করে থাকেন হামেশাই। শুধু তাই নয়, নানা সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মার্কিনীদের কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত অযাচিত হস্তক্ষেপ ভালো চোখে দেখছে না ঢাকা। এসবের প্রকাশও মন্ত্রীদের কথাবার্তায় পরিষ্কার। কিন্তু বাংলাদেশের ভূমি ও বন্দর যে মার্কিনীদের খুব দরকার! তাই বসে না থেকে ভিন্ন পথেই তারা এগোচ্ছে।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্ম ও বিস্তার নতুন নয়। কিন্তু সম্প্রতি তার রূপের বিবর্তন ঘটেছে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা এবং উগ্র ধর্মান্ধতার রূপ নিয়ে গুপ্তহত্যার মতো ভয়াবহ জঙ্গিবাদী রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ত্রিশেরও বেশি মানুষকে গুপ্তহত্যার শিকার হতে হয়েছে। এদের মধ্যে মুক্তচিন্তার চর্চাকারী তর”ণ থেকে শুর” করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা ভিন্ন মতাবলম্বীরাও। এমনকি রয়েছেন বিদেশি নাগরিকরাও। এসব হত্যাকান্ডের পর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি ওয়েবসাইট ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স’ থেকে জানানো হয়- এসব হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করেছে আইএস বা আল কায়েদা ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা (একিউআইএস)। অন্য কোথাও আইএস বা একিউআইএস এর দায় স্বীকারের বার্তা পাওয়া না গেলেও পাওয়া যায় সাইট ইন্টেলিজেন্স-এর ওয়েবসাইটে। এই ওয়েবসাইটের প্রধান রিটা কাৎজ নামের এক নারী। ইরাকের একটি ইহুদি পরিবারে এই নারীর জন্ম। ১৯৬৭ সালে ৬ দিনব্যাপী আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর রিটার বাবাকে ইসরাইলের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেফতার করে অর্ধলক্ষ লোকের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর রিটার মা তিন সন্তান নিয়ে ইসরাইলে পালিয়ে যান এবং সেখানেই রিটা বড় হন। পরে রিটা কাৎজ ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বিভাগে চাকরি করেন। ফলে তার নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পরিচালিত সাইট ইন্টেলিজেন্স নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ থেকেই যায়।
তবে একথা সত্য যে, বাংলাদেশে উগ্র সশস্ত্র সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের বিকাশ ঘটেছে। সরাসরি তাদের সাথে আইএস বা একিউআইএস এর সম্পৃক্ততা না থাকলেও আদর্শগতভাবে তারা একই। বাংলাদেশে জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ বা আনসার”ল্লাহ বাংলা টিমের মতো জঙ্গি সংগঠন আছে। তারাই যে এসব গুপ্তহত্যাসহ ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করছে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এসব জঙ্গিগোষ্ঠীর পিছনে ছাতার মতো আশ্রয় নিয়ে আছে যুদ্ধাপরাধের দল জামাতে ইসলাম। জামাত যখন বিএনপি’র সাথে জোট করে ক্ষমতার ভাগিদার ছিলো, ওই আমলেই এসব জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। আর গণতান্ত্রিক রাজনীতির নামে বিভিন্ন সময়ে জামাত-বিএনপির সহিংসতা ও মানুষ হত্যার মিশনকে বারবার প্রকাশ্যেই সমর্থন করে এসেছে ওয়াশিংটন। তারা এমনকি জামাতের মতো জঙ্গিবাদী যুদ্ধাপরাধীদের দলকেও ‘মডারেট মুসলিম ডেমোক্রেট’ দল হিসেবে সনদ দিয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের আমলের শুর” থেকে জঙ্গিবাদের বির”দ্ধে কঠোর অবস্থান দেখা যায়। যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নেও শেখ হাসিনার সরকার আপোসহীন অবস্থান গ্রহণ করে। ফলে বাংলাদেশের সরকারের সাথে এসব বিষয়ে পেরে না উঠে এখানে সন্ত্রাসবাদের বিস্তারের দিকেই মনোযোগ দেয় ওয়াশিংটন। এখানে ধর্মান্ধ সন্ত্রাসবাদের প্রধান ধারক যে জামাত, সেই জামাতকেই পৃষ্ঠপোষকতা দান এবং সহিংস রাজনীতির ধারক জামাত-বিএনপির জন্য গণতান্ত্রিক স্পেস আদায়ের লক্ষ্যে ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক তৎপরতা বিশেষভাবে হিসাবে নেওয়া প্রয়োজন। এ থেকেই পরিষ্কার যে, সন্ত্রাসবাদের ফাঁদে বাংলাদেশকে জড়িয়ে ফেলতে ওয়াশিংটন কর্তৃপক্ষ তীব্রভাবেই মরিয়া। এখানে সন্ত্রাসবাদের উপস্থিতি প্রমাণিত। এখন তাকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের রূপ দিতে পারলেই ওবামা প্রশাসনের উদ্দেশ্য সফল। তাদের পরের টার্গেট হবে তথাকথিত সন্ত্রাসবাদবিরোধী বৈশ্বিক যুদ্ধের লক্ষ্য হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করা। সে কারণেই সাইট ইন্টেলিজেন্সের দৃশ্যপটে আগমন বলে মনে করা হয়।
এদিকে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করতেই উদগ্রিব ওয়াশিংটন। বাংলাদেশের চারপাশের বিশাল বিস্তৃত এলাকা নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম, মেঘালয়সহ বড় সীমান্ত। আর দক্ষিণের এক কোণে মায়ানমার অবস্থিত। মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিপুল সংখ্যক মানুষ অবৈধভাবে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল ও কক্সবাজারের সীমানা পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে বহুবছর ধরে। একথা ঠিক যে মায়ানমারের সদ্য সাবেক জান্তা সরকার তাদের উপর ব্যাপক অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে এবং সদ্য ক্ষমতা নেওয়া অং সান সু চি’র সরকারও তাদের ব্যাপারে সুবিচার করছে না। তবে এও ঠিক যে এই অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মাদক ব্যবসার মতো অপরাধ থেকে শুর” করে আন্তর্জাতিক অস্ত্র ব্যবসা এবং উগ্র সন্ত্রাসবাদী নানা গোষ্ঠীর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। তারা কার্যত এখন বাংলাদেশের ঘাড়ে বিপদ হিসেবে চেপে বসে আছে। আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদের যোগসূত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে এদের অবদান কম নয়। এদের সাথে জামাত-বিএনপির ঘনিষ্ঠতাও বিদিত।
অন্যদিকে ভারতের আসাম, মেঘালয়, মিজোরামসহ সাত রাজ্যের (সেভেন সিস্টারস) বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী বাংলাদেশের পঁচাত্তর-পরবর্তী তথাকথিত জাতীয়তাবাদী কার্যত সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী সরকারগুলোর সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এসেছে। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে দশ ট্রাক অস্ত্র আমদানি, ভারতের সন্ত্রাসবাদী নেতাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আশ্রয়দানসহ বিভিন্ন ঘটনায় তা প্রমাণিত। ১৪ দলের সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসব তৎপরতা বন্ধ হয়। ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী কয়েক নেতাকে গ্রেফতার করে নয়াদিল্লীর হাতে তুলে দেয় ঢাকা। ফলে দিল্লী কর্তৃপক্ষও সেভেন সিস্টারস ইস্যুতে অনেকখানি স্বস্তিবোধ করে। কিন্তু সেখানেও মার্কিনী চক্রান্ত থেমে নেই। বাংলাদেশ সীমান্ত ঘিরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদের যোগসূত্র স্থাপনে তারা যারপরনাই মরিয়া। ত্রিপুরায় বামপন্থী সরকার দীর্ঘদিন ধরে মানুষের আস্থা নিয়ে ক্ষমতায় থাকার ফলে সেখানে খুব একটা পেরে উঠছে না ওয়াশিংটন। তবে পশ্চিমবাংলায় তারা অনেকখানি সফল। সেখানে সাড়ে তিন দশকের বামফ্রন্ট সরকারকে হঠিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার ক্ষমতায় আসে ২০১১ সালে। আর সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তাদের সে ক্ষমতা আরো সংহত হয়েছে। পশ্চিমবাংলার এ দুইবারের নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক ইস্যু বিরাট ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। মুসলিম ও হিন্দু মৌলবাদের মধ্যে এক অদ্ভুত ঐক্য সেখানে রচিত হয়েছে মমতা ব্যানার্জীর আঁচলের নিচে। আর ওখানকার নির্বাচনে মার্কিনীদের টাকার খেলাও মঞ্চস্থ হয়েছে বলে মনে করা হয়। মমতার প্রথম সরকারের আমলে বাংলাদেশের জামাতসহ জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা সেখানেও বিকশিত হয়। তৃণমূল দলীয় সাংসদ ইমরান আহমেদের সরাসরি আশ্রয়ে জামাত ও জঙ্গি গ্রুপগুলো বর্ধমানসহ পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘাঁটি গাড়ে। সেখানে বাংলাদেশের জঙ্গিরা বোমা বিস্ফোরণের মতো ঘটনাও ঘটায়। মমতার বাংলাদেশবিরোধী আচরণের প্রকাশও আর গোপন নয়। এবার ভোটে জিতে মমতা যে মন্ত্রিসভা গড়েছেন তার সদস্য আছেন সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর মতো কট্টর মুসলিম মৌলবাদী নেতাও। এই সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর নেতৃত্বেই সেখানে হাসিনা সরকার বিরোধী মিছিল হয়। তার জামাত সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও মিথ্যা নয়। পশ্চিমবাংলার মমতা সরকার বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে মাথাব্যাথার কারণ হবে। আর আসামে দীর্ঘদিনের কংগ্রেস সরকারকে পরাস্ত করে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। সেখানকার নতুন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব প্রদর্শন করেছেন নির্বাচনের আগে-পরে। আসামের সর্বানন্দ সনোয়ালের নেতৃত্বাধীন সরকারের আমল তাই বাংলাদেশের জন্য কাঁটা হয়েই বিঁধে থাকবে।
এদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তার সুযোগ নিতে বরাবরই মরিয়া পাকিস্তান। দেশটির সরকার ও সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই সবসময়ই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসবাদের সাথে দৃঢ় ও মজবুত যোগসূত্র রক্ষা করে এসেছে। সাম্প্রতিককালে এই যোগসূত্র দিয়েই এখানে গুপ্তহত্যার মতো সন্ত্রাসবাদী কাজের অঙ্ক মেলানো হয়েছে বলে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সূত্র জানাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদের এই যোগসূত্র ঠেকাতে বাংলাদেশ সরকারকে সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের বির”দ্ধে কঠোর অবস্থান ধরে রাখতে হবে। কিন্তু সে পথে মাঝেমাঝেই আপোসের হাতছানি গ্রাস করে। স্থানীয় ভোটের রাজনীতির মোহময় অঙ্ক ক্ষমতাসীন জোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগকে প্রায়শই মোহাবিষ্ট করে। হেফাজতে ইসলামের মতো সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সাথে সাময়িক আপোসের উদ্যোগ কঠোর অবস্থান থেকে সরকারের বিচ্যুতি হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়। অপরদিকে সৌদি আরবের সাথে সামরিক জোট গঠন বা ওই জোটে যোগ দেওয়ার মতো ভুল কূটনৈতিক পদক্ষেপও গ্রহণ করে সরকার। অন্যসব বাদ দিলেও বৈশ্বিক রাজনীতি ও দখলবাজিতে সৌদি আরব হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষিত বন্ধু ও নিকটতম মিত্র। সেই সৌদি সামরিক জোটে যোগদান বাংলাদেশের জন্য নিশ্চয়ই সুখবর হতে পারে না।
বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে এখন যেভাবে আন্তর্জাতিক যুদ্ধ চক্রান্ত পরিচালিত হচ্ছে, তাতে স্বল্প অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির অধিকারী দেশ বাংলাদেশের সরকারকে নিশ্চয়ই সতর্কতার সাথে প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলতে হবে। তবে তা হবে অত্যন্ত দৃঢ় ও বলিষ্ঠ। সাময়িক কোনো আপোসের চেষ্টা এই পথ থেকে একটানে খাঁদে নামিয়ে দিতে পারে। তাই সাম্প্রদায়িকতার সাথে আপোসহীন যুদ্ধ অবিরাম জারি রাখতে হবে। কারণ যদি অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় ঢাকা ব্যর্থ হয়, তবে ওয়াশিংটন ওঁৎ পেতে বসে আছে তাকে আন্তর্জাতিক রূপ দেবার জন্য। সে লক্ষ্যে তারা সফল হতে পারলেই ভয়াবহ বিপদের মুখে পড়বে বাংলাদেশ। একই সাথে আন্তর্জাতিক মিত্র নির্ধারণেও ক্ষণিকের ভুলনীতি সাম্রাজ্যবাদী ওই যুদ্ধবাজ দখলবাজদেরকেই শক্তি জোগাবে। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে বাংলাদেশ ঋজু ও দৃঢ় থাকবে- এমন আশাবাদ দেশের মানুষের।
মন্তব্য করুন