বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের উদ্যোগে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে তিন দিন ব্যাপী ‘হারমোনি ফেস্টিভ্যাল’ শুরু
এস এম উমেদ আলী : বিভিন্ন জাতিসত্তা ও সম্প্রদায়ের নিজস্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী নৃত্য,গান ও আকর্ষণীয় মেলার মধ্য দিয়ে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে উদ্বোধন হয়েছে তিন দিনব্যাপী হারমোনি ফেস্টিভ্যাল।
পর্যটন শিল্পকে বিকশিত করতে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড এর উদ্যোগে চায়ের রাজধানী খ্যাত দেশের অন্যতম পর্যটন এলাকা মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে প্রথমবারের মতো শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী ‘হারমোনি ফেস্টিভ্যাল’। এতে অংশ নিচ্ছে মনিপুরী, খাসিয়া, চাকমা, চা শ্রমিক, গারো, সাঁওতাল, ত্রিপুরা, খাড়িয়া সহ ২৬টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধি ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ।
শুক্রবার ১০ জানুয়ারি বিকেল ৪টার বিটিআরআই সংলগ্ন কাকিয়াছড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে হারমোনি ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টার মূখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া।
বাংলাদেশ টুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী আবু তাহের মো: জাবের এর সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রনালয়ের সচিব মিজ নাসরীন জাহান, সিলেট বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার খান মো: রেজাউন নবী, মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো: ইসরাইল হোসেন, এসএমই ফাউন্ডেশন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদর্শন কুমার রায় প্রমূখ।
প্রথম দিন থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বিপুল সংখ্যা পর্যটকসহ সাধারণ মানুষের উপস্থিত জমে উঠে হারমোনি ফেস্টিভ্যাল। ফেস্টিভ্যালের তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরে ৪৪টি প্রদর্শনী ষ্টলের পাশাপাশি থাকছে বাঙালির পিঠা পুলি ও খাবারের ষ্টল।
প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড এই মেলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মেলার অন্যতম আয়োজক শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ ইসলাম উদ্দিন। তিনি বলেন, পর্যটনশিল্প আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে বহন করছে, আমরা এই শিল্পের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে চাই, তাই ট্যুরিজম বোর্ডের তিনদিনব্যাপী ‘হারমোনি ফেস্টিভ্যাল’ মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
মেলায় ৪৪টি স্টলের মাধ্যমে তাদের উৎপাদিত পণ্য, খাবার, জীবনাচার, পোশাক ইত্যাদি এছাড়াও তাদের সংস্কৃতি, নাচ-গান, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের বিষয়াদি প্রথম দিনে মঞ্চে পারফরমেন্স করেন।
এছাড়াও খাসিয়া জনগোষ্ঠীর পান নিয়ে পরিবেশনা, ত্রিপুরাদের কোমর তাঁত, মণিপুরীদের লাইভ তাঁত, চা ও রাবার প্রসেসিং, হোমস্টে, কুমারদের লাইভ মাটির জিনিসপত্র উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ।
শুক্রবার সকাল থেকেই উৎসবে আসতে থাকে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লোকজন। পায়ে আলতা, বাহারি রঙের শাড়ি, খোঁপায় ফুল পরিধান করে নারীরা নাচ ও গানে মুখর করে তোলেন চারপাশ। সঙ্গে ঢোল-করতাল-মাদল বাজিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্বে অংশ নেন পুরুষরাও। প্রথম দিনে পাঁচটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ নিজেদের ঐতিহ্য তুলে ধরেন এই উৎসবে।
আয়োজকরা জানান, শ্রীমঙ্গল বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন গন্তব্য, যেখানে টি ট্যুরিজম, ওয়াইল্ড লাইফ ট্যুরিজম, ব্যাক ওয়াটার ট্যুরিজম, ইকো ট্যুরিজমসহ বিভিন্ন ধরনের পর্যটন বিকাশের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে আগত ইন বাউন্ড ট্যুরিস্টদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রতিবছর শ্রীমঙ্গল এবং সংলগ্ন এলাকায় ভ্রমণ করে থাকেন। হারমোনি ফেস্টিভ্যাল এ অঞ্চলে বিদ্যমান ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, জীবনাচরের টেকসই রূপদান, ট্যুরিস্টদের অনন্য অভিজ্ঞতা প্রদান এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের নতুন ট্যুরিজম প্রডাক্ট উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
যে সব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অংশ গ্রহনে ‘হারমোনি ফেস্টিভ্যাল’ আরও আকর্ষনীয় উঠে তারা হলো-খাসিয়া, গারো, মণিপুরি, ত্রিপুরা, সবর, খাড়িয়া, রিকিয়াসন, বাড়াইক, কন্দ, রাজবল্বব, ভূঁইয়া, সাঁওতাল, ওঁরাও, গড়াইত, মুন্ডা, কুর্মী, ভুমিজ, বুনারজি, লোহার, গঞ্জু, কড়াসহ শ্রীমঙ্গল ও সংলগ্ন এলাকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ অংশ নিচ্ছে। তিন দিনব্যাপী উৎসবে সবর জনগোষ্ঠী ‘পত্র সওরা নৃত্যথ ও ‘চড়ইয়া নৃত্যথ, খাড়িয়া জনগোষ্ঠী ‘খাড়ি নৃত্যথ, রিকিয়াসন জনগোষ্ঠী ‘লাঠি নৃত্যথ, বাড়াইক জনগোষ্ঠী ‘ঝুমুর নৃত্যথ, কন্দ জনগোষ্ঠী ‘কুই নৃত্যথ, রাজবল্বব জনগোষ্ঠী ‘উড়িয়া নৃত্য, ভূঁইয়া জনগোষ্ঠী ‘ভূঁইয়া গীতথ, সাঁওতাল জনগোষ্ঠী ‘লাগড়ে নৃত্য, ওঁরাও জনগোষ্ঠী ‘ওঁরাও নৃত্যথ, গড়াইত জনগোষ্ঠী ‘গড়াইত নৃত্যথ, মুন্ডা জনগোষ্ঠী ‘মুন্ডারি নৃত্যথ, কুর্মী জনগোষ্ঠী ‘কুরমালি নৃত্যথ, ভূমিজ জনগোষ্ঠী ‘ভূমিজ নৃত্যথ, বুনারজি জনগোষ্ঠী ‘উড়িয়া ভজনথ, লোহার জনগোষ্ঠী ‘ভুজপুরি রামায়ণ কীর্তন, গঞ্জু জনগোষ্ঠী ‘গঞ্জু নৃত্য, কড়া জনগোষ্ঠী ‘কড়া নৃত্য, ‘খাসি জনগোষ্ঠী ‘ঐতিহ্যবাহী পোশাক ডিয়া কেরছা ও মালা পরিধানের মাধ্যমে নাচ-গান, ‘তীর-ধনুক প্রতিযোগিতা, ‘সিয়াট বটুর (গুলতি দিয়ে খেলা), ‘কিউ থেনেং (তৈলাক্ত বাঁশে ওঠার প্রতিযোগিতা), ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী ‘কাথারক নৃত্য, ‘বেসু নৃত্য, ‘জুম নৃত্য, ‘গ্যারি পুজা, ‘ক্যার পুজা, ‘নক থাপেং মা পুজা, ‘কাদংথ (রনপা), গারো জনগোষ্ঠী ‘জুম নৃত্য, ‘আমোয়দেব (পুজা), ‘গিক্কা নাচ (মল্লযুদ্ধ), ‘চাওয়ারি সিক্কা (জামাই-বউ নির্বাচন), ‘চাম্বিল নাচ (বানর নৃত্য), ‘মান্দি নাচ, ‘রে রে গান, ‘সেরেনজিংথ (প্রেম কাহিনীর গান), মণিপুরি জনগোষ্ঠী ‘রাসলীলা নৃত্য, ‘পুং চলোম নৃত্য (ঢোল নৃত্য), ‘রাধাকৃষ্ণ নৃত্য এবং সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ধামাইল নৃত্য প্রদর্শন করা হবে। এছাড়া ‘খাসি জনগোষ্ঠীর পান নিয়ে লাইভ পরিবেশনা, ত্রিপুরাদের কোমর তাঁত, মণিপুরিদের লাইভ তাঁত, চা ও রাবার প্রসেসিং, হোমস্টে, কুমারদের লাইভ মাটির জিনিসপত্র প্রস্তুত করাসহ বিভিন্ন ইভেন্ট থাকবে।
হারমোনি ফেস্টিভ্যালে শনি ও রোববার সকাল ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলবে এসব নৃ-গোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
মন্তব্য করুন