বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর সাবেক পরিচালক-লেখক সৈয়দা হাফসা আলমগীরের আকস্মিক ও অকাল ইন্তিকাল: সম্মান: স্মরন: মাগফিরাত

October 12, 2017,

মুজিবুর রহমান মুজিব॥ আদমে আওলাদ-উম্মতে মোহাম্মদী (দঃ) আশরাফুল মকলুখাত মানবসন্তান গনের মৃত্যো অবধারিত ও চীরন্তন। আমাদের মহান ¯্রষ্টাও প্রতিপালক- দোজাহানের খালিক মালিক আল্লাহ পাক আল কোরআনে তাই যথার্থ-ই- বলেন- কুল্লিন নাফসিন জ্যায়িকাতুল মউত-। মানুষের মৃত্যো শাস্বত সত্য হলেও অসময়ের অস্বাভাবিক মৃত্যো মূর্দার স্বজনগন সহজে মেনে নিতে পারেন না-আকুল কান্নায় ব্যাকুল হন- আফসোস আহাজারি করেন। এমনি আকস্মিক ভাবেই চলে গেলেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর সাবেক পরিচালক-সুলেখক সৈয়দ হাফসা আলমগীর। মাত্র ষাটের কোঠায় এসে সুস্থসবল শরীর ও মন নিয়ে শিশু একাডেমীর উচ্চ পদস্থ পদ থেকে অবসর নিয়ে লেখালেখি সমাজ সেবাও ধর্ম কর্ম নিয়েই সময় কাটাচ্ছিলেন সুশীলা নারী, পর্দা পুসিদার অনুসারি ফরেজগার সৈয়দা হাফসা আলমগীর। গত আটই অক্টোবর রোববার সকাল ন’টায় মোবাইল মারফত দূঃ সংবাদটি জানালেন ঢাকা প্রবাসী অগ্রজ প্রতিম কাজি ফারুকুজ্জামান আহমদ। শ্রদ্ধেও ফারুক ভাই নিজেও অসুস্থ। শয্যাশায়ী। পরিনত বয়সে সুস্থাবস্থায় তিনি আত্বীয় স্বজন দূঃস্থজন দেকভাল ও সামাজিক দায় দায়িত্বই পালন করেন। বর্ত্তমানে নিজেই অচল। চীরস্থায়ী সোফা-শায়ী। কাজি ফারুক ভাই তাই মৃত্যো সংবাদ ছাড়া কোথায় কবে কিভাবে দাফন কাফন হবে তা জানাতে পারলেন না। আমার কাছে সৈয়দা হাফসার জন্য দোয়া চাইলেন। আমি বিস্তারিত জানার জন্য ফিল্ম সেন্সর বোর্ড এর অবসরপ্রাপ্ত সচিব ভ্রাতৃপ্রতিম আব্দুর রৌফ এর কাছে ফোন করি। ঢাকাবাসি ভাই আব্দুর রৌফ আজীবন তথ্য মন্ত্রনালয়ে চাকরি করেছেন। আজীবন সত্য পথে চলে তিনি আমাদেরকে সব সময় সঠিক তথ্যই পরিবেশন করেছেন। রৌফ ভাই সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিলেও সমাজ কর্ম্ম জীব থেকে অবসর নেননি। ঢাকাস্থ ইউ.এন্ড.টি ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ডেপুটি ডাইরেক্টরের গুরু দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। সৈয়দা হাফছা আলমগীরের আকস্মিক মুত্যো এবং তার চাকরি ও পারিবারিক জীবনের কিছু তথ্য দিলেন একালীন তথ্য অফিসার আবদুর রৌফ। তিনি তার চাকরি জীবনের মধ্যে ভাগে সৈয়দা হাফসা আলমগীর এর জন্ম ও পিতৃভূমি মৌলভীবাজারে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদ মর্যাদায় চাকরি করেছেন। সৈয়দা হাফসা আলমগীর এর ভগ্নিপতি সিলেটি মামুন দুলাভাই তথ্য মন্ত্রনালয় এর আওতাধীন বাংলাদেশ বেতারে চাকরি করতেন। এতদসংক্রান্ত বহুবিধ কারনে সদ্য প্রয়াত সৈয়দা হাফসা আলমগীরের পরিবারবর্গের সঙ্গে পরিচিতি ও সম্পর্ক ছিল। আছেও। আমি নিজে বার্ধক্য জনিত বহুবিধ ব্যাধি এবং সাম্প্রতিক পা-এ্যকসিডেন্টের কারনে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরায় সচল নই, তাই তার জন্য দোয়া ছাড়া কিছু করার নাই। আমার খুবই প্রিয়জন সদ্য প্রয়াত সৈয়দা হাফসা আলমগীর এর রুহের মাগফিরাত কামনা করি, মরহুমার শোক সন্তপ্ত পরিবার বর্গের প্রতি গভীর সমবেদনাও সহানুভূতি জ্ঞ্যাপন করছি।
ষাটের দশকের শুরুতে দক্ষিন সিলেটের তৎকালীন মৌলভীবাজার মহকুমা ছিল একটি ছিম ছাম পরিচ্ছন্ন শহর। চাকচিক্যময় আলো ঝলমল বৈদ্যুতিক বাতি ছিলনা সন্ধ্যা নামলে টাউন কমিটির পক্ষ থেকে শহরের প্রধান প্রধান রাস্থায় তেলের বাতি জ¦ালিয়ে দিতেন পৌর কর্ম্মচারীগন। সন্ধ্যা নামলেই আঁধার নেমে এলেও মানুষের মন ছিল আলোকিত। ঝলমল- যা এখন লাল নীল রঙ্গীঁন বাতিতেও নেই।
ঐ সময় ও দশকে মৌলভীবাজার কলেজের ছাত্র ছিলাম। স্বচ্ছল পরিবারের পিতা মাতার প্রথম পুত্র সন্তান হিসাবে মা বাবার মায়া মমতা অধিক ছিল। তাদের কোন দাবী ছিলনা- না চাকরি বাকরি না ব্যবসা বানিজ্য- শুধু একটাই চাওয়া ছিল দেশের সকল ডিগ্রি নিয়ে মানুষের মত মানুষ হওয়া। ফলতঃ মনের আনন্দে হাওয়ায় উড়ে কর্ম্ম কান্ডে, লেখালেখি সাংবাদিকতায় সম্পৃক্ত হই। লেখালেখি ও গান বাজনায় আমার সহচর বন্ধু ছিলেন আজিজুল হক ইকবাল (কে.এ. হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। অকাল প্রয়াত) আমরা সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিতান, স্বরবর্ন সহ বিভিন্ন সাহিত্য সংঘটন গঠন করে -প্রদীপ- নামে পত্রিকা বের করতাম। মেয়েদের মধ্যে সৈয়দা হাফসা বেগম, সুলতানা বেগম ইলা ছাড়া লেখালেখিতে উৎসাহী কারো নাম এখন আর মনে পড়ছে না। ছাত্রলীগের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিতে আমার হাতে খড়ি। ৬২ সালে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্টার লক্ষ্যে গোপন সংঘটন -নিউক্লিয়াস- গঠন করেছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা সিরাজুল খাঁন-দাদা। তাঁর ভক্ত ছিলাম। (এখনও আছি) ছাত্রলীগ কর্মি থেকে আমি ঐ দশকের শেষ ভাগে প্রথমত: কলেজ শাখা ছাত্রলীগ অতঃপর মহকুমা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলাম। তখন সমগ্র মৌলভীবাজার মহকুমায় একটিই কলেজ। সকল থানা থেকে বিপুল পরিমান ছাত্র ছাত্রী এসে এই কলেজে লেখাপড়া করতেন। তখন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন এই দুটিই ছিল প্রধান ছাত্র সংঘটন। ছাত্র ইউনিয়নে ছাত্রীদের সংখ্যা ছিল বেশি। যতদূর মনে পড়ছে সৈয়দা হাফসা বেগম, মীনা চৌধুরী এবং গির্জা পাড়ার আরেক মরহুম পুলিশ অফিসারের কন্যা মায়া বেগম ছাড়া ছাত্রলীগে ছাত্রী নেত্রী খুব একটা ছিলেন না। ছাত্রী মহলে ছাত্রলীগ সংঘটনে সৈয়দা হাফসা বেগমের প্রসংশনীয় ও গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় হয়ত কোন দিনই লেখা হবেনা কিন্তু আমাদের প্রজন্মের মনে থাকবে চীরকাল।
মৌলভীবাজার শহরস্থ সৈয়দ শাহ মোস্তফা সড়কের -মতি মঞ্জিল- একটি খান্দানী ও অভিজাত বাড়ি। টিনের চৌ চালা আকর্ষনীয় বাংলো গৃহ গাছ গাছালি বৃক্ষ রাজির অপরূপ সমাহার এস.এম আলী নেমপ্লেট লাগানো অভিজাত ও রুচিসম্মত বাসা বাড়িতে। এই বসত গৃহের মালিক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার সৈয়দ মকবুল আলী। রাজনগর উপজেলাধীন কদমহাটা গ্রামের আদি বাসিন্দা। সৈয়দ মকবুল আলী মরহুমের তৃতিয়া কন্যা সৈয়দা হাফসা বেগম। মরহুম আলী এক পুত্র-তিন কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। কন্যত্রয় হলেন সৈয়দা ফাতেমা বেগম, সৈয়দা হাফসা বেগম এবং সৈয়দা রুকেয়া বেগম। একমাত্র পুত্র সন্তান সৈয়দ মতিউর রহমান সানি আমার সহপাঠি ও বিশিষ্ট বন্ধু ছিলেন। অকাল প্রয়াত সানি একজন খ্যাতিমান ইংরেজী ক্রীড়া ভাস্যকার, সাংবাদিক এবং প্রেসক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আমার পৈত্রিক বাসা বাড়ি মুসলিম কুয়ার্টারস্থ রসুলপুর হাউস থেকে শাহ মোস্তফা সড়কস্থ মতি মঞ্জিল কাছাকাছি পাশাপাশি- প্রায় নিকট প্রতিবেশি। ফলতঃ এই পরিবারের সকল সদসের সঙ্গেঁ আমার পরিচয় এবং পারিবারিক সম্পর্ক ছিল।
উজ্জলশ্যাম বা প্রায় ফর্সা চেহারার দিঘাঙ্গিঁনি সৈয়দা হাফসা বেগমের লম্বাটে মুখে একটি অমায়িক মিষ্টি হাসি লেগে থাকত সব সময়। সাধারন সেলোয়ার-কামিজে উগ্র মেকআপ ছাড়াই সুবেশি, মিষ্ট ভাষিনি, বিনয়, সৌজন্যবোধ ও সদাচারনে সকলের প্রসংসা ও দৃষ্টি আকর্ষন করতেন সৈয়দা হাফসা বেগম। তাঁর পর্দা পুষিদা ও ধর্মানুরাগ প্রশংসনীয় অতুলনীয়। ছাত্র রাজনীতি, সমাজ সেবা, ধর্ম কর্মের সাথে সাথে লেখা লেখিতে খুব আন্তরিক ছিলেন সৈয়দা হাফসা বেগম। একজন সংঘঠক হিসাবে আরেক অকাল প্রয়াত সাহিত্য সেবি আমার খুবই প্রিয়জন এবং গুরুপুত্র কাজি ফয়সলুজ্জামান আহমদকে নিয়ে গঠন করেছিলেন শিলাকুড়ি। এই নামে সাহিত্য পত্রিকা বের করতেন সৈয়দা হাফসা বেগম। পাথর সময়ে পাথরে ফুল ফোটাতে চেয়েছিলেন এই সৈয়দ জাদি- পাথরে ফুল ফুটিয়েছিলেনও। সাহিত্য পত্র হিসাবে শিলাকুড়ি ছিল মান সম্মত। মেজাজী। রুচিশীল। পারিবারিক পরিচয় অবস্থান ও মানসম্মান এবং তাঁর গুনাবলির কারনে গুনবতী রমনী সৈয়দা হাফসা বেগম ছাত্র রাজনীতি এবং সাহিত্য কর্ম্মে সমান সুনাম কুড়িয়েছিলেন। আমাকে বড় ভাইর মত ভক্তি সম্মান করতেন। আমিও তাকে ছোট বোনের মত ¯েœহ করতাম। ধর্ম বোন নীহারের ফুফু-বন্ধুবর ইকবালের ফুফু শাশুড়ি হিসাবে বেশ সম্মান করতাম। ৬৮ সালে বিএ পাশ করে আমি পিতা মাতার ইচ্ছা মোতাবেক উচ্চ শিক্ষা গ্রহনের জন্য ঢাকা চলে যাই ভর্ত্তি হই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে। পরবর্তীকালে সৈয়দা হাফসা বেগ ভালো ঘরে ভালো বরে পাত্রস্থ হন। বর আলমগীর সাহেব একজন চাটার্ড একাউন্টেন্ট। আমাদের প্রিয় হাফসা হন সৈয়দা হাফসা আলমগীর। কর্ম্ম জীবনে সৈয়দা হাফসা আলমগীর ছিলেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর পরিচালক। ঢাকা বাসি অগ্রজ কাজি ফারুকুজ্জামান জানালেন তিনি একদিন তাকে দেখা ও খুঁজ খবর নেয়ার জন্য বাংলাদেশ শিশু একাডেমীতে গিয়েছিলেন। অফিসে তার সহকর্ম্মিদের কাছ থেকে পরিচালক হিসাবে হাফসা আলমগীর এর সুনাম শুনেছেন, সহকর্ম্মীগন প্রশংসা করেছেন।
আলমগীর-হাফসা দম্পতি ছিলেন নিঃ সন্তান। এই দূঃখবোধ থেকে হয়ত মনোকষ্ট ছিল সুকন্যা-সুগৃহিনী সৈয়দা হাফসা আলমগীরের। তার হৃদরোগ ছিল। অবশেষে একটি সেবামূলক কাজে যোগদান করে মফস্বলে সফররত অবস্থায় হার্ট এ্যটাক হয় সৈয়দা হাফসা আলমগীরের। এই মায়াময় মাটির পৃথিবীতে তার সময় শেষ। তিনি শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন। ঢাকায়ই তার জানাজা ও দাফন হয়। মহান মালিক তাঁর বেহেশত নসীব করুন- এই মোনাজাত সহ আমীন।
[সিনিয়র এডভোকেট হাই কোর্ট। সাবেক সভাপতি মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব। মুক্তিযোদ্ধা। কলামিষ্ট]

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com