বায়ুদূষণ, মাটি ও প্রকৃতির ক্ষতি করছে ইটভাটা!
নূরুল মোহাইমীন মিল্টন॥ ইটভাটা দেশের বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। একই সঙ্গে তা কৃষি, জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতির ক্ষতি বয়ে আনছে। ফিবছর শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে অত্যধিক বায়ুদূষণ দেখা দিচ্ছে। বায়ু দূষণের জন্য একাধিক কারণ থাকলেও এর একটি বড় কারণ ইটভাটা। ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়া প্রকৃতিকে গ্রাস করছে। রোগবালাই বৃদ্ধি করছে। নিরাপদ চলাচলে শ^াস-প্রশ^াসের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শত শত অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম চলছে। এসব ইটভাটার কারণে বায়ুদূষণ বেড়েই চলেছে।
দেশে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েও খুব বেশি সুফল মিলছে না; বরং অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। পরিবেশ অধিদপ্তর দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করলেও সেগুলো আবার চালু হয়েছে। দেশে চালু অর্ধেকের বেশি ইটভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। দেখভালেরও যেন কেউ নেই। চলছে ইটভাটা আইন অমান্য করে।
ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএইচও) অনুসারে, বায়ু দূষণের ফলে স্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের কারণে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। (ডেইলী স্টার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৩)। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকার বায়ু দূষণের তিনটি প্রধান উৎস হলো-ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলো।
রাজধানীর বায়ুদূষণের জন্য অনেকটাই দায়ী ঢাকার আশপাশের ইটভাটা। নরওয়েভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনআইএলইউর সহায়তায় পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণায় ঢাকা শহরের বায়ুর গুণগত মানের এই চিত্র উঠে এসেছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, এই বাতাস শ^াস নেওয়ার সময় ফুসফুসে ঢুকে পড়ছে। যার কারণে মানুষ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। গবেষণার ফলাফলের বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের এক তথ্যে জানা গেছে, গবেষণা অনুসারে শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা শহরের বস্তুকণা দ্বারা বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা ৫৮ শতাংশ দায়ী। এছাড়া সড়ক ও মাটি থেকে সৃষ্ট ধুলা দ্বারা ১৮ শতাংশ, যানবাহনের জন্য ১০ শতাংশ, বিভিন্ন জিনিসপত্র পোড়ানোর জন্য ৮ শতাংশ ও অন্যান্য কারণে ৬ শতাংশ বায়ু দূষিত হচ্ছে। গবেষণার ফলাফলে পরিবেশ অধিদপ্তর ইট তৈরির অদক্ষ পদ্ধতি ব্যবহার না করে পরিবেশ বান্ধব জ¦ালানি সাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুপারিশ করেছে। তবে এসব সুপারিশ কে শুনবে?
গত মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত চার বছরে প্রায় ১ হাজার ৫শ’ অবৈধ ইটভাটা বেড়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে প্রায় এক হাজার অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করেছে। সেগুলোর ৭৫ শতাংশই আবার চালু হয়ে গেছে। অবশ্য বেসরকারি পর্যবেক্ষণ বলছে, দেশের বেশির ভাগ ইটভাটা নিয়ম বহির্ভূতভাবে চলছে। এসব ইটভাটার কারণে ঘটছে বায়ুদূষণ। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ২০১০ ও ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৩-এ বলা হয়েছে, বসতি এলাকা, পাহাড়, বন ও জলাভূমির এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ইটভাটা করা যাবে না। কৃষিজমিতেও ইটভাটা অবৈধ। অথচ দেশের প্রায় শতভাগ ইটভাটা এই আইন মানছে না।
এমন অনেক ইটভাটা রয়েছে যেখানে নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। তাছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সন্নিকটে, বনাঞ্চল ঘেষা, ঘনবসতি পূর্ণ এলাকা, হাটবাজার ও কৃষিজমির উপর ইটভাটা রয়েছে। ভাটার তপ্ত আগুনে পুড়ছে উর্বর মাটি। কার্বন-ডাই-অক্সাইড মিশ্রিত চতুর্দিকে কালো ধোঁয়ার বিষে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দারা। ফসলি জমির উর্বর মাটি বিনাশ করছে। খাদ্য উৎপাদনেও এর প্রভাব পড়ছে। ইটভাটা শুধু উর্বর মাটি ধ্বংস করছে না; বায়ু, মাটি ও প্রকৃতির স্থায়ী ক্ষতি করছে। স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালীদের মালিকানা ও ছত্রচ্ছায়ায় এসব ইটভাটা চলছে। ফলে অবৈধ হলেও প্রশাসন এদের বিরুদ্ধে তেমন কোন ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
ইটভাটা সমুহের কারনে শিক্ষার্থী, হাটবাজার, লোকালয়ের হাজার হাজার বাসিন্দা প্রতিনিয়ত শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ভাটার ধোঁয়ার কারনে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। চিকিৎসকদের মতে, শ্বাসকষ্ট, কাশি, এলার্জি, নিউমোনিয়া রোগে আক্রমন করে। তাছাড়া ক্রমাম্বয়ে পরিবেশ বিপর্যয়েরও সন্মুখীন হচ্ছে।
দূষণ বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ক্যাপস-এর ‘দেশব্যাপী ৬৪ জেলার বায়ুদূষণ সমীক্ষা ২০২১’ অনুযায়ী, ঢাকার আশেপাশের প্রায় ১২০০টি ইটভাটা, ছোট-বড় কয়েক হাজার শিল্প কারখানা আছে, যেগুলো দূষণের অন্যতম কারণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ ইটভাটা এখনও সনাতন পদ্ধতিতে চলছে। এইসব ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কয়লা, কাঠ ব্যবহার করা হয়। ফলে এটা থেকে প্রচুর ছাই তৈরি হয় এবং কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার অক্সাইড ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো দূষিত কণা বাতাসের সাথে মিশছে। (বিবিসি বাংলা, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩)। বায়ুদূষণ হ্রাস করার লক্ষ্যে ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৯)’ শীর্ষক আইনও গৃহীত হয়। কিন্তু সেই আইনেরও তেমন প্রয়োগ নেই।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশের পরিবেশ সমীক্ষা প্রতিবেদন ২০২৩ অনুযায়ী, বৃহত্তর ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস ইটভাটা। ঢাকায় রান্নার চুলায় ব্যবহৃত জৈবসামগ্রী যেমন কাঠ, পাতা, গোবর ও জ্বালানি থেকে আসে বায়ুদূষণের ২৮ শতাংশ। এ ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২৪ শতাংশ, ইটভাটা থেকে ১৩ শতাংশ, রাস্তার ধুলা থেকে ১৩ শতাংশ, শহরের বর্জ্য পোড়ানো থেকে ১১ শতাংশ এবং যানবাহন থেকে ৫ শতাংশ দূষণ হয়। অন্যান্য উৎস থেকে বাকি ৬ শতাংশ দূষণ ঘটে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে মোট ৭ হাজার ৮৬টি ইটভাটা চালু আছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৫০৫ ইটভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। এসব ইটভাটায় বছরে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ ইট তৈরি হচ্ছে। এসব ইটভাটার বছরে ১৩ কোটি মেট্রিক টন মাটি লাগে। মূলত কৃষিজমির ওপরের উর্বর অংশ কেটে ইট তৈরি করা হচ্ছে। অধিকাংশ ইটভাটার কারণে কৃষিজমির ফসলের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি আশপাশের বাসিন্দাদের নানা স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে মাত্র ১৫১টি ব্লক ইটের কারখানা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামে হয়েছে ৮৮টি কারখানা। এসব কারখানা দেশের ইটের চাহিদার ৫ শতাংশও মেটাতে পারছে না। (প্রথম আলো, ৩০ জানুয়ারি-২০২৪)।
তবে বর্তমান নতুন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী গত মাসে ১০০ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, এ সময়ের মধ্যে ৫০০টি অবৈধ ইটভাটা ভাঙা হবে। পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ইটভাটা ১২০ ফুট চিমনিবিশিষ্ট সনাতন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারবে না। সরকার ২০১২ সালে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি নেই, এমন ইটভাটা ২০১৫ সালের পর বন্ধ করার ঘোষণা দেয়। এর পরের বছর থেকে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়।
এর আগে ২০২০ সালের নভেম্বরে পরিবেশ অধিদপ্তর দেশের অবৈধ ইটভাটার একটি তালিকা করে। তাতে উল্লেখ করা হয়, দেশে প্রায় ৮ হাজার ইটভাটা রয়েছে, যার মধ্যে ৩ হাজার অবৈধ। অবৈধ ইটভাটার মধ্যে ঢাকার আশপাশের ১২টি শহরে রয়েছে ১ হাজার ২৪৬টি। গত দেড় বছরে সারা দেশে মাত্র ৭৩৭টি ইটভাটা বন্ধ করা হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান করে থাকে। তবে মাঝে মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের লোক দেখানো অভিযানও পরিচালিত হয়। মূলত ইটভাটার চিমনির একাংশ ভেঙে দিয়ে ইটের উৎপাদন বন্ধ করে অভিযান শেষ করা হয়। আবার কিছু কাঁচা ইট বিনষ্ট করে চলে যায়। সরকারি কর্মকর্তারা চলে যাওয়ার কিছু সময়ের মধ্যে তা আবার চালু হয়ে যায়।
পোড়া ইটের বিকল্প পণ্যের ব্যাপারে সরকার উৎসাহ দিচ্ছে। চিমনিতে পোড়ানো ইটের বদলে ব্লক ইট বানাতে সরকারি-বেসরকারি কারখানার প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ২০১৫ সালে সরকারি সব নির্মাণকাজে (সড়ক ছাড়া) শতভাগ ব্লক ইট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে পরিপত্র জারি করা হয়। ২০২৫ সালের মধ্যে তা বাস্তবায়নের সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু অগ্রগতি খুবই সামান্য।
পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবমতে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে মাত্র ১৫১টি ব্লক ইটের কারখানা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামে হয়েছে ৮৮টি কারখানা। এসব কারখানা দেশের ইটের চাহিদার ৫ শতাংশও মেটাতে পারছে না। ইটের চাহিদা মেটানো যেমন প্রয়োজন, তেমনি পরিবেশের সুরক্ষাও প্রয়োজন। মানব স্বাস্থ্যে ঝুঁকি বাড়িয়ে আর প্রকৃতিতে ক্ষতি সৃষ্টি করে কোন কার্যক্রমই যথোপযুক্ত নয়। প্রভাবশালী মহল নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আইনের তোয়াক্কা না করেই অবৈধ ইটভাটার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও এসবে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছে না। তবে নিরাপদ পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার স্বার্থে বায়ু, মাটি ও প্রকৃতির স্বাভাবিকতাকে ফিরিয়ে দিতে হবে। অন্যতায় বায়ু দূষণ, মাটি দূষণ ও প্রকৃতিকে উত্তপ্ত করে তোলার ফল ভালো হবে না।
লেখক : নূরুল মোহাইমীন মিল্টন, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক, মৌলভীবাজার। ই-মেইল : : miltonpress@gmail.com
মোবাইল : ০১৭১৮০৩৪৪১৬
মন্তব্য করুন