“বারোই ডিসেম্বর শিক্ষানুরাগি মহিয়সি রমনী বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরীর ত্রয়োদশ মৃত্যো বাষিকীঃস্মৃতি কথাঃ স্মরনঃ শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুজিবুর রহমান মুজিব: বারোই ডিসেম্বর বৃহত্তর সিলেটের বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগি, সংবাদপত্র সেবী, বিশিষ্ট শিল্পপতি ও সমাজ সেবক আলহাজ্ব সৈয়দ রাগিব আলীর সহ ধর্মিনী, মহিয়সী রমনী বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরীর ত্রয়োদশ মৃত্যোবার্ষিকী। আজ থেকে বারো বছর আগে স্বাধীনতার মাস ডিসেম্বরে স্বামীর সঙ্গেঁ সিলেট অবস্থান করছিলেন স্বামী সোহাগিনী বেগম রাবেয়া। সিলেট এলে মালনী ছড়ার মালকিন বেগম রাবেয়া মালনী ছড়ার মালিক বাংলায় অবস্থান করতেন। এতদাঞ্চলীয় প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী চা বাগান মালনি ছড়ার ক্রয় সুত্রে মালিক হয়ে কর্মবীর আলহাজ্ব রাগিব আলী প্রায় পরিত্যক্ত এই চা বাগানটিকে নিজ মেধা ও মনন ঘামও শ্রমের মাধ্যমে দেশের একটি আদর্শ চা বাগান হিসাবে গড়ে তুলেন। রাগিব-রাবেয়া দম্পতি ছিলেন প্রবাসী। একটি ঐতিহ্যবাহী আধ্যত্বিক পরিবারের কৃতি সন্তান রাগিব আলীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন আরেকটি ঐতিহ্যবাহী খান্দানী পরিবারের কৃতি কন্যা আম্বর খানা পাক্কা বাড়ি নিবাসি ইরফান আলী চৌধুরী সাহেবের সুকন্যা বেগম রাবেয়া। লাভ আফটার ম্যেরেজ এর অপূর্ব উদাহরণ রাগিব-রাবেয়া দম্পতি। সুকন্যা বেগম রাবেয়া নববধু থেকে পরিনত বয়স পর্য্যন্ত ছায়ার মত নীরবে অনুসরন করেছেন প্রিয় জীবন সঙ্গিঁ-কে। কর্মবীর-দানবীর আলহাজ্ব রাগিব আলীর সকল সৃজনশীল কর্মের শুধুমাত্র উৎসাহ ও অনু প্রেরণাই নয় সহধর্মিনী হিসাবে সহকর্মির ভূমিকায়, অবতীর্ণ হয়েছেন। শিক্ষানুরাগি রাগিব আলী উচ্চ শিক্ষার অধিকতর প্রসার-প্রচার এর লক্ষে সিলেটে প্রথম বেসরকারি ভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেন লিডিং ইউনিভার্সিটি সিলেট। ফাউন্ডার চেয়ারম্যান ডক্টর রাগিব আলীর সঙ্গেঁ ফাউন্ডার কো-চেয়ারম্যান হন এ যুগের বেগম রোকেয়া বেগম রাবেয়া খাতুন। এই ভাবে জালালাবাদ রাগিব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠায় বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও কৃতিত্বপূর্ণ অবদান ছিল।
বারোই ডিসেম্বরের কুয়াশা ঢাকা শীতের সকাল। এগারোই ডিসেম্বরের দিবাবসান এবং বারোই ডিসেম্বর এর শুভ সকালে জীবন প্রদীপ নিভে গেল বেগম রাবেয়ার। ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাক এ আক্রান্ত হলেন বেগম রাবেয়া। প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য তাঁকে দ্রুত তারই প্রতিষ্ঠিত জালালাবাদ রাগিব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হল। যোগ্যতা সম্পন্ন চিকিৎসকদের আন্তরিক চিকিৎসা-সেবায় শেষ রক্ষা হলো না, এই মায়াময় মাটির পৃথিবী থেকে তিনি চীরতরে চলে যান না ফেরার দেশে। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরীর মৃত্যো সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। ব্যবসা-বানিজ্য-বিশাল বিত্ত বেসাত এর মালিক দানবীর রাগিব আলী বড় একা হয়ে গেলেন। তাঁর প্রিয় সহধর্মিনী বেগম রাবেয়া খাতুন ছিলেন তাঁর সকল কর্মের প্রেরনার উৎস। তাঁকে আকস্মিক ভাবে হারিয়ে কর্মবীর রাগিব আলী সাহেব, ভাষা হারা, ছন্দহারা, দিশাহারা।
সাউথ ইষ্ট ব্যাংক এ কর্মরত আমার কন্যা জেনিফার রহমান মারফত বেগম রাবেয়া খাতুনের মৃত্যো সংবাদটি সাত সকালে যথা সময়েই পেয়ে যাই। আমার পরমাত্মীয় অগ্রজ প্রতীম শ্রদ্বেয় আলহাজ্ব কামরুজ্জামান সাহেব এর ভায়রা ভাই দানবীর রাগিব আলী সাহেব। সেই সুবাদে বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী আমার আত্মীয়া হন। রাগিব আলী সাহেব এর মত বেগম রাবেয়া খাতুন ও আমাকে অনুজের মত ¯েœহ মমতা করতেন। স্বামী ও পিতৃকুল উভয় দিকে অভিজাত স্বচ্ছল খান্দানী পরিবারের কৃতি কন্যা হয়েও তার মধ্যে কোন অহংকার-অহংবোধ কিংবা কি হনুরে ভাব ছিল না। বরং উগ্র মেকআপ হীন সাধারন পোষাকের এক অসাধারন নারী ছিলেন বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী। বেগম রাবেয়ার বোনপু, আলহাজ্ব কামরুজ্জামান সাহেবের সু-সন্তান প্রিয়ভাজন খায়রুজ্জামান শ্যামল মাতৃসম খালার মৃত্যেতে শোকাহত। আত্মীয় স্বজনকে জানাজার দাওয়াত সেই দিল। বাদ আছর রাগিব নগর মরহুমার নামাজে জানাজা। রাগিব নগর যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। গেলাম।
কামালবাজার এলাকাধীন রাগীব নগরে মরহুমা রাবেয়া খাতুন চৌধুরীর বিশাল আকারের জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হল। সমগ্র বৃহত্তর সিলেট-ই-নয়, ঢাকা-চিটাগাং থেকে গন্যমান্য নেত্রীস্থানীয় সর্বদলীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জানাজার নামাজে যোগ দিলেন। জানা গেল স্মরণাতীত কালের মধ্যে ইহাই বৃহত্তম নামাজে জানাজা। মরহুমার রুহের মাগফিরাত কামনায় দোয়া হল। দোয়া ও প্রথম জিয়ারতে অংশ গ্রহণ করলাম। এই রাগিব নগরেই মরহুমার চল্লিশা উপলক্ষে আয়োজিত দোয়া ও শিরনীতে গিয়ে ছিলাম। রাগিব নগরের শ্যামল মাটির কোমল বিছানায় চীর শয়ানে শায়ীতা বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী। ইসলামী আইনের বিধান মোতাবেক আলমে আরওয়া থেকে হাসরের ময়দান পর্য্যন্ত মানবাত্বার ক্রম বিবর্তনের ধারা ও সময়ের মধ্যে এখন তাঁর কবরী জীবন আলমে বরযক। পর্দা পুসিদার অনুসারি ধর্মপ্রাণ মুসলিম নারী বেগম রাবেয়ার কবরি জীবন শান্তিময় হউক-তাঁর রুহ শান্তিতে থাকুক এই মোনাজাত করছি।
মরহুমা বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরীর সঙ্গেঁ আমার অনেক উজ্জল স্মৃতি বিজড়িত। সমগ্র দেশব্যাপী দানবীর রাগিব আলী সাহেবের, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, সমাজ সেবামুলক প্রতিষ্ঠানে আর্থীক সহায়তা আছে, কোথাও তাঁর একক অর্থায়নে এই জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। শিল্পী সাহিত্যিক-সাংবাদিক-বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রাগিব-রাবেয়া দম্পত্তির আলাদা আকর্ষন মায়া মমতা আছে। রাগিব-রাবেয়া ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তাঁদের অর্থায়নে দেশীয় সাহিত্যিক-সাংবাদিকগণকে একুশে পদক ও সাহিত্য পুরষ্কার প্রদান করা হয়। এই দুই কর্মে রাগিব রাবেয়া দম্পতির দুইজন বিশস্থ সহচর ও সহকর্মি ছিলেন বৃহত্তর সিলেটের আধুনিক কালের শিকড় সন্ধানী-মননশীল লোক গবেষক-সংগ্রাহক আলহাজ্ব সৈয়দ মোস্তফা কামাল এবং চৌধুরী হারুন আকবর। আফসোস অগ্রজ প্রতিম সৈয়দ মোস্তফা কামাল এবং অনুজ প্রতীম চৌধুরী হারুন আকবর আমাদের মধ্যে বেঁচে নেই-তারা এখন পরলোকে। এই দুই ভালো মানুষকে আল্লাহ বেহেশত বাসি করুন-এই মোনাজাত করছি। বর্তমানে তাদের শূন্যস্থান পূরণ করেছেন জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্ত প্রকৃতি প্রেমী সাংবাদিক বন্ধুবর আফতাব চৌধুরী। শুধুমাত্র আমার যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাই নয় রাগিব-রাবেয়া দম্পতির মায়া-মমতা ও ¯েœহের সুবাদে আমি তাদের সকল শুভানুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি বক্তা থাকতাম। তাঁরা দুজনেই আমার লেখা-বলার শুভাকাংখী ও পরামর্শক। দানবীর সাহেব আমার লেখার এতই ভক্ত যে তিনি বলতেন আমি নাকি কলম দিয়ে নয়, কলিজা থেকে লিখি। আমার বক্তৃতার তিনি এতই অনুরাগি যে তিনি এক দিন মালনি ছড়ায়-ওলামা সমাবেশে আমাকে দিয়ে ওয়াজ করিয়েছেন। মালনি ছড়া মালিক বাংলো-তে গেলে বেগম রাবেয়া খাতুন মায়ের মমতা দিয়েই আদর আপ্যায়ন করেছেন। তাঁকে দুরে থেকে কাছ থেকে যতই দেখেছি, মুগ্ধ হয়েছি। তাঁর শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, বিনয়াচরন, স্মরণ রাখার মত, বিমুগ্ধ বিমোহিত হওয়ার মত। তখন আমার ভরা যৌবন কাল রুগবালাই অসুখ বিসুখ ও খুব একটা নেই। পেশাদার আইনজীবী হিসাবে আমি সার্বক্ষনিক পেশাগত কাজ করি না, আমার ভালো লাগেনা, তবে আদালতে আমি নিয়মিত উপস্থিত থাকার চেষ্টা করি। তখন বিভিন্ন স্থানে সমাজ সেবা মূলক কর্ম কান্ড সভা সমাবেশে যাই, বায় বক্তৃতা দেই, মানুষের কাজে নিজেকে জড়িত রাখার চেষ্টা করতাম। এখন মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে-গাড়ি চলে না, চলেনার মত অবস্থা। শয্যাশায়ী না হলেও সোফাসায়ী হয়ে কাল কাটাতে হচ্ছে। হবিগঞ্জ পৌরসভার এককালীন ডাক সাইটে ও জনপ্রিয় চেয়ারম্যান ভ্রাতৃপ্রতীম শহীদ চৌধুরী হবিগঞ্জ পৌরসভার পক্ষ থেকে শিক্ষানুরাগি দানবীর আলহাজ্ব রাগিব আলী সাহেবকে সম্ভর্ধনা দেবেন, আমি সেখানেও সম্মানিত অতিথি। বিশাল সম্ভর্ধনা সভা শেষে শহীদ ভাইর বাসায় পারিবারিক নৈশভোজ, বেগম শহীদ চৌধুরীর আন্তরিক আথিতেয়তা এখনও আমার মনে পড়ে। এরূপ আরেকটি সম্ভর্ধনা সভায় যোগ দেই কানাইঘাট এলাকার লক্ষী প্রসাদ বাজার এলাকায়। গাড়ি যায় না বলে কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে নেয়ার জন্য হাতি পাঠিয়েছেন। রাগিব আলী সাহেব রাজকীয় ভঙ্গীঁমায় হাতির পিঠে চড়লেন, আমি ভয়ে হাতির সওয়ার হলাম না, বেগম রাবেয়া খাতুন শাড়ি পরিহিতা বলে পর্দা পুসিদার কারনে হাতির পিঠে উঠলেন না, আমরা সফর সঙ্গীঁগণ হাতির পিছে পিছে মিছিল সহকারে চল্লাম। সেই গ্রামাঞ্চলে সাধারন মানুষের সঙ্গেঁ সহজ ভাবে চল্লেন, কথা বল্লেন বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী। মানুষের কিছু দাবী দাওয়া শুনলেন, পূরণ করলেন, পূরনের আশ্বাস ও দিলেন।
সাউথ ইষ্ট ব্যাংক এর উদ্যোক্তা পরিচালক শিল্পপতি রাগিব আলী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে ব্যাংক পাড়া ও তাঁর শুভাকাংখী মহলে আনন্দের বন্যাবয়ে যায়। সাউথ ইষ্ট ব্যাংক, মৌলভীবাজার শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক আলী আহমদ সাহেব (বর্তমানে পরলোকে। আল্লাহ পাক এই ভালো মানুষের বেহেশত নসীব করুন।) ব্যাংক গ্রাহক এবং স্থানীয় সুধীবৃন্দের একটি মত বিনিময় সভা ডাকলেন। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ সাবেক ইউ/পি চেয়ারম্যান কামাল হোসেন এবং বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ইকবাল আহমদ হোসেন এ ব্যাপারে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন। জনাব কামাল হোসেন কৃতিত্ব ও জন প্রিয়তার সাথে মৌলভীবাজার চেম্বার এবং সদর উপজেলা পরিষদ এর চেয়ারম্যান এর গুরু দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের একজন বলিষ্ট নেতা ও বটেন। সভায় আলোচনা ক্রমে সিদ্ধান্ত হল ব্যাংক চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়াতে তাঁকে গন সম্ভর্ধনা দেয়া হবে। আমাকে আহ্বায়ক ও কামাল হোসেনকে সদস্য সচিব নির্বাচিত করে কমিটি গঠিত হলে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বিশাল আকারে অনুষ্ঠিত সম্ভর্ধনা সভা এবং সভা শেষে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আমার একান্ত প্রিয়ভাজন ইকবাল আহমদ হোসেন এর বাড়ি ইসলামপুরে আকর্ষনীয় নৈশভোজে সদা হাস্যমুখে মায়ের মমতা নিয়ে উপস্থিত ছিলেন বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী। তাঁর উজ্জলশ্যাম বর্ণের চেহারার গোলবাটা মুখে এক চিলতে মিষ্টি হাসি লেগে থাকত সবসময়। এই বারো বছরে বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী কবরের মাটি শুকিয়ে জন্ম নিয়েছে অনেক ঘাস, হয়ত ফুটেছে নাম না জানা ঘাস ফুল, তবুও তিনি স্মৃতির গভীরে হারিয়ে যান নি। এ যুগের বেগম রোকেয়া, বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী বেঁচে আছেন, বেচে থাকবেন তাঁর সকল সৃজনশীল কাজের মাঝে। মরহুমার উজ্জল স্মৃতির প্রতি গভীর গভীর শ্রদ্ধা ও রুহের মাগফিরাত কামনা করছি-মহান মালিক তাঁর বেহেশত নসিব করুন-এই মোনাজাত করছি।
[একটি রাষ্ট্রায়ত্বে বানিজ্যিক ব্যাংক এর সাবেক পরিচালক ও চেয়ারম্যান নির্বাহী কমিটি। সিনিওর এডভোকেট হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব।]
মন্তব্য করুন