বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল : ত্রিশ বছর ধরে অন্ধজনে আলো ছড়াচ্ছে : সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা কামনা
স্টাফ রিপোর্টার॥ ত্রিশ বছর ধরে অন্ধজনে আলো ছড়াচ্ছে মৌলভীবাজার বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল। শিশুসহ সকল বয়সের নারী-পুরুষের ট্যারা চোখ সোজা করা, চোখের ছানি অপারেশন, লেন্স সংযোজন, টনসিল অপারেশনসহ চোখ সংশ্লিষ্ট সব ধরনের অপারেশন এই হাসপাতালে হয়ে থাকে। হাসপাতালে একটি চশমা ও ঔষধের দোকান রয়েছে। যেখানে দু:স্থ ও গরীব রোগীরা অপেক্ষাকৃত কমমূল্যে সামগ্রী কিনে থাকেন।
এই হাসপাতালে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গ্রামাঞ্চলের মানুষজন চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। এছাড়া সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য কাজ করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। বিশেষ করে সমাজের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা হয়ে থাকে।
হাসপাতালটিতে ফ্যাকো অপারেশন করা হয়। যার বৈশিষ্ট্য হলো সেলাইবিহীন অপারেশন, অপারেশনের পরপরই দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাওয়া। বিশেষ কোন কারণ ছাড়া চমশার প্রয়োজন হয়না।
হাসপাতালের বহির্বিভাগে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৩৫০ থেকে ৫ শতাধিক রোগীরা চোখের বিভিন্ন পরীক্ষা, বায়োমেট্টি, এ-স্কেন, বি-স্কেন, লেজার চিকিৎসা, মাইনর অপারেশন (নালী, টেরিজিয়াম, কেলজিয়ান), কর্ণিয়া ও ক্যাটারেক্ট ক্লিনিক সার্ভিসের সুবিধা নিয়ে থাকেন। আন্ত:বিভাগে গড়ে প্রতিমাসে ৩শ’ থেকে ৩শ’৫০জন রোগী হাসপাতালের আন্ত:বিভাগে ভর্তি হয়ে থাকে। এদের মধ্যে ১শ’৫০ থেকে ২শ’ জন রোগীর চোখে কৃত্রিম লেন্স সংযোজন, ইসিসি, গ্লুকোমা, ডিসিআর অপারেশন, সেপটিক, এসেপটিক চিকিৎসাসহ নিয়মিত ঔষধ ও উন্নত খাদ্য সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা দেশে ইতিমধ্যে ৪০ হাজার শিশু অন্ধত্ব বরণ করেছে। এছাড়াও ১৩ লক্ষ শিশু দৃষ্টিজনিত বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছে। সিলেট বিভাগে ৩০ লক্ষ শিশুর মধ্যে প্রায় ২ হাজার ৪শ’ শিশু অন্ধত্বের অভিশাপে ভুগছে। আরও প্রায় ১ লক্ষ শিশু বিভিন্ন দৃষ্টিজনিত সমস্যা নিয়ে বেঁচে আছে। ২০০৪ সাল থেকে মৌলভীবাজার বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল ও অরবিস ইন্টারন্যাশনালের যৌথ উদ্যোগে হাসপাতালে একটি আধুুনিক শিশু চক্ষু বিভাগ চালু করা হয়। ১২ বছরে এই বিভাগের মাধ্যমে ২ লক্ষ শিশুর চিকিৎসা এবং ২ হাজার জনের অধিক শিশুর চোখে বিনামূল্যে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে।
হাসপাতালে কর্ণিয়া স্ক্র্যাপিং, কনজাঙ্কটাইভাল সোয়াব, কালচার, রক্ত, প্র¯্রাবের বিভিন্ন র”টিন পরীক্ষা, রক্তের বিটি, সিটি ও গ্লুকোজ, পেনিসিলিন ড্রপসহ রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া ডায়াবেটিক ইউনিট, গ্লুকোমা ইউনিট, স্কুল সাইট টেস্টিং প্রোগ্রাম ইত্যাদি চালু আছে।
হাসপাতালটিতে সিলেট জেলার মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্নস্থান থেকে রোগীরা এসে চোখের চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। হাসপাতালে ৪জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ৮জন মেডিক্যাল অফিসারসহ সব মিলিয়ে ১১৮জন স্টাফ সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছেন।
হাসপাতালে চিকিৎসাপ্রাপ্ত রোগীর সংখ্য ১১ লক্ষ ৪ হাজার ২৭০জন, অপারেশনকৃত রোগীর সংখ্যা ৪৬ হাজার ৩৪৫জন, মোট চক্ষু শিবিরের সংখ্যা ৫৮৯টি, চক্ষু শিবিরে চিকিৎসাপ্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা ৭ লক্ষ ৩৪ হাজার ৬২১জন, চক্ষু শিবিরে অপারেশনপ্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা ৫২ হাজার ৬৬৭জন, আইওএল চক্ষু শিবিরের সংখ্যা ৮৬৮টি, আইওএল চক্ষু শিবিরে অপারেশনকৃত রোগীর সংখ্যা ২৯ হাজার ২জন, মোট স্কুল পরিদর্শন ৮১১টি, চিকিৎসাপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ লক্ষ ৫৩ হাজার ১৪৬জন, পেডিয়াট্রিক ক্যাম্পের সংখ্যা ২৮টি ও চিকিৎসাপ্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা ১৭ হাজার।
বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতি (বিএনএসবি) বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ১৯৭৩ সালে যাত্রা শুর” করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিনামূল্যে চক্ষু শিবির কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। আন্ধেরী হেলফি জার্মানীর কারিতাস এবং বিএনএসবি একযোগে কাজ করে থাকে।
১৯৮৬ সালে মৌলভীবাজার শহরতলীর মাতারকাপন এলাকায় নিজস্ব জমির উপর ২৫ বেডের বিশেষায়িত এই প্রতিষ্ঠানটি চালু করা হয়। বর্তমানে ৩টি সাধারণ কেবিন, ১০টি এসি কেবিন ও ৫০টি সাধারণ বেড রয়েছে। ১৯ সদস্যবিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটির দিকনির্দেশনায় হাসপাতালটি পরিচালিত হয়ে আসছে। জেলা প্রশাসক মোঃ কামরুল হাসান পদাধিকার বলে এই কমিটির সভাপতি। নির্বাচিত পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন এ এম ইয়াহিয়া মুজাহিদ। নির্বাচিত পরিষদের অন্যান্য সদস্যরা হলেন সহ-সভাপতি আলহাজ্ব সৈয়দ আবু সাহাজান, আলহাজ্ব জয়নাল হোসেন, আলহাজ্ব মুজিুর রহমান মুজিব এডভোকেট, যুগ্ন সম্পাদক সৈয়দ মসাহিদ আহমদ ও আবদুল হামিদ মাহবুব, কোষাধ্যক্ষ প্রকৌশলী এ মুনিম, নির্বাহী সদস্যঃ- গোলাম মোহিত খান, সৈয়দ জয়নাল আবেদীন এডভোকেট, ডাঃ ছাদিক আহমদ, আলহাজ্ব সৈয়দ তৌফিক আহমদ, আলহাজ্ব নূরুল ইসলাম তরফদার, আলহাজ্ব মাহমুদুর রহমান, সৈয়দ হেদায়েত উল্লাহ বেলাল, এস এম উমেদ আলী, আলহাজ্ব কামরুল হাসান সিরাজী। কো-অপ্ট সদস্য- সিভিল সার্জন সত্যকাম চক্রবর্তী ও খন্দকার মাহমুদ হোসেন কুটি।
হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন সাবেক পৌর কাউন্সিলর এ এম ইয়াহিয়া মুজাহিদ। সদা হাসোজ্জল এই মানুষটি নিজেও দুরারোগ্য কিডনি রোগে আক্রান্ত কিন্তু ক্লান্তিহীনভাবে রোগীদের সেবার ব্রত নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। জেলার মানুষের কাছে তাঁর পরিচিতি থাকায় রোগীরা চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে প্রথমেই তাঁর কক্ষে ঢুকে পড়ে। তিনিও সহাস্যে তাঁদের সাথে আলাপ করে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করে থাকেন। ফলে অনেকেই মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে ওঠে। সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদ জানান, কাউন্সিলর থাকাবস্থায় মানুষের সেবা করেছি। তখন পরিসর কম ছিলো। এখন বড় পরিসরে গরীব ও দুস্থ মানুষের সেবা করে থাকি। মানব সেবাকেই ব্রত হিসেবে নিয়েছি। তিনি হাসপাতালটি পরিচালনা করতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা কামনা করেছেন।
মন্তব্য করুন