“বিজ্ঞ আইনজীবি ও বড় ভালো মানুষ আজিজুর-রহমান-আজিজ এর অসময়ে চলে যাওয়া স্মৃতি কথাঃ স্মরণ ও মাগফিরাত ॥ ”

January 12, 2019,

মুজিবুর রহমান মুজিব॥ মহান আল্লাহর অপরূপ সৃষ্টি মায়াময় এই মাটির পৃথিবী ক্ষণস্থায়ী। অনির্ধারিত। রুহের জগত আলমে আরওয়া থেকে রোজ হাসরের ময়দান পর্য্যন্ত মানবাত্বার ক্রমবিকাশ বিবর্তন এবং ধারাবাহিকতার মধ্যে শুধু মাত্র মায়াময় মাটির পৃথিবী ক্ষণস্থায়ী। মৃত্যোর জন্যই মানুষের জন্ম। চলে যাওয়ার জন্যই মানুষের এই আসা। মহান মৃত্যো প্রসঙ্গেঁ আমাদের সৃষ্টাও প্রতিপালক সর্ব শক্তিমান আল্লাহ তায়ালা আসমানী কিতাব আল কোরআনে বলেন-‘কুল্লুন নাফসীন জায়িকাতুল মউত’। জগতের সকল প্রাণীকেই একদিন মৃত্যোর মোকাবিলা করতে হবে। মুত্যোকে আলিঙ্গঁন করতে হবে। মানুষের জীবনে মৃত্যো সহজাত ও স্বাভাবিক হলেও লাশের স্বজন-শুভাকাংখীগণ একটি মৃত্যো সংবাদকে সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেন না। বেদনা হত হন-আকুলকান্নায় ব্যাকুল হন।

গত এগারোই ডিসেম্বর মঙ্গঁলবার রাত সাড়ে ন’টায় চায়ের রাজধানী হিসাবে খ্যাত শ্রীমঙ্গঁল উপজেলা শহরস্থ নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন জেলার সিনিয়র আইনজীবি সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটার সহজ সরল সাদা মনের মানুষ বড় ভালো মানুষ আজিজুর রহামন আজিজ। দীর্ঘ দেহী সুঠাম শরীরের অধিকারি সুদর্শন ও সুবেশী আজিজুর রহমান আজিজ জজ কোর্টে মৌলভীবাজার জেলার পাবলিক প্রসিকিউটার হিসাবে দায়িত্ব পালন কালে ক’বছর আগে আদালত আঙ্গিঁনায়ই হার্ট এ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে ছিলেন। পঞ্চাশের কোঠায় এসে অসুখ-বিসুখ রুগবালাই বিহীন স্মার্ট হেন্ডসাম আজিজুর রহামন আজিজ হৃদরূগে আক্রান্ত হয়ে হালকা ও প্রথম আক্রমন বলে মহান মালিকের মেহের বানীতে প্রাণে বেঁচে যান ভাগ্যবান আজিজুর রহামন আজিজ। কিন্তু দুঃখও দূভাগ্যজনক ভাবে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ম্যসিভ হার্টএ্যাটাকে মৃত্যো না হলে সাধারনতঃ কিছু ইনজুরি রেখে যায়। মুখাবয়বে বিকৃতি হাত-পা-বিকলাঙ্গঁ হয়। এডভোকেট আজিজের এসব কিছুই হলো না। কোন এক্সটার্নেল ইনজুরি বাহ্যিক জখম নেই। শুধু মাত্র বাকশক্তি লোপ। ছোট খাটো কথার যাদুকর এডভোকেট আজিজ। পেশাগত ভাবে আইনজীবি রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা আইনী কথাবার্তা বলতেই হয়। রাজনীতিবিদ হিসাবে আজিজুর রহমান আজীবন পরিক্ষিত মুজিব সৈনিক। ছাত্র লীগের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিতে তাঁর প্রবেশ, বাগ্মিতা ও সাংঘটনিক দক্ষতার জন্য শ্রীমঙ্গল থানা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে ছিলেন। ছাত্র রাজনীতি শেষে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রবেশ এবং কৃতিত্বের সাথে নিজ থানার সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন, একজন সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সমাজ কর্মী হিসাবেও আজিজ ছিলেন এসব অঙ্গঁনের বলিষ্ট সংঘটক এবং সুবক্তা। হার্ট এ্যাটাকে বাকশিল্পী মিষ্ট ভাষি আজিজের বাক শক্তি হারিয়ে গেলে গৃহাশ্রয়ী ও শয্যাশায়ী হন। এক সময় এ জেলার পি.পি.এর পদটিও চলে যায়। রাজনীতিবিদ আইনজীবি সাহিত্য সংস্কৃতিও সমাজ সেবি ভালো মানুষ আজিজুর রহমান হয়ে যান স্বেচ্ছা গৃহ বন্দী। শ্রীমঙ্গঁল শহরের প্রাণকেন্দ্রে তাঁর ল’চেম্বার লোক শুন্য। তালাবদ্ধ। নিঃসন্তান আজিজুর রহমান তাঁর বাসগৃহে শোবার ঘরে এক গেয়ো নিরানন্দ জীবন কাটান দীর্ঘদিন। তাঁর প্রিয় জীবন সঙ্গিনী প্রিয়তমা পতিœ চেমন আরা আক্তার জলি-ই-ছিলেন তাঁর সকাল সন্ধ্যা দিবারাত্রির আনন্দ বেদনার চীর সখা-চীর সাথী। তাঁর নিঃসঙ্গ নির্জন দিবা-রাত্রির আনন্দ বেদনার মহাকাব্য। পতিই সতীর গতি এই শ্বাস্বত চীরায়ত নীতি বাক্যের আদর্শ নমুনা দেখিয়েছেন সুকন্যা ও সুগ্রহিনী চেমন আরা আক্তার জলি। প্রিয় জীবন সঙ্গীঁ হার্ট এ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে বাক শক্তি হারিয়ে কর্ম পেশা খুইয়ে শয্যাশায়ী হলে দিবা নিশি হাসি মুখে স্বামীর সেবা করেছেন, পতিপ্রেম ও স্বামী সেবার আদর্শ নিদর্শন রেখেছেন। আত্মীয় স্বজন সমাজ কতৃক প্রশংসিত হয়েছেন। সুকন্যা চেমন আরা হবিগঞ্জের একটি শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারের সু-সন্তান-শিক্ষিত-গুণবর্তী-রূপবর্তী-রমনী কিন্তু তাঁর মধ্যে কোন অহংকার ও অহংবোধ ছিল না, নেই ও। দীর্ঘ দিন শয্যাশায়ী থেকে বিজয়ের মাসে বিজয় দিবসের প্রক্কালে চীর বিদায় নিলেন, না ফেরার দেশে চলে গেলেন স্বাধীনতার চেতনা বক্ষে ধারণকারী নির্লোভ ও নির্ভীক মুজিব সৈনিক আজিজুর রহমান আজিজ। ডিসেম্বর মাস ছিল সিভিল ভেকেশন। ফলতঃ তাঁর মৃত্যোর পরই ফুল কোর্ট রেফারেন্স করা সম্ভব হয় নি।

বিশিষ্ট আইনজীবিদ্বয় এডভোকেট রমা কান্ত দাশ গুপ্ত এবং এডভোকেট মিজানুর রহমান এর নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিটি একটি বার বান্ধব, স্মার্ট-কর্ম চঞ্চল ও কর্মতৎপর কমিটি। অসুখে-বিসুখে-জীবনে-মরনে রমা-মিজান, কমিটি সমিতির সদস্যদেরকে দেকভাল করেন। একজন বিজ্ঞ সদস্যের মৃত্যোর সাথে সাথে জেলাবারের পক্ষ থেকে মৃতের পরিবার বর্গকে শেষ কৃত্যানুষ্টানের জন্য নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা প্রদান করা হয়। বর্তমান কমিটি নিঃসন্তান আজিজুর রহমানের মৃত্যোর পর তাৎক্ষনিক প্রাসঙ্গিঁক দায়িত্ব পালন করেন আন্তরিক ভাবেই। জেলা জজ আদালত খোলার পর কমিটি প্রচলিত প্রথা মাফিক দোছরা ডিসেম্বর বুধবার সকালে ফুল কোর্ট রেফারেন্স এর ব্যবস্থা করেন।

গত দোছরা ডিসেম্বর সকালে এডভোকেট আজিজুর রহমানের সম্মান ও স্মরনে মৌলভীবাজার জেলার মাননীয় জেলা ও দায়রা জজ জনাব শেখ মোহাম্মদ আবু তাহেরে পৌর হিত্যে ফুল কোর্ট রেফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। কোর্ট রেফারেন্স উপস্থাপন ও পরিচালনা করেন জেলা বারের সম্পাদক বিশিষ্ট আইনজীবি মিজানুর রহমান এডভোকেট। জেলা জজ শীপের সকল বিজ্ঞ বিচারকদের উপস্থিতিতে জেলাও দায়রা জজ মহোদয় মরহুম এডভোকেট আজিজ এর পেশা দারিত্ব এবং মানবিক গুণাবলির প্রশংসা করেন। মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করতঃ রেওয়াজ মোতাবেক সকল আদালতের কার্য্যক্রম স্থগিত ষোষনা করেন।

বিশিষ্ট আইনজীবি এ জেলার সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটার আজিজুর রহমান এর মৃত্যোর পর জেলা আইনজীবি সমিতিতে তাঁর সদস্য পদ বাতিল হয়ে গেল। ফুল কোর্ট রেফারেন্স এর পর মরহুমের পরিবারের পক্ষ থেকে বার ও বার কাউন্সিল থেকে কিছু আর্থীক পাওনা নিয়ে গেলে জেলা বারের সঙ্গেঁ তাঁর সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল। তাঁর কোন সন্তান থাকলে তাঁর পিতার পেশায় আসার সম্ভাবনা হয়ত ছিল। কিন্তু সেই সুযোগও নেই। আদালত আঙ্গিঁনায় এডভোকেট আজিজ এখন উজ্জল স্মৃতি মাত্র। শ্রীমঙ্গঁল উপজেলাধীন জানাউড়া গ্রামে পারিবারিক গোরস্থানে চীর শয়ানে শায়ীত সহজ সরল ভালো মানুষ প্রিয় ভাজন আজিজুর রহমান আজিজ। পল্লীর নিভৃত প্রান্তর জানাউড়ার শ্যামল কোমল মাটিতে মাটির বিছানায় চীর শয়ানে শায়িত সে-তিনি। এই কদিনে তাঁর কবরের মাটি শুকিয়ে গেছে হয়ত গজিয়েছে বুনো ঘাস হয়ত ফুটেছে নাম নাজানা ঘাস ফুল। এডভোকেট আজিজুর রহমান আর আমাদের মধ্যে বেঁচে নেই। কিন্তু আছে তাঁর উজ্জল স্মৃতি। সহজ সরল ভালো মানুষ আজিজুর রহমানের রুহের মাগফিরাত কামনা করি। সদ্য প্রয়াত সহকমী আজিজুর রহমানের সঙ্গেঁ পরিচয় সম্পর্ক ও সখ্যতা তাঁর বাল্য কেশোর কাল থেকেই। আমার প্রায় দেড় দশক কনিষ্ট হবে সে। তাঁর সঙ্গেঁ আমার কিছু মিল ছিল। তাঁর জন্ম ও কর্মের প্রিয় শহর শ্রীমঙ্গঁল আমার কাছে ও প্রিয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য অর্থনৈতিক সম্বৃদ্ধি, শিক্ষা, সংস্কৃতির সমাহার সংমিশ্রনের শহর শ্রীমঙ্গঁল। ষাটের দশকে ছাত্র রাজনীতিতে দায়িত্বে নেতৃত্বে ছিলাম। ঐ দশকে মৌলভীবাজার মহকুমা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম। সত্তোর সালের সাধারণ নির্বাচন, একাত্তোরের মুক্তি যুদ্ধ, স্বাধীনতা উত্তর কালে শোষনহীন সাম্যবাদী সমাজ গঠনের রাজনৈতিক আন্দোলনের কারনে শ্রীভূমি শ্রীমঙ্গঁলে যাওয়া আসা বাড়তে থাকে। স্বাধীনতা উত্তরকালে স্বাধীন পেশাহিসাবে আইন পেশায় যোগ দেই। একাধিক মেয়াদে সভাপতি সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন নব্বইর দশকে এ জেলার পাবলিক প্রসিকিউটার এর দায়িত্ব থাকার কারনে সকল বিজ্ঞ আইনজীবির সঙ্গেঁ আমার একটা আত্বিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। কনিষ্ট কলিগদের মধ্যে এডভোকেট আজিজ আমার খুবই ¯েœহভাজন ও সুপ্রিয় ছিল। আমাদের নিকট প্রতিবেশী ঐতিহ্যবাহী জেলা হবিগঞ্জেও ঐ দশক থেকেই আমার যাতায়াত। একাত্তোরে হবিগঞ্জের কৃতি সন্তান কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরীর সঙ্গেঁ মুক্তি যুদ্ধে যোগ দেই। হবিগঞ্জ জেলা বারে ও আমার অনেক ভাই বন্ধু আছেন। বেশ ক’বছর আগে এক সন্ধ্যায় আমার বাসায় আসেন হবিগঞ্জের বিশিষ্ট আইনজীবি ভ্রাতৃ প্রতিম মোঃ নুরুল আমীন এডভোকেট এবং জাসদ নেতা আমার একান্তই ¯েœহভাজন রুহেল আহমদ। প্রসঙ্গঁ রুহেলের বোন চেমন আরা আক্তার জলির বিয়ে। পাত্র নবীন আইনজীবি আজিজুর রহমান আজিজ। আল কোরআনে আল্লাহ বলেন- ‘খালাক্ক না কুম আজওয়াজা’ আমার সৃষ্টিকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করিয়াছি। শুভ বিবাহে সম্পৃক্ত হওয়া, থাকা ছওয়াব এর কাজ। আমি পেশাদার ওকালতিতে যোগদানের পূর্ব থেকেই ঘটকালিতে সম্পৃক্ত ছিলাম অবশ্য সৌখিন অপেশাদার হিসাবে। সন্ধ্যারাত থেকে রাত দশটা পর্য্যন্ত খুজখবর বাতচিত এবং বিতর্ক হল আমি একবাক্যে আজিজের পক্ষাবলম্বন করলাম। জলির বিয়েতে মত দিলাম। জীবন সম্মন্ধে অভিজ্ঞ বুদ্ধিমান বন্ধু এডভোকেট নুরুল আমীন সর্বশেষে বলেছিলেন আপনারা দুইজন থাকেন দুই শহরে, দুইজন দুই রাজনীতি করেন, দুইজন একে অন্যের আত্মীয় নন তবুও বর হিসাবে এডভোকেট আজিজকে এত পছন্দ করেন কেন?

আমি বন্ধু নুরুল আমীনের এত সব প্রশ্নের সহজ উত্তর দিতে পারিনি, শুধু বিনয়ের সঙ্গেঁ বলেছিলাম আমি চাই বন্ধু নুরুল আমীনের শালি জলি আমার ¯েœহভাজন রুহেল এর বোন চেমন ভালো ঘরে-ভালো বরে পাত্রস্থ হউক। আমার দেখা আমার জানা মতে মানুষও বর হিসাবে আজিজুর রহমান একজন সহজ সরল সাদা মনের মানুষ, বড় ভালো মানুষ। আজিজ- জলির বিয়ে হল, দেখলাম, খেলাম দোয়া করলাম, তাঁদের সুখময় দাম্পত্য জীবন কামনা করলাম। একদিন কমলাপুর রেল ষ্টেশনে দেখলাম-আজিজ-জলি-রোমান্টিক জুটি হাত ধরাধরি করে হাটছে, আর মনের সুখে গল্প গুজব করছে। আজিজ এর অসুস্থতার সময় আমি আর আমার প্রিয় কলিগ বিশিষ্ট আইনজীবি এডভোকেট রাধা পদ দেব সজল তাকে দেখতে তাঁর বাসায় যেতাম। দেখতাম অসুস্থ আজিজ গিন্নি চেমন একমনে স্বামীর সেবা করছে। নির্বাক আজিজের মুখে কথা ফুটাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু আজিজুর রহমান আজিজ এর মুখে কথা উঠেনি জবান খুলেনি বরং শেষ মেস বিজয়ের মাসে চেমনকে কাঁদিয়ে একা রেখে চোখ বুঝলো চীর তরে, চীর তরে চলে গেল না ফেরার দেশে। প্রিয় ভাজন আজিজুর রহমান এর রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। মহান মালিক তাঁর বেহ্শেত নসীব করুন এই মোনাজাত করছি।

সদ্য বিধবা বোন চেমন আরা আক্তার জলি-কে সমবেদনা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই, মহান মালিক তাকে এই কঠিন শোক সইবার শক্তি ও সাহস দিন এই মোনাজাত করছি।

 [(ষাটের দশকের সাংবাদিক। সিনিয়র এডভোকেট, হাইকোর্ট, মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেসকøাব সাবেক পি.পি.মৌলভীবাজার জেলা।]

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com