বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ-সংস্কৃতি সেবী- শ্রীমতি শ্রীলেখা ঘোষের মহা প্রয়ান: শেষ দেখাহলনা, শেষ কথা বলা গেল না!
মুজিবুর রহমান মুজিব॥ উনিশে সেপ্টেম্বর মঙ্গঁলবার সন্ধ্যার দিকে মৌলভীবাজার পৌরসভার সম্মানীয় মেয়র আলহাজ¦ মোঃ ফজলুর রহমান মোবাইল মারফত জানালেন প্রয়াত রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী বাবু ব্যোমকেষ ঘোষ- টেমা বাবুর সহ-ধর্ম্মিনী স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী হাফিজা খাতুন গার্লস হাই স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষিকা সংস্কৃতি সেবী শ্রীমতি শ্রীলেখা ঘোষ আর নাই। অদ্য সন্ধ্যায় তিনি আকস্মিকভাবে পরলোক গমন করেছেন। মৃত্যো ও মৃত্যো সংবাদ একটি দূঃসংবাদ। বরাবরই বেদনা ও পিড়া দায়ক। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ হাজী ফজলুর রহমান জানেন এই ঐতিহ্যবাহী ঘোষ পরিবারের সঙ্গেঁ আমার পারিবারিক সম্পর্ক। আমি এখন অসুস্থাবস্থায় শয্যাশায়ী। ইদানিং শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। ব্লাড প্রেসার, ব্রনকাইটিজ সহ কতেক বার্ধক্যজনিত ব্যাধিতে কাহিল ও কাবু হয়ে শয্যাশায়ী-সোফাশায়ী হয়ে কালাতিপাত করতে হচ্ছে। মরার উপর খারা-ঘা সম্প্রতি বাসায় ফজরের নামাজের সময় দোতালার সিড়ি থেকে পা ফসকে পা ভাঙ্গাঁ। ফলত: চল-অচলের মধ্যে আছি। দূঃসংবাদটি শুনে মেয়র সাহেবকে আমার অসুস্থতার সংবাদ দিলে তিনি মোবাইলটি বিজ্ঞ সিনিয়র বন্ধুবর শান্তিপদ ঘোষ এডভোকেট মহাশয়কে দিলেন। তিনি আমার অসুস্থতার সংবাদ শুনে মোবাইলটি জেলা পরিষদের সম্মানীয় চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমানের কাছে দিলে আমি আমাদের প্রিয় ও শ্রদ্ধেও বৌদি আমার প্রিয় সহপাঠিনী শ্রীমতি শ্রীলেখা ঘোষের আকস্মিক মৃত্যোতে গভীর দূঃখ প্রকাশ এবং তার বিদেহী আত্বার শান্তি ও সদগতি কামনা করি। আমি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী এবং চলাফেরায় অক্ষম বলে জানাই। অগ্রজ প্রতিম আজিজুর রহমান আজিজ ভাই জানালেন কুমিল্লা-ঢাকা থেকে মেয়েরা আসা সম্ভব নয় তাই মরদেহ একটু পরেই শেষ কৃত্যানুষ্টানের জন্য শ^শান ঘাটে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি আফসোস করলাম তার সঙ্গেঁ আমার শেষ দেখা হলনা শেষ কথা বলা গেল না। শ্রীমতি শ্রীলেখা ঘোষ এর এই মৃত্যো একেবারেই অকাল মৃত্যো না হলেও আকস্মিক মৃত্যোই বলা চলে। ঐ রাতেই তাকে গোষ লজ, এই মায়াময় পৃথিবী থেকে চীর বিদায় জানানো হয়- শেষ কৃত্যানুষ্টান অনুষ্টিত হয়। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সংস্কৃতি সেবী- সুমাতা ও সুগৃহীনি শ্রীমতী শ্রীলেখা ঘোষের বিদেহী আত্বার শান্তি ও সদগতি কামনা করছি, তাঁর পরিবার বর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা ও সহানুভূতি জ্ঞাপন করছি। মৃত্যোকালে তিনি একপুত্র চার কন্যা ও অসংখ্য গুনগ্রাহী- আত্বীয় স্বজন রেখে গেছেন।
মৌলভীবাজার জেলা সদরে ঐতিহ্যবাহী রাজনগর উপজেলাধীন এই ঘোষ পরিবারটি একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষিত-সম্ভ্রান্ত-অভিজাত ও বনেদি পরিবার। ভূ-স্বামী ও সমাজ সেবী হিসাবে ও খ্যাত। এই পরিবারের বাবু ব্যোমকেষ ঘোষ স্বদেশ প্রেম ও স্বাধীনতায় উদ্ভোদ্ধ হয়ে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে ভারতীয় যুব কংগ্রেসের নেতা হিসাবে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহন করেন।
সাতচল্লিশ সালের ভারত বিভক্তি এবং পাকিস্তানী স্বাধীনতার পর বাবু ব্যোমকেষ ঘোষ মোক্তার হিসাবে মৌলভীবাজার মোক্তার বারে যোগদান করতঃ দির্ঘদিন তিনি মোক্তার বারের সেক্রেটারি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
পাকিস্তানী আমলে সুনামগঞ্জের সুকন্যা শ্রীমতী শ্রীলেখা ঘোষের সঙ্গেঁ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন বাবু বোমকেশ ঘোষ। টেমা বাবু-শ্রীলেখা ঘোষের সুখময় দাম্পত্য জীবনের ফলও ফসল চার কন্যা, এক পুত্র সন্তান। চার কন্যাই সু-শিক্ষিত-ভালোঘরে ভালোবরে পাত্রস্থ। একমাত্র পুত্র সন্তান বাবু বিমান ঘোষ-বিলকু একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপক হিসাবে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন রত। শ্রীমতী শ্রীলেখা ঘোষের জীবনসঙ্গীঁ বাবু ব্যোমকেষ ঘোষ রাজনীতি, পেশা, ধর্ম্ম, কর্ম্ম ও সমাজ সেবায় নিয়োজিত থাকার কারনে সু-গৃহিনী শ্রীমতী শ্রীলেখা ঘোষকেই সংসার সামলাতে হয়েছে। স্কুলের শিক্ষকতা, সামজিক সংসারিক দায়-দায়িত্ব হাসিমুখেই পালন করেছেন শ্রীমতি ঘোষ।
আমার ছাত্রজীবন-পাকিস্তানী শাসনামলের শেষভাগ থেকে এই পরিবারের সঙ্গেঁ আমার পরিচয়, সম্পর্ক, সখ্যতা। একই শহরের বাসিন্দা আমরা। আমার পৈত্রিক বাসগৃহ মুসলিম কোয়ার্টারস্থ রসুলপুর হাউজ থেকে শান্তিবাগের ঘোষ লজ কাছেই-খুব দূরে নয়। চৌমুহনার উত্তর-দক্ষিন প্রান্তে আমাদের বাসগৃহ। সর্ব্বোপরি সাংস্কৃতিক সামাজিক-রাজনৈতিক কারনে এই ঐতিহ্যবাহী ঘোষ পরিবারের সঙ্গেঁ আমি স্বর্গীয় বাবু ব্যোমকেষ ঘোষ-টেমাবাবুর সঙ্গেঁ মায়া মমতা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হই। আমি টেমাবাবুকে দাদা বলে ডাকলেও তিনি আমাকে পুত্র বৎ ¯েœহ মমতা করতেন- আমার মুজিব বলে স¯েœহে কাছে টেনে নিতেন। ষাটের দশকে আমি মৌলভীবাজার কলেজ শাখা ছাত্রলীগ অতঃপর মহকুমা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্ব্বাচিত হই। তৎসঙ্গেঁ সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা, এবং সামাজ কর্ম্মে সম্পৃক্ত ছিলাম। ষাটের দশকে ছাত্রলীগের পেরেন্ট ওর্গেনাইজেশন- আওয়ামীলীগের এখানে সু-সংঘটিত শাখা কিংবা সাংঘঠনিক কার্য্যক্রম ছিলনা। আওয়ামীলীগ প্রধান বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানী প্রতিক্রিয়াশীল কায়েমী শাসক গোষ্টি বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমা শেষে আগরতলা ষঢ়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে দীর্ঘকাল কারারুদ্ধ করে রেখেছিল। তৎকালীন সময়ের বৃহত্তম এবং ছাত্র-জনপ্রিয় ছাত্র সংঘটন ছাত্রলীগকেই তখন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয়দফা কর্ম্মসূচীর প্রসার-প্রচারে মূল দায়িত্ব পালন করতে হত। বাবু ব্যোমকেষ ঘোষ ছিলেন হাতে গুনা দু’চারজন আওয়ামীলীগ নেতার মধ্যে অন্যতম। ফলতঃ আমরা তখন ছাত্রলীগ-নেতাকর্ম্মীগন তার পরামর্শ পেতাম-শুভেচ্ছা নিতাম। শান্তিবাগস্থ বিশাল- ঘোষ লজ ছিল রাজনীতি, সংস্কৃতি, নাট্যাভিনয়, দেশাত্ববোধক গান বাজনার প্রাণ কেন্দ্র্র। বিশেষতঃ নাট্যাভিনয়ের কিন্দ্রবিন্দু ছিল এই ঘোষ লজ। তৎকালীন মহকুমা শহরে এত বিশালাকার বাসা বাড়ি আর কারো ছিলো না। বাবু ব্যোমকেষ ঘোষ, জেলা পরিষদের বর্ত্তমান চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান, বাবু ভূবন মোহন ঘোষ, ডা. এম. এ. ছামাদ, এম.এ খালেক, জহিরুদ্দিন আহমদ, মুজিবুর রহমান মুজিব, হারুনুর রশীদ প্রমুখ স্থানীয় নাট্য আন্দোলনের বলিষ্ট নাট্য সংঘঠক নাট্যাভিনেতা ছিলেন। এদের সকলের শিরোমনি ছিলেন বাবু ব্যোমকেষ ঘোষ। ঘোষ লজেই নাটকের রিহার্সেল হত। তিনি প্রকৃত অর্থে সত্যিকার ভাবেই একজন নাট্য সুহৃদ ও নাট্যজন ছিলেন। সেই ষাটের দশক থেকে আশির দশক পর্য্যন্ত ঘোষ লজ রাজনীতি-সংস্কৃতির প্রানকেন্দ্র ছিল। রাজনৈতিক বিভাজন-বিভক্তি আমাদের ভালোবাসা-সৌহার্দ্য সম্প্রিতিকে বিভক্ত করতে পারেনি। স্বাধীনতা উত্তর কালে ঘোষ লজে গানবাজনা, শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সামাজিক আসরের সঙ্গেঁ গ্রামবাংলার আরেকটি জনপ্রিয় খেলা- দশপচিশ সংযুক্ত হল। আমরা ছয় হাতে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্য্যন্ত শোর-চীৎকার সহকারে খেলতাম। সেই আসরের নিয়িমিত সদস্যদের মধ্যে মরহুম সমাজ কল্যান মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসিন আলী, অধ্যাপক বিমল কান্তি ঘোষ সুজন বাবু, বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ফয়জুর রহমান, বিশিষ্ট আইনজীবী বাবু দ্বিপংকর দাম, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বাবু বিনয় ভূষন দে- প্রমুখ আর আমাদের মধ্যে বেঁচে নেই। তাদের রুহের মাগফিরাত এবং আত্বার শান্তি ও সদগতি কামনা করছি। আমি খুব পান খোর ছিলাম। চা-পান-ধুমপান দিয়েই সময় চলে যেত। এ সময় শ্রীমতি শ্রীলেখা ঘোষের পানের বাটা থেকে ভাজা সাদার গুড়া খাওয়া শুরু করি। ভারতীয় বত্রিশজর্দ্দা আমার খুব প্রিয় ছিল। পানের সঙ্গেঁ ভাজা সাদার গুড়াও খেতে খুবই মুখরোচক লাগত। শ্রীমতি শ্রীলেখা ঘোষ ষাটের দশকে মৌলভীবাজার কলেজে আমার ক্লাশমেট এবং পরে খেলার সাথী হলেও তাঁর সঙ্গেঁ কোনও দিন দেবর-বৌদি সূলভ হালকা রং তামাশা করিনি। তিনি আমার কিঞ্চিত বয়োঃজেষ্ঠা হিসাবে আমাকে ছোট ভাইর মত ¯েœহ মমতা করতেন। আমাকে মুজিব ভাই নয়, স¯েœহে মুজিব বলে নাম ধরেই ডাকতেন। বিগত দশকে আমার অর্ধশত জন্মবাষিকীতে আমাকে জেলা সদরের কবি সাহিত্যক সাংবাদিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে সম্ভর্ধনা দেয়া হয়, আমার কর্ম্ম ও জীবন দর্শনের উপর কবি, আইনজীবী ও মানবাধিকার সংঘটক কিশোরী পদ দেব শ্যামলের সম্পাদনায় এক খানা স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হলে শ্রীমতি শ্রীলেখা ঘোষ- “মুজিব- আমার ছোট ভাই মুজিব”- শিরোনামে একটি আকর্ষনীয় ও সুপাঠ্য রচনা লিখে পাঠান- যা স্মারক গ্রন্থে প্রকাশিত পঠিত ও প্রশংসিত হয়েছিল।
১৯৮৮ সালের ২৫ শে মার্চ রোজ শুক্রবার শ্রীমতি শ্রীলেখা ঘোষের জীবনে একটি শোকাবহ দিন। ঐদিন সকালে মাত্র আটষট্টি বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আকস্মিকভাবে মৃত্যোবরন করেন তার প্রিয় জীবনসঙ্গীঁ যোগ্য স্বামী বাবু ব্যোমকেষ ঘোষ-টেমা বাবু। তাঁকে বিধবা এবং ঝিমলি, খুকু, কাকলি, শ্যামলি এবং একমাত্র পুত্র সন্তান বিমান ঘোষ বিলকু- কে পিতৃহীন করে মহাপ্রস্থানের পথে পাড়ি জমান বাবু ব্যোমকেশ ঘোষ। ঘোষ লজে নেমে আসে শোকের ছায়া। আদর্শ গৃহিনী, সু-মাতা শ্রীমতি শ্রীলেখা ঘোষ শোককে শক্তিতে পরিনত করে সংসারের হাল ধরেন।
ইতিমধ্যে পদ্মা মেঘনা যমুনায় এই মনু কুশিয়ারা আর খোয়াই নদীতে অনেক পানি গড়িয়ে যায়। আমাদের জীবন থেকে বিদায় নেয় অনেক বর্নীল বসন্ত। আমাদের কালের অনেকেই এখন কবরবাসি। বয়োঃবৃদ্ধি, বার্ধক্যজনিত ব্যাধি জীবন সংগ্রামে আমরা কাহিল ও কাবু। সোফাশায়ী-শয্যাশাীয় হয়ে কাল কাটাবার সময় আমরা প্রিয় বৌদি শ্রীমতি শ্রীলেখা ঘোষ হঠাৎ করেই চলে গেলেন। শয্যাশায়ী থাকার কারনে তার সঙ্গেঁ আমার শেষ দেখা হলনা, শেষ কথা বলা গেলনা।
আমি, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ- সংস্কৃতি সেবি, আমার প্রিয় সহপাঠিনী, শ্রদ্ধেও বৌদি শ্রীমতি শ্রীলেখা ঘোষের বিদেহী আত্বার শান্তি ও সদগতি কামনা করছি। তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবার বর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা ও সহানুভূতি জ্ঞাপন করছি।
[লেখক: ষাটের দশকের সাংবাদিক। সাংস্কৃতিক সংঘটক। মুক্তিযোদ্ধা। সিনিয়র এডভোকেট হাই কোর্ট। সাবেক সভাপতি মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব]
মন্তব্য করুন