বিশে জুন-বিশ্ব বাবা দিবসঃ বাবা-আমার বাবা
মুজিবুর রহমান মুজিব॥ বিশে জুন-বিশ্ব বাবা দিবস। বিশ^ব্যাপী দিবসটি উদযাপিত হয় মহাসমারোহে। সাড়ম্ভরে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে। মায়াময় এই নশ^র পৃথিবীতে বসবাস ও অবস্থানকারি বাবাগন সম্মানিত হবেন। সম্ভর্ধিত হবেন। প্রয়াত পিতাগনকে তাঁদের সুসন্তানগন স্মরন করবেন। -“ইছালে ছওয়াব”- মিলাদ মাহফিল-দোয়া খায়ের-কবর জিয়ারত- এর আয়োজন করবেন, -পবিত্র ইসলাম ধর্মের অনুসারি পুত্রগন। কবরস্থান, সমাধি, শ^সানে পুস্পস্তবক প্রদান করতঃ -বেহেশত-স্বর্গবাসি পিতাগনের সু-যোগ্য পুত্রগন রুহের মাগফিরাত, বিদেহী আত্মার শান্তি ও সদগতি কামনা করবেন। যদিও বিশ^ বাবা দিবসে-ই ওল্ডহোম-বৃদ্ধাশ্রমে হতাশার প্রহর গুনবেন-নিরবে অশ্রুপাত করবেন অনেক হতভাগ্য পিতা। যদিও আধুনিক জামানায় ফ্ল্যট বাড়ি সমূহে মেইড রুম থাকলেও পেরেন্টস রুম-বাথরুম নেই।
আমাদের ব্যাক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রীয় জীবন এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ও বিভিন্ন দিবস রয়েছে। শোক দিবস-ছাড়া বিভিন্ন দিবস-উৎসব সমূহ উৎসবি-আমেজে উদযাপন করা হয়। বাবা দিবস সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অত্যাধিক গুরুত্ব বহন না করলেও একজন ব্যাক্তির জীবনে “বাবা দিবস”- এর গুরুত্ব অপরিসীম। কারন একজন ব্যাক্তির জীবনে মানবজীবনের সব চাইতে মূল্যবান সম্পদ, গর্ব ও গৌরবের বিষয় তাঁর বাবা-পিতা-মাতা। পিতা মাতাই একজন সন্তানের অহংকার। অলংকার। পিতা-মাতার কোন বিকল্প নেই।
একজন সন্তানের কাছে -“বাবা”- একটি আবেগ ও অনুভূতির অপর নাম। বটবৃক্ষের ছায়া ও মায়া দিয়ে একজন পিতা তার সন্তানগনকে লালন পালন করেন। মানুষের মত মানুষ করে তুলেন। একজন পিতা তাঁর নিজের জীবনের অপূর্ন স্বপ্ন ও সাধ তাঁর সন্তানের মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন। একজন অশিক্ষিত পিতা তার সন্তানগনকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতঃ মানুষের মত মানুষ করেন। চিত্ত সুখে আত্বতৃপ্তি লাভ করেন। কোন কমপ্লেক্সে ভূগেন না।
যিনি পিতৃহীন তিনি এতিম। একজন এতিম খুবই অসহায়। জাগতিক ধন-দৌলত-বিত্ত-বেসাত যার কাছে যতই থাকুক না কেন তিনি ততই অসহায়। পিতৃ¯েœহ-পিতার মমতা আকাশের মত উদার-সাগরের মত গভীর। বাসন্তি দখিনা হাওয়ার মত নির্মল। অমল ধবল জ্যো¯œার মত সমুজ্জল। অপর পক্ষে একজন এতিমের পৃথিবী অন্ধকার। নিকস কালো আধারে ঢাকা একজন অসহায় এতিমের জীবন।
আমি একজন এতিম। সত্তোর দশকে পিতাকে হারাই। ঘাতক ব্যাধি ক্যেন্সারের কাছে তাকে হার মানতেই হয়েছিল। দেশীয় চিকিৎসা শেষে যখন তার শারিরীক অবস্থা ক্রমশঃ অবনতির দিকে যাচ্ছিল তখন চিকিৎসক ও আমাদের শুভাকাংখীদের পরামর্শে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বৃটেন প্রেরন করা হয়। তখন এখানে এখনকার মত ক্যেমোথেরাপি সহ উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতির প্রচলন ছিলনা। ঘাতক ব্যাধি ক্যেন্সার দূরারোগ্য। মৃত্যো সময়ের ব্যাপার মাত্র। বাবা বৃটেনে যাবার পর চিকিৎসকগন একমাস সময় দেন। মাস পার হয়নি। এক মাসের মাথায় আমার প্রিয় জনক পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতঃ মহান মালিকের দরবারে হাজিরা দেন। আমরা চার ভাই এক বোন এতিম হলাম। আমার মমতা ময়ী মা বিধবা হলেন। আমার বর্নীল বর্নময় পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায়। বাবার ছায়য়-মায়ায়-আহ্লাদে আটখানা হয়ে মনের সুখে শূন্যমার্গে বিচরন করছিলাম-বাবার মৃত্যোর পর ধপাস করে আকাশ থেকে মাটিতে পড়লাম।
আমার জন্মদাতা পিতা সদর উপজেলাধীন রসুলপুর গ্রামের মিয়া বাড়ীর সুসন্তান। আমার দাদা মরহুম মৌলভী মোজাফ্ফর এর প্রথম পুত্র আমার বাবা মোহাম্মদ মমতাজ। বাবার মত আমি ও আমার পরিবারের বাবা-মায়ের জ্যেষ্ট সন্তান। প্রথম সন্তান এবং পুত্র সন্তান হিসাবে দাদা-দাদী পিতা মাতার বড়ই প্রিয় ছিলাম আমি। বৃটিশ ভারতে আমার পিতা কাশিনাথ আলাউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে -“এনট্রান্স”- এর ছাত্রবস্থায় কোলকাতায় চলে যান। ফলতঃ তার পক্ষে -“এনট্রান্স”- পরীক্ষা দেয়া হয়নি। পাশ হয়নি। তার হাতের লেখা অপূর্ব সুন্দর ছিল। তিনি খুবই ভাল ইংরেজী জানতেন। অনর্গল ইংরেজী বলতেন।
বৃটিশ ভারতে কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধি বৃত্তি, ব্যবসা বানিজ্যিক একটি আন্দোলন ছিল। বাবা বৃটিশ ভারতের শেষভাগে কোলকাতা গমন করতঃ শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে কর্ম জীবনে প্রবেশ করেন। পাকিস্থানী আমলের মধ্যভাগে বৃটেন গমন করতঃ বৃটিশ নাগরিকত্ব নিয়ে ক্যাটারিং, রিয়েল এস্টেট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হন। আমার দুই কনিষ্ট ভ্রাতা সহ আমার অসংখ্য আত্বীয় স্বজনকে বাবা বিলেত নিয়ে যান। কর্মসংস্থান করে দেন। আজীবন তিনি প্রবাসে বসবাস ও বানিজ্য করতঃ প্রচুর পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেন। দেশের অর্থনীতির ভিতকে সজবুত করেন। আমার পিতা আমার কাছে শুধুমাত্র দুটি দাবী করেছিলেন, ১. আমাকে বাংলাদেশের সর্ব্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করতঃ মানুষের মত মানুষ হতে হবে, ২. তার কাছে, আমার বিরুদ্ধে কোন নালিশ যেতে পারবে না। মানুষের মত মানুষ না হতে পারি, অমানুষ হই নাই, আর বাংলাদেশের সর্ব্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছি। বাবার ইচ্ছা সুবোধ বালকের মত পূর্ন করেছি। আজীবন -“ফাষ্ট লাইফ”- কাটিয়েছি। ষাটের দশকে আয়ুব-এহিয়ার বিরুদ্ধে ছাত্রগন আন্দোলনে অংশ গ্রহন ও নেতৃত্ব দিয়েছি, একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন ও নেতৃত্ব দিয়েছি, স্বাধীনতাউত্তর কালে দেশের প্রথম বিদ্রোহী বিরোধী দল জাসদে যোগ দিয়েছি, রাজনৈতিক মত পার্থক্যজনিত কারনে আমার, সমাজ ও রাজনীতির অঙ্গনে অনেক প্রতিপক্ষ আছেন, কিন্তু আমার বাবার কাছে আমার বিরুদ্ধে নালিশ যায়নি। আমার চরম দূর্ভাগ্য এই যে, আমার পেশা ও কর্ম্ম জীবনের সূচনায়ই আমি পিতৃহারা হই। এতিম হই। আজকে মহান আল্লাহর অপার মেহেরবানীতে যা কিছু প্রাপ্তি , অর্জন তার সবই -আল্লাহ-রাসুলের পরই আমার বাবার অবদান। পচাঁত্তোর উত্তর রাজনৈতিক সংকট কালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নির্ম্মম ভাবে মৃত্যো বরনের পর দেশে এক ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকট ও শূন্যতার সৃষ্টি হয়। খুনী খন্দকার মুশকাত তখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়।
আমি তখন তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল জাসদের প্রথম কাতারের প্রভাবশালী নেতা। আন্ডার গ্রাউন্ড-অভার গ্রাউন্ড-মিটিং মিছিল, সার্বক্ষনিক রাজনীতি ও সাংবাদিকতা নিয়ে তখন আমি ভীষন ব্যস্থ। এ সময় বাবার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। তিনি আশা পোষন করেন পুত্র বধু দেখে তিনি মৃত্যু বরন করতে চান। আমি নিরূপায় হয়ে মতামত দিলাম। আমার কোন পছন্দ কিংবা ইচ্ছা-অনিচ্ছা নাই বলে জানিয়ে দিলাম। বাবা অনেক কনে দেখলেন। কিন্তু তার কনে পছন্দ হয় না। শেষ মেষ আমাদের শহরেই আমার বিয়ে হল। কনে, বৃটিশ ভারতের খ্যাতিমান সাংবাদিক, নকিব-সম্পাদক মরহুম ছনাওর আলীর কনিষ্ট কন্যা মনোয়ারা বেগমের সহিত বিয়ে হল। ফিরা যাত্রাটি পূর্ন হলনা। বিয়ের কদিন পরই মুশতাক সরকার, সরকার-বিরোধী শক্তি ও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে গ্রেফতার শুরু করলেন। ধরপাকড় শুরু হল। দলীয় নির্দেশে আমাকে আত্মগোপনে যেতে হল। বাবা মনের দিক দিয়ে খুবই কষ্ট পেলেন। তার অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপ হতে থাকল। বৃটিশ নাগরিক হিসাবে তিনি বৃটেন এবং বৃটিশ পতাকাতলে শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করতে চাইলেন। তাঁকে বিলেতে পাঠানো হলে ইন্তেকাল করলেন। লাশ এলো। আমি তখন পলাতক। তার প্রথম পুত্র হিসাবে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। তার সেবা সুশ্রুসা করতে পারিনি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এ দুঃখ বোধ আমাকে এখনও তাড়া করে। কষ্ট দেয়।
বাবার প্রবাস জীবন এবং আমার ব্যস্ত ও পলাতক জীবনের কারনে বাবার আঙ্গুলে ধরে আমার জীবনেই আমার, ঈদের জামায়াতে যাওয়া হয়নি। যেতে পারিনি মেলায়, খেলায়, ঢাকায়, কোলকাতায়। বাবার অবর্তমানে, এ জীবনে যখন ঝড় আসে, কালবৈসাখী তুফান, তখন বুকের ভিতর এক সীমাহীন শুন্যতা অনুভব করি। নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। বাবা নেই। কোন বড় ভাই বোন নেই। মাথার উপর কোন ছায়া নেই। মায়া নেই। তখন বার বার বাবার কথাই মনে পড়ে। সেই ছ’ফুটি দীর্ঘ দেহ। উজ্জল চেহারা। হালকা পাতলা গড়ন। ব্যকব্রাশ করা চুল। উন্নত নাসিকা। রাশভারি-বিনয়ী-ব্যাক্তিত্ববান বাবা। আমার বাবা। শুভ্র-শশ্রু মন্ডিত কোন প্রবাসী কিংবা বাংলাদেশী কোন সিনিওর সিটিজেন দেখলে বুকের ভিতর হাহাকার করে উঠে, হায়রে, বাবা বেঁচে থাকলে তিনি এমনি এ বয়সী হতেন। প্রসঙ্গতঃ সত্তোর দশকে ষাটের কোটা পেরিয়ে তিনি আমাদেরকে ছেড়ে চলে যান। বাবার সেই মৃত্যু পরিনত বয়সের মৃত্যু ছিলনা। এখন আমি নিজেই ষাটোর্ধ। সত্তোরের কোঠায়। মেঘে মেঘ অনেক বেলা হয়ে গেছে আমার। এখন আমার পড়ন্ত বেলা। জীবন সায়াহ্নে এসে বার বার আমার বাবার কথাই মনে পড়ে। পাকিস্তানী গ্রেজুয়েট ছিলাম। মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। স্বাধীন বাংলায় বি.সি.এস এর প্রথম ব্যাচ কিংবা যেকোন চাকরী বাকরি, ব্যবসা বানিজ্য সহজ ছিল। বাবা কিছুই চান নি। বিলেতেও নিয়ে যান নি। বাবা-আমার বাবা শুধু চেয়েছিলেন উচ্চ শিক্ষা নিতে। মানুষের মত মানুষ হতে। সৎ ও আদর্শবান হতে। মহান আল্লাহর রহমতে বাবা মায়ের দোয়ায় আজীবন সৎ থেকেছি। দূর্নীতির কলংক ও কালিমা আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি। যদিও জীবন যুদ্ধে চলার পথে ডানে-বায়ে অনেক সুযোগ ছিল আমার।
বিশে জুন বিশ^ বাবা দিবস। বিশ^ বাবা দিবসে আমার বাবার উজ্জল স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধ নিবেদন করছি। বাবার রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।
বিশে জুন বিশ^ বাবা দিবসে পৃথিবীর সকল পরলোক বাসী বাবাগনের রুহ-আত্মার শান্তি- সদগতি এবং ইহলোকবাসী বাবাদের সু-স্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু ও কল্যান কামনা করছি।
বিশে জুন বিশ^ বাবা দিবস অমর হউক।
[সিনিয়র এডভোকেট হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি ও প্রেসক্লাব। সাংবাদিক। মুক্তিযোদ্ধা]
মন্তব্য করুন