বিশ্বযুদ্ধে রোমাঞ্চ-১

June 22, 2020,

আব্দুল ওয়াহেদ রেজভী॥

বিষের তীর

হঠাৎ দু’চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। এ আমি কি দেখছি! উম্মুক্তকেশী উদ্ধত যৌবনা এক ষোড়শী! কী অপরূপ রূপ! মনে হল স্রষ্টা যেন তাঁর আপন হাতে গড়েছেন এ বেহেশতী হুরকে। তার রূপের ঝলকে আলোকিত হয়ে গেছে চারপাশ। দাঁড়িয়েছিলাম কমলগঞ্জের বিখ্যাত ছলিমবাড়ির বাংলো ঘরের বারান্দায়। হঠাৎ ঘটল ছন্দপতন। আমাকে দেখে সে সচকিত হয়ে উঠল। চঞ্চলা হরিণীর মত ছুটে পালাল। তবে যাবার আগে তার মুচকি হাসি দিয়ে আমার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে গেল। মনে হল লেগেছে বিষাক্ত তীর। এ বিষের জ্বালা আমাকে সহজে নিষ্কৃতি দেবে না। হায়, কী দেখলাম!

হৃদয়জুড়ে বাঁধভাঙ্গা হাহাকার। মন বসে না কোন কাজে। সবকিছু হয়ে গেছে বিস্বাদ। দিন নেই, রাত নেই, চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই মুচকী হাসি। খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। চাতক পাখির মত প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকি একই জায়গায়। কিন্তু সেই পলাতক হরিণীর আর দেখা মেলে না। সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করে অসুখ হয়েছে কি না। কিন্তু আমি তো আমার মনের অসুখের কথা কাউকে জানাতে পারি না। তারপরও জেনে গেল একজন। বাল্যবন্ধু মনিরুল। সে আবার সম্পর্কে ষোড়শীর চাচাতো ভাই। তাকে খুলে বলতেই হল সবকিছু। আমার মনের অবস্থা দেখে মনিরুল আমাকে শান্তনা দিল। বলল, ‘চিন্তা করিস না, একটা না একটা ব্যবস্থা করব।’

কয়েকটা দিন অতিবাহিত হল। কিন্তু কোন ব্যবস্থাই হল না। ওদিকে আমার অস্থিরতাও দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিল। বন্দী পাখির মত ছটফট করছিল মনটা । বারবার ষোড়শীর মুখটা দেখার জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু ষোড়শী তো জমিদার বংশের সন্তান। যদিও এখন তাদের আগের মত সে অবস্থা নাই, তারপরও কঠিন প্রতিবন্ধকতা। অন্দরমহলের কারো সাথে দেখা করা এক কথায় অসম্ভব। নিতান্ত ভাগ্য ছাড়া কারো চেহারা দেখাটাই সম্ভব নয়। আমি বোধহয় ছিলাম এক সৌভাগ্যবান। তাই হয়ত এক পলকের জন্য একটু দেখা পেয়েছিলাম সেই বেহেশতী হুরের। এখন মনে হচ্ছে এখানে সারাজীবন পড়ে থাকলেও আর তার দেখা পাব না।

মনিরুলকে বারবার বিরক্ত করছিলাম। কিন্তু সে কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না। আমাকে ধৈর্য্য ধরার জন্য বারবার উপদেশ দিয়েই যাচ্ছিল। অবশেষে আমি আর ধৈর্য্য রাখতে না পেরে মনিরুলকে বললাম, ‘ভাই, একটা কিছু কর।’

মনিরুল তার সেই ভাঙা রেকর্ড আবারো বাজিয়ে উত্তর দিল, ‘আর একটু অপেক্ষা কর।’

আমি প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘অপেক্ষা তো অনেক করলাম। আর কত করতে হবে?’

মনিরুল বলল, ‘এসব ব্যাপারে হুট করে কিছু তো করা যায় না। আমি চেষ্টা করেই যাচ্ছি। একটু সুযোগ পেলেই আমি আমিরাকে তোর কথা বলব।’

মনিরুলের কাছ থেকেই জানতে পারলাম আমার সেই হৃদয় হরণ করা প্রেয়সীর নাম চৌধুরী আমিরুন্নেছা খানম। ডাক নাম আমিরা। বাল্যকালে মাতৃবিয়োগ হওয়ায় তার পিতা ওয়াজেদ আলী চৌধুরী পড়েছিলেন মহাবিপাকে। তখন এগিয়ে এসেছিলেন আমিরুন্নেছার বড় খালা। বড় খালু খান বাহাদুর বজলুল হাসান তখন ছিলেন মুর্শিদাবাদে। সেখানেই বাল্যকাল কেটেছে এই ষোড়শীর। সব শুনে আমি ষোড়শীর নাম দিলাম ‘কুইন অব মুর্শিদাবাদ’।

ওদিকে মনিরুলের ধীরগতির চলা আমার মোটেই সহ্য হচ্ছিল না। বললাম, ‘এভাবে চাতক পাখির মত আমি হা করে সারাজীবন বসে থাকতে পারব না।’

মনিরুল বলল, ‘প্রেম করতে হলে একটু ধৈর্য্য ধরতেই হবে। এটাই তো প্রেমের পরীক্ষা।’

প্রেমে পড়লে মনটা সাহসী হয়ে উঠে। উপায়ান্তর না দেখে আমাকেও সাহসী হয়ে উঠতে হল। মনিরুলকে বললাম, ‘এক কাজ কর। তোর দ্বারা প্রেমের ঘটকালি করা সম্ভব হবে না। তবে বিয়ের ঘটকালি তো করতে পারবি। আমি আমিরাকে বিয়ে করতে চাই। তুই এ প্রস্তাবটা অন্তত তার বাবার কাছে উত্থাপন কর। দেখি ভাগ্যে কী লিখা আছে।’

মনিরুল দেখল আমি নাছোড়বান্দা। আমার চাপাচাপিতে অবশেষে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আমিরার পিতার কাছে যেতে রাজী হল।

এভাবেই কোন এক অজানা মুহূর্তে বন্ধু মনিরুলকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালাম। সাথে সাথে আমিরার পিতার নিকট থেকে উত্তর এল, ‘পাত্র রোজগারের উপযুক্ত হোক। তারপর দেখা যাবে!’

 [আব্দুল ওয়াহেদ রেজভী, চল্লিশের দশকের মুসলিম কবি (১৪.১.১৯১৯-১৬.৪.১৯৮৪)]

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com