বিশ্বযুদ্ধে রোমাঞ্চ-২
আব্দুল ওয়াহেদ রেজভী॥
সংকল্প
১লা মার্চ, ১৯৪২।
ইচ্ছে হল সিলেট যাব।
মনটা তখন ভীষণ খারাপ।
জীবন ছিল অনিশ্চিত ও চঞ্চল।
‘কুইন অব মুর্শিদাবাদ’ ষোড়শীর পিতার ছোট্ট ডায়লগটি আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। জমিদারের উত্তরপুরুষ কথা বলেছেন জমিদারী ভঙ্গিতেই। মনিরুলকে কোন কটু কথা বলেননি। আমাকে কোন অপমান করেননি। তবে এমন কথা বলেছেন, আমার মনটা হয়েছে বজ্রাহত। মনের ভেতরে চেপে গেছে ভয়ংকর জেদ। হিন্দী সিনেমার নায়কের মত গ্রহণ করলাম চ্যালেঞ্জ। দেখি রোজগারী হতে পারি কিনা!
বেকার জীবনকে কর্মঠ করে তোলার মনোবাসনা বারবার মনটাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। ঘুরেফিরে উপযুক্ত হবার চিন্তাও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু কীভাবে? অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম প্রয়োজন পড়লে যুদ্ধে চলে যাব। কিন্তু উপযুক্ত না হয়ে আর ষোড়শীর পিতার মুখোমুখি হব না। কবি কালিদাস যদি প্রেয়সীর জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষার প্রহর গুণতে পারে, আমি তো সে তুলনায় তুচ্ছ! পণ্ করলাম, ‘মন্ত্রের সাধন, না হয় শরীর পতন!’ দৃঢ় সংকল্প নিয়ে সিলেট পৌঁছে বড় ভাইয়ের বাসায় আস্তানা গাড়লাম।
উপযুক্ত হবার যুদ্ধ
বিশ্বযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। এদিকে ব্রিটিশ ভারতে দুই প্রধান রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নিজ নিজ পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত। বৃটিশরাজ ভারতীয়দেরকে যুদ্ধে রিক্রুট করতে লিপ্ত। গান্ধীজীর উপদেশ ছিল, বৃটিশদের পক্ষে যুদ্ধে সাড়া না দেয়া। আবার নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বাধীন দল চাইছিল সরাসরি ব্রিটিশদের বিপক্ষে অবস্থান করে যুদ্ধের সুযোগে ব্রিটিশদেরকে বিতাড়ন করা। অপরদিকে জিন্নাহ সাহেব দেখলেন মুসলমানরা পিছিয়ে আছে। এমতাবস্থায় বৃটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করতে হলে মুসলমানদের যুদ্ধে যোগদান করা নিতান্ত প্রয়োজন। তাঁর উপদেশ ছিল যুদ্ধে যোগদান করা।
আমার ভাবনায় তখন বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়াটা প্রাধান্য পাচ্ছিল। মানুষের মত মানুষ হতে হবে। মরণের ভয় করে লাভ নেই। কাজেই স্থির সিদ্ধান্ত নিলাম যুদ্ধেই চলে যাব। ভাবলাম প্রথম যদি ডধৎ ঞবপহরপরধহ হিসেবে ভর্তি হই, তাহলে বেতন পাব মাসিক ২৫ টাকা। হয়ত পরে অন্য পথ ধরতে পারব।
বড় ভাইকে সিদ্ধান্তটা জানালাম। তিনি সোজাসুজি বলে বসলেন, ‘কি দরকার তোমার যুদ্ধে যাবার? এত টাকা খাবে কে!’ কিন্তু আমার তখন বাঁধভাঙ্গা মন। সেই মনের মধ্যে চলছে আরেক যুদ্ধ। সে যুদ্ধ মানুষ হবার। সে যুদ্ধ উপযুক্ত হবার। বেকার থাকতে মন চাইছে না। ঘুরেফিরে একই চিন্তা, ‘উপযুক্ত হতে না পারলে বেঁচে থেকে লাভ কী?’ আমার পীড়াপীড়িতে বড়ভাই খুবই বিরক্ত হলেন। যখন দেখলেন, আমাকে আর আটকে রাখা যাবে না তখন বললেন, ‘ঠিক আছে। আমি দেখছি।’
বড়ভাই যা করলেন, আমি হয়ে গেলাম হতভম্ব! তিনি চলে গিয়েছিলেন সিলেটের এক বড় অফিসারের কাছে। সেখান থেকে সুপারিশপত্র নিয়ে এলেন, যাতে মিলিটারীতে কেরানীর কাজে ভর্তি হতে পারি। মাসিক বেতন ৬০টাকা। আমি স্তম্ভিত! কোথায় ২৫টাকা আর কোথায় ৬০টাকা! মনটা খুশিতে নেচে উঠল। আনন্দে জড়িয়ে ধরলাম বড় ভাইকে।
ইন্টারভিউ
উপযুক্ত হবার নেশায় আমি বাঘের সম্মুখেও যেতে প্রস্তুত ছিলাম। তবে আপাতত বাঘের সম্মুখে যেতে হল না। গেলাম প্রফেসর আবুল লেইস সাহেবের কাছে। তাঁর সঙ্গেই Interview দিতে গেলাম। তিনিই রিক্রুটিং অফিসার। আমাকে পেয়ে তিনি তো ভীষণ খুশি। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি আজ যেতে পারবে?’ আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম! এত সহজ ওহঃবৎারব?ি এক কথায় চাকরী হয়ে গেল? সুযোগ ছাড়ে কে! জীবনে অনেক সুযোগ হারিয়েছি। সুযোগ তো সব সময় আসে না। সুযোগ একবার হারালে সারাজীবন আফসোস করে কাটাতে হবে। কাজেই কোন দ্বিধা করলাম না। সাথে সাথেই দৃঢ়চিত্তে উত্তর দিয়ে দিলাম, ‘হ্যাঁ, পারব।’ ব্যস, বাকী থাকল ডাক্তারী পরীক্ষা। বিকাল ৩টায় তাও হয়ে গেল। পাশ করলাম। সেদিন ছিল মার্চ মাসের ৩ তারিখ। এসেছিলাম ১ তারিখ। দুইদিনেই চাকরী! আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শোকরিয়া জানালাম। আমার মনে হল স্রষ্টা যেন আমার দৃঢ়সংকল্প দেখেই মনোবাসনা পূর্ণ করেছেন। আমার মোনাজাত কবুল করেছেন।
[আব্দুল ওয়াহেদ রেজভী, চল্লিশের দশকের মুসলিম কবি (১৪.১.১৯১৯-১৬.৪.১৯৮৪)]
মন্তব্য করুন