বিশ্বযুদ্ধে রোমাঞ্চ-৩
আব্দুল ওয়াহেদ রেজভী॥
অতীত স্মৃতি
আমার পিতা আব্দুল আজহার রেজভী ছিলেন এক প্রখ্যাত খানদানী পরিবারের বংশধর। পূর্বপুরুষ বসত পত্তন করেছিলেন রাজনগর থানার মেলাঘর মৌজায়। সেটা ১৮৪০ সালের পূর্বের ঘটনা। জায়গা বন্দোবস্ত নিয়েছিলেন বৃটিশদের নিকট হতে। কিন্তু পূর্বপুরুষদের প্রতাপে জর্জরিত হয়েছিল সেই এলাকা।
আমার পিতামহের অকালমৃত্যুতে বিখ্যাত ক্রোড়ী বংশজ বিধবা দাদী পড়লেন মহাবিপাকে। অবশেষে তিনি আমার পিতাকে নিয়ে চলে এলেন কমলগঞ্জ থানার মাধবপুর গ্রামে। এখানেই আমার জন্ম হল। দিনটি ছিল রবিবার। ১লা মাঘ, ১৩২৫ বাংলা। ১৯১৯ সালের ১৪ জানুয়ারি। কিন্তু দূর্ভাগ্য তখনও পিছু ছাড়েনি। আমার জন্মের বছর খানেক পরই পিতৃবিয়োগ হল। বড় ভাই তখন ৮ম শ্রেণির ছাত্র। তার উপরই পড়ল সংসারের ভার।
একমাত্র ফুফুর বাড়ি ছিল লংলার রাউৎগাঁও। সেখানে থেকে বড় ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে রাউৎগাঁও মাদ্রাসা থেকে জুনিয়র মাদ্রাসা পাশ করলাম। সালটা ছিল ১৯৩৪। তখন সবেমাত্র কমলগঞ্জ হাইস্কুলের যাত্রা শুরু হয়েছে। স্কুলে গিয়ে সেক্রেটারী সাহেবকে অনুরোধ করতেই তিনি বিনা বেতনে আমাকে পড়ার সুযোগ করে দিলেন। ১৯৩৮ সালে এখান থেকেই কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা পাশ করলাম।
এবার শুরু হলে কর্মের সন্ধানে যাত্রা। চলে গেলাম সিলেট শহরে। বড় ভাইয়ের বাসায় থেকে ইংরেজি টাইপিং শিখে ফেললাম। ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানদের চাকুরী পাওয়াটা এত সহজ নয়। তারপরও চাকুরীর জন্য অনুসন্ধান চালালাম। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত সিলেটে কোন চাকুরী হল না। অগত্যা, কি আর করা? পাড়ি জমালাম আসাম। লক্ষীমপুর জেলার নাহার কাটিয়াতে বছর খানেক থাকলাম। কিন্তু সেখানে কিছুতেই মনটা বসছিল না। কাজেই সেখান থেকে বাড়ি ফিরে এলাম ১৯৪০ সালে।
কিছুদিন বাড়িতে অবস্থান করার পর আবার সিলেট গেলাম। তবে এবার আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হল না। কয়েকদিন পরই চাকুরী পেয়ে গেলাম। প্রধান শিক্ষকের চাকুরী। তবে যেতে হবে ত্রিপুরার কৈলাশহরে। কৈলাশহর জায়গাটা আমাদের বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে নয়। সেখানে টিলাবাজার মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলাম। বেতন মাসিক দশ টাকা। তবে থাকা-খাওয়া ফ্রি। আমার জন্য এটাই হল বিরাট এক পাওনা। সরকারি চাকুরী পাবার আক্ষেপটা দূর হল। ভাবলাম এরকম চাকুরীই বা কয়জনের ভাগ্যে জোটে? থাকা-খাওয়াসহ বেতন তো বেশ ভালই। এলাকায় যথেষ্ট সম্মানও পাওয়া যাচ্ছে।
টিলাবাজার মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক হিসেবে সম্মানের সাথেই একটি বছর কাটিয়ে দিলাম। কিন্তু আসামে যে কারণে ভাল লাগেনি, এখানেও একই সমস্যার সৃষ্টি হল। সেটা হল ‘হোম সিকনেস’। মাকে দেখার জন্য মনটা ছটফট করছিল। বাড়ির জন্যও মনটা কেমন কেমন করছিল। ছুটির জন্য আবেদন করলাম। কিন্তু ছুটি পাওয়া যাবে না। প্রধান শিক্ষক ছুটিতে গেলে মাদ্রাসা চলবে কী করে? চার্জ গ্রহণ করবে, সেরকম যোগ্যতাসম্পন্নও কেউ ছিল না। কী আর করা! উপায়ান্তর না দেখে রেগেমেগে চাকুরীতে ইস্তফা দিয়ে ফিরে এলাম বাড়িতে। আমাকে পেয়ে মায়ের খুশির সীমা নাই। এবার আর মা কিছুতেই আর আমাকে দূরে ছাড়তে রাজী নন। খুশিমনেই মায়ের শাসনটুকু মেনে নিলাম। তবে আকস্মিকভাবে চাকুরী জুটে গেল কাছেই। শ্রীনাথপুর গ্রামে। মাকে জানালাম। কাছে থাকতে পারব জেনে মাও আর আপত্তি জানালেন না। সপ্তাহে সপ্তাহে বাড়িতে আসতে পারব। মন্দ নয়।
ছলিমউল্লাহ নামের এক প্রখ্যাত জমিদার ভাদেশ্বর থেকে শ্রীনাথপুর গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। কালক্রমে সেই জমিদার বাড়িটি ছলিমবাড়ী নামে সর্বত্র পরিচিতি লাভ করে। বিশাল বাড়ি। জমিদার বংশের অনেকগুলো পরিবার সেখানে বসবাস করে। খানদানী প্রথা অনুসারে তারা খানদানী পরিবার কিংবা নিজেদের বংশ ছাড়া অন্য কারো সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হত না। এখনও তাদের বাড়িতে ভেতরে অন্দরমহল এবং সামনে বহির্বাটিতে বাংলো টাইপের বাড়ি বিদ্যমান। মেহমান কিংবা আত্মীয়স্বজন এলে বহির্বাটিতে থাকার বন্দোবস্ত হয়। আমারও থাকার ব্যবস্থা হল সেখানেই। চাকুরীটি প্রাইভেট শিক্ষকের। বেতন মাসিক পাঁচ টাকা। তারা প্রধান শিক্ষক হিসেবে আমার চাকুরীর খবর পেয়েছিল। তাই অনেকটা জোর করেই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিল। বেতন যদিও একটু কম, তবে বাড়ির কাছাকাছি থাকায় আমি সানন্দে রাজী হয়েছিলাম।
ছলিমবাড়ির বহির্বাটির বারান্দায় দাঁড়িয়েই আমি দেখেছিলাম সেই উম্মুক্তকেশী উদ্ধত যৌবনা ষোড়শীকে! সেই ষোড়শীর নাম দিয়েছিলাম ‘কুইন অব মুর্শিদাবাদ’। নিয়তির কি পরিহাস, ‘হোম সিকনেসে’ আক্রান্ত সেই আমিই কি না এখন যাচ্ছি আওরঙ্গাবাদ। না জানি সেখান থেকে গন্তব্য কোথায় হবে? আমার মন বলছে ভারতবর্ষে আর থাকা হবে না! অজানা গন্তব্যের কথা চিন্তা করতে করতেই তলিয়ে গেলাম ঘুমের অতল গহ্বরে।
[আব্দুল ওয়াহেদ রেজভী, চল্লিশের দশকের মুসলিম কবি (১৪.১.১৯১৯-১৬.৪.১৯৮৪)]
মন্তব্য করুন