বিশ্বযুদ্ধে রোমাঞ্চ-৪
আব্দুল ওয়াহেদ রেজভী॥
আওরঙ্গাবাদ
লৌহ অশ্ব ভোর চারটায় চাঁদপুর এসে পৌঁছল। প্রায় পক্ষকাল পূর্বে যে চাঁদপুর নিজের খরচে আসব মনস্থ করেছিলাম, আজ কিনা বিনা পয়সায় হাজির হলাম! প্রচন্ড হুড়াহুড়িতে কল্পনার রাজ্য ছেড়ে বাস্তবে পদার্পন করলাম। সবাই স্টিমারের উদ্দেশ্যে ছুটছে। আমিও সে ছুটোছুটিতে সামিল হলাম। ভাগ্য ভালো, ধাক্কাধাক্কি করে কোনক্রমে স্টিমারে একটু স্থান পেতে না পেতেই হু হু করে স্টিমারটি ছুটে চলল। মনে প্রচন্ড আনন্দ! জীবনে কোনদিন স্টিমার চড়িনি। আজ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমার মনের আশা পূর্ণ করেছেন। মনের সুখে মেঘনা নদীর বুকে স্টিমারে চড়ে চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলাম। মনে হল বেঁচে থাকা কত আনন্দের!
এদিকে রিক্রুটের দলের মধ্যে যারা বসার জায়গা পায়নি তারা হুড়াহুড়ি করতেই লাগল। আমার মনে তখন স্টিমার চড়া ছাড়া আর কোন আনন্দ নেই। সঙ্গীহীন চাতক পাখির মত আকাশ পাতাল ভাবছি। কয়েকদিন আগেও ছিলাম কোন জগতে, আর এখন কোথায়!
অপরাহ্ন ৩টায় স্টিমারটি গোয়ালন্দ ঘাটে এসে হাজির। আবার হুড়াহুড়ি। আমিও তল্পিতল্পা নিয়ে স্টিমার থেকে নামলাম। নেমে দেখি রিজার্ভ গাড়িও হাজির। দ্বিরুক্তি না করে উঠে বসলাম গাড়িতে।
এবার আর A.B.R.(Assam Bengal Railway) এর লৌহ অশ্ব নয়, এটা E.B.R.(East Bengal Railway) এর লৌহ ঘোটক। আমরা দুজন আওরাঙ্গাবাদ যাত্রী কেরাণী শিয়ালদহ হয়ে যাবার কথা ছিল, কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ E.I.R.(East Indial Railway) হয়ে হাওড়া যেতে আদেশ করেছেন। কি আর করা! রাত ৮টার সময় নৈহাটি জংশনে নেমে E.I.R.এর ট্রেনে চড়ে শ্রীরামপুর, চন্দননগর, হুগলী হয়ে রাত ১০টায় হাওড়া পৌঁছলাম। সেখানে পৌঁছে দেখি আমাদের বাহন হাওড়া ছেড়ে চলে গেছে! পড়লাম আরেক বিপদে। খোঁজ নিয়ে জানলাম পরদিন দুপুর বারটার আগে আর কোন ট্রেন নেই। দুঃখ হল আওরঙ্গাবাদ পৌঁছা হল না। তবে বিপরীতে হিত হল। কলিকাতা শহর দেখিনি। এবার কলিকাতা শহরটি দেখার সৌভাগ্য হবে।
ভোরে উঠে টাইমটেবিল দেখে ঠিক করলাম সন্ধ্যার গাড়িতে যাব। সকাল ৮টার দিকে আমার ফিরুজপুর যাত্রী বন্ধুটির সঙ্গে হাওড়ার পুল পার হয়ে চিতপুর রোড, ধর্মতলা রোড দিয়ে জিপিও, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, গ্রেট চার্চ দেখে ট্রাম চড়ে হাওড়া চলে এলাম।
ছাতুখুরের দেশ
৯ মার্চ কলিকাতা শহর দেখে মাদ্রাজ মেইলে যাবার কথা ছিল। কিন্তু তা না করে চড়ে বসলাম বোম্বে মেইল ট্রেনে। এখন B.N.R.(Bengal Nagpur Railway) এর লৌহ ঘোটক। সারারাত কাটল ট্রেনে। ভোর হল। কিন্তু চলার শেষ নেই। আবারও রাত নামল। ভোর হল। ভোর ৩টায় পৌঁছলাম দাক্ষিনাত্যের মন্তুমড় জংশনে। আবারও দুঃসংবাদ। আমরা পৌঁছানোর আগেই চলে গেছে আওরাঙ্গাবাদের ট্রেনটি! পরের ট্রেন দুপুর বারোটায়। আমার জন্য অবশ্য ব্যাপারটি খারাপ হল না। হাতে সময় পেলাম অনেক। যাক, মন্তুমড় শহরটি ঘুরে দেখার সুযোগ তো হল।
ছাতুখুরের দেশ আর গর্দভের দল। গর্দভ কোনদিন দেখিনি। অবাক নয়নে গর্দভ দেখলাম। অনেককে অনেকবার গালি দিয়েছি, নিজেও গালি খেয়েছি- সেই গর্দভ আজ চোখের সামনে! আরও আশ্চর্য হয়ে দেখলাম দাক্ষিনাত্যের মেয়েরা কাপড় পরে কাছা দিয়ে। মনের আনন্দে শহরটি দাপিয়ে বেড়াতে থাকলাম। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে!
দুপুর বারোটায় জংশনটির ৫ নং প্ল্যাটফরমে এসে দাঁড়ালাম। এখন আর B.N.R. bq, N.S.R.(Nizam State Railway). লক্ষ করলাম N.S.R.এর লাইন Standard Gauge. মনে পড়ল A.B.R.এর লাইন ছিল Metre Gauge. অন্যদিকে E.B.R, E.I.R I B.N.R এর লাইন Broad Gauge ছিল।
আমার স্বপ্ন পূরণ হল ১১ মার্চ, অপরাহ্ন ৩টায়। পৌঁছে গেছি আওরঙ্গাবাদ রেলস্টেশনে। সেখান থেকে রওনা হলাম আওরঙ্গাবাদ মিলিটারী ডিপোর উদ্দেশ্যে। আমার সাথে আছেন ফেঞ্চুগঞ্জের আরেকজন কেরাণী, মগফুরুল করিম। টঙ্গাযোগে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। রিসেপশন ক্লার্ক এসে আমাদেরকে একজন সিপাহী দিয়ে ‘A’ Company এর হাবিলদারের জিম্মা করে দিল। হাবিলদার আমাদেরকে মুসলমান লঙ্গরখানা অর্থাৎ মুসলমান বাবুর্চিখানা দেখিয়ে দিলেন। কিন্তু সমস্যায় পড়লাম। আমাদের সাথে তো কোন প্লেইটই নেই। আমাদের দুর্দশা দেখে এগিয়ে এলেন ঢাকার একজন মুসলমান কেরাণী। তিনি একটি প্লেইট জোগাড় করে দিলেন। খেলাম রুটি ও চাপাতি, যা জীবনে কখনো খাইনি। প্রথমদিকে একটি রুটি খেয়েই পেট ভরে যেত। পরবর্তীতে দুটি করে খেতাম। একদিন মাংস পেয়ে তিনটিও খেয়ে ফেলেছিলাম।
[আব্দুল ওয়াহেদ রেজভী, চল্লিশের দশকের মুসলিম কবি (১৪.১.১৯১৯-১৬.৪.১৯৮৪)]
মন্তব্য করুন