বিশ্বযুদ্ধে রোমাঞ্চ-৫
আব্দুল ওয়াহেদ রেজভী॥
Clerk’s Training School
১২ মার্চ। আমাদের Sheet Roll তৈরি হল। শুনলাম পরদিন থেকে নাকি আমাদেরকে Clerk’s Training School এ যেতে হবে। ভাবলাম এটা আবার কী ধরণের স্কুল?
যাক, পরদিন স্কুলে গেলাম। কেরাণিদের নোটবুক, কাগজপত্র যা দেখলাম তাতে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ! সত্যিকার অর্থে এসব দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। ভয় পাবারই কথা। কেরাণিদের কাজে এতসব হিসাব-কিতাবের ব্যাপার-স্যাপার যে আছে, তাই বা কে জানত। একবার মনে হল, দরকার নেই চাকুরীর!
হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার এ অবস্থা দেখে একজন বলল, ‘ভাই, বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকবেন না। আপনার এ অবস্থা দেখলে dischargeকরে দেবে।’
কথাটা অন্যদের কাছে আতংকের হলেও আমার কাছে মোটেও ভয়ংকর কিছু মনে হল না। ভাবলাম discharge হয়েই না হয় চলে যাই! ভাগ্য ভালো, Instractar এর ছিল জ্বর। দুদিন তিনি স্কুলে না আসায় মনটা ফূর্তিতে ভরে উঠল।
১৮ মার্চ একটু ছুটি পেলাম। আর যায় কোথায়, হুটোপুটি করে খাওয়াদাওয়া সেরে নিলাম। বিকাল ৪টায় বেরিয়ে পড়লাম স্বপ্নের শহরের পুরোকীর্তিগুলো দেখার উদ্দেশ্যে। সঙ্গী হিসেবে পেলাম আরো তিনজন কেরাণিকে।
আওরাঙ্গাবাদ চতুর্দিকে দেয়ালের মত পাহাড়ঘেরা একটি শহর। ধন্যবাদ দেই মহামান্য সম্রাট আওরঙ্গজেবকে, তাঁর বুদ্ধিমত্তার জন্য। প্রথমে গিয়েই দেখলাম বেগমপুর। রাস্তা, দোকানপাট, দালানের নামগন্ধও এখানে নেই। তারপর গেলাম মুকবিয়া। এখানে নাকি আওরঙ্গজেবের স্ত্রী রাবেয়া দুররানীর মাজার। লোকে বলে সেটি নাকি দ্বিতীয় তাজমহল। সেখানে গিয়ে স্তম্ভিত হলাম। বাস্তবিকই সেটি দ্বিতীয় তাজমহলই বটে। প্রথম গেইট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। মর্মর পাথর দিয়ে নির্মিত ফুটপাত। দুপাশে ফুলের বাগান। সাথে ছোট ছোট ঝরনা। চারিদিকে স্কয়ার সাইজের ছোট ছোট বাগান। বাগানের মাঝখানে পাকা করা বসার জায়গা আছে, পার্কেরই মত। মাজারটি তাজমহলের মতই। চারকোণে চারটি মিনার। মিনারের উপরেও উঠা যায়। মাজার দোতলায় অবস্থিত। সেখানে উঠলাম। মাজারের সামনেও ফোয়ারা। চারদিকেও ফোয়ারা। রাবেয়া দুররানীর মাজারের প্রথম গেটে ফোয়ারার মধ্যে রং বেরংয়ের ছোট ছোট মাছ মহানন্দে সাঁতার কাটছে- এমন দৃশ্যও দেখতে পেলাম। কবরটি একটি সুন্দর জায়গায় অবস্থিত। দোতালা থেকে নিচের দিকে একটি সুড়ঙ্গও আছে। সেদিকেই ধাবিত হলাম। গিয়ে দেখি সেখানে কবরের একটি কামরা। কবরটি মর্মর পাথর দ্বারা পাকা করা হয়েছে। দরজার মধ্যে পুরনো অক্ষরে ফারসীতে কিছু লিখা আছে। কবর জিয়ারত করলাম। মাটির নিচে যেখানে সৈন্য-সামন্ত থাকত তাও দেখে নিলাম।
এবার পানীচৌকির ঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। আওরঙ্গজেবের মেয়ে কবি জেবুন্নেছা। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কন্যা কবি জেবুন্নেসার মায়ের নাম সম্রাজ্ঞী দিলরাস বানু। জেবুন্নেসা তিন বছর বয়সে পবিত্র কোরআন শরীফ পড়তে পারতেন এবং সাত বছর বয়সে কোরানে হাফেজা হয়েছিলেন। এতে মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। প্রচণ্ড খুশি হয়ে তিনি মেয়েকে ৩০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা উপহার দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় একদিন সরকারী ছুটি ঘোষণা করেছিলেন এবং বিরাট ভোজের আয়োজন করেছিলেন। জেবুন্নেছা হাফেজা হওয়ার পর আরবি, ফারসি আর উর্দু ভাষায়ও দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।
কবি জেবুন্নেছার একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। সেটি হল, ‘পারস্যের বাদশা স্বপ্নের মধ্যে একটি ছত্র পেয়েছিলেন।
‘দুররে আবলাক কাসে কমদিদা মওজুদ’ (সাদা-কালো মিশ্রিত রঙের মোতির প্রত্যক্ষদর্শী বিরল)।
তিনি দেশের কবি সাহিত্যিকদের আহবান করলেন এর সাথে মিলিয়ে অনুরূপ আরেকটি ছত্র লেখার জন্য। কিন্ত কেউই এর সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেনি। দিল্লীর দরবারেও সেই ছত্রটি পাঠানো হয়েছিল।
ছত্রটি পেয়ে অত্যন্ত প্রতিভাধর কবি জেবুন্নেছা একটু চোখ বুলিয়েই লিখেছিলেন-
‘মাগার আশকে বুতানে সুরমা আলুদ’ (কিন্তু সুরমা পরা চোখের অশ্রুবিন্দুতে ঐ মোতির প্রাচুর্য)
পরবর্তীতে পারস্যের বাদশাহ কবি জেবুন্নেছার বুদ্ধিমত্তা এবং অসাধারণ ছন্দ সৃষ্টির দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে আরেকটি কবিতায় ইঙ্গিতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু বুদ্ধিমতি জেবুন্নেছাও কবিতার মাধ্যমে সুন্দরভাবে প্রত্যাখ্যান করে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ফুলের সুবাসের মত ফুলের ভেতরেই আমি লুকিয়ে আছি। যে আমায় দেখতে চায়, সে আমাকে আমার লেখার মধ্যেই দেখতে পাবে।’
কবি জেবুন্নেছা যে ঘাটে গোছল করতেন, আজো তা সাক্ষ্য দিচ্ছে। যে কামরায় বসে জেবুন্নেছা কবিতা লিখতেন, তা আজো বিদ্যমান। আওরঙ্গজেবের স্বহস্তে লিখিত পবিত্র কোরআন শরীফটি সুন্দরভাবে রক্ষিত আছে। আওরঙ্গজেবকে পড়াতেন যে উস্তাদ, তাঁর কবরও জিয়ারত করলাম। এরপর গেলাম আওরাঙ্গাবাদ সিটি দেখতে। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। তাই তাড়াতাড়ি সবকিছু দেখার সাধ মিটিয়ে মিলিটারী ডিপোতে চলে গেলাম।
[আব্দুল ওয়াহেদ রেজভী, চল্লিশের দশকের মুসলিম কবি (১৪.১.১৯১৯-১৬.৪.১৯৮৪)]
মন্তব্য করুন