বিশ্বযুদ্ধে রোমাঞ্চ-৬
আব্দুল ওয়াহেদ রেজভী॥
বিদায় ভারতবর্ষ
যথারীতি চতুর্থ দিনেও স্কুলে এলাম। এবার মুখোমুখি হতে হবে ওহংঃৎধপঃধৎ এর। মনে ভয়। তবে মনটাকে শক্ত করে নিলাম। আগে ডিসচার্জ হয়ে ফেরত যাবার যে চিন্তাটা মনের মধ্যে প্রবেশ করেছিল, তা অবশ্য দূর হয়েছে। এখন কীভাবে টিকে থাকতে পারি, সে ভাবনটাই মনটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তাই মনে মনে নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছিলাম। বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। বোবার মত কথা না বলেও থাকা যাবে না।
যথাসময়ে Instractarসাহেব আমাকে তলব করলেন। ভয়ে ভয়ে তার মুখোমুখি হলাম। গুরুগম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেরাণিগিরির কাজ জানা আছে কি না?’ ফস করে উত্তর দিয়ে বসলাম, ‘জী, হ্যাঁ।’ কথাটা মুখ ফসকেই বেরিয়ে পড়েছিল। তাই মনে মনে আঁতকে উঠেছিলাম। ভেবেছিলাম Instractarসাহেব বোধহয় আমাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করে ফেলবেন। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি আর কোন প্রশ্ন করলেন না। সেদিনই নোট না দিয়ে Detailকরে দিলেন Draftএর জন্য। এর মানে বিদেশ পাঠাবার জন্য আমাকে মনোনীত করে দেয়া হল। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। দেশ ছেড়ে চলে যাব ভেবে মনটা একটু হাহাকার করছিল। তবে সেই মুহূর্তেই মনের মধ্যে জাগ্রত হল আমাকে তো উপযুক্ত হতেই হবে- এ উপলব্ধিটুকু। তাই সকল চিন্তা মন থেকে দূর করে দিয়ে বিদেশযাত্রার জন্য মনটাকে প্রস্তুত করতে থাকলাম।Overseasযাওয়ার বন্দোবস্ত হতে লাগল। আওরাঙ্গাবাদে টিকা ও ইনজেকশনসহ দু’বার ডাক্তারী পরীক্ষা করা হল। মনের মধ্যে সামান্য হলেও ভয় ভয় ভাব বিরাজমান ছিল। তবে ভাগ্যক্রমে সবকিছুই আমার অনুকুলে চলছিল।
১৯ মার্চ। Training School এ লেকচার শুনছি, হঠাৎ Orderlyএসে হাজির। আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে। ভাবলাম এ আবার কোন বিপদ! তাই তাড়াতাড়ি গেলাম। Orderlyআমাকে সরাসরি স্টোররুমে নিয়ে গেল Kitsপোষাক এর জন্য। এ আবার কোন বিপদ! Kit আবার কী? Draftএ যেতে হবে। কেন বা কোথায়, তার কোন খবর নেই। দিল Indian Kit মানে Hat| মনে মনে খুশি হলাম। ভাবলাম, বোধহয় India-
তেই রাখবে। এটাও অবশ্য মন্দ হয় না। বিদেশ গেলেও ভাল, দেশে থাকলেও ভাল। ভাগ্যে যা হয় হবে!
বাড়িতে টাকা দেয়া হবে কি না জিজ্ঞাসা করা হলে অফিসে গিয়ে মাসিক ৩০ টাকা Family allatment করলাম। বাকী তিন মাসের অগ্রিম ৯৮ টাকা পেলাম। কিন্তু টাকা পাঠাবার সময়ও পাওয়া গেল না। খাবারও সময় নেই। এক্ষুণি যাত্রা শুরু করতে হবে। মনে পড়ল চিটাগাং থাকার সময় এমনই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। কাজেই আল্লাহকে স্মরণ করে যাত্রা শুরু করলাম।
পথিমধ্যে একটু যাত্রাবিরতি হল। ফেঞ্চুগঞ্জের সেই সহযাত্রী ভদ্রলোক রাস্তার মধ্যেই কোথা থেকে খাবারের ব্যবস্থা করলেন। এবার আর মনটাকে শান্ত রাখতে পারলাম না। সম্ভবত দেশ ছেড়েই চলে যেতে হবে। ভাবছিলাম জীবনে আর দেশের মাটি দেখতে পাব কি না? দুচোখ পানিতে টলোমলো করে উঠল। চোখের জল ফেলে খেলাম। মনের মধ্যে একই চিন্তা খেলা করছিল, ‘আর কোনদিন ফিরতে পারব কি না?’ মায়ের কথা মনে হতেই মনটা হু হু করে উঠল। অনেক কষ্টে কান্না আটকালাম। আবার রওনা হলাম আল্লাহর নাম নিয়ে।
গাড়িতে উঠেই শুনি পুনা যেতে হবে। মনে করলাম, পুনা গিয়েই বাড়িতে ৬০টি টাকা পাঠিয়ে দেব। টাকা পেয়ে মা যে কি খুশি হবেন, তা কল্পনা করতে করতেই পুনা গিয়ে পৌঁছলাম। সেখানে গিয়ে জানলাম আগামীকালই আমাদের Camp Overseas চলে যাবে। মাথায় বজ্রাঘাত! সেদিনই ১৯ নং রিইনফোর্সমেন্ট ক্যাম্পের ১ নং সেকশনের চার্জ নিয়ে অপরাহ্ন ৩টার সময় রওনা হলাম Overseasএর জন্য। আল্লাহকে ডাকতে থাকলাম। যদি মারা যাই, টাকাগুলোতো পাঠাতে পারলাম না!
২১ মার্চ জাহাজে চড়ে বসলাম। জাহাজের নাম ল্যাঙ্কাসায়ার। তিন হাজার লোক, রেশনসহ জাহাজটি সিটি বাজিয়ে রওনা হল। জীবনে কোনদিন সমুদ্র দেখিনি। ভয় হতে লাগল! এটা তো আর মেঘনা নদীর সেই ছোট্ট স্টিমার নয়। তারপরও নিজেকে সিন্দবাদ সিন্দবাদ মনে হতেই নিজের মনেই হেসে উঠলাম।
কোথায় যাব? অষ্ট্রেলিয়া না আফ্রিকা! কিছুই বুঝতে পারলাম না। কাউকে জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছে করল না। আমার মুখে হাসি নেই। মনে ফূর্তি নেই। ফিরে যাবার আর কোন রাস্তাও নেই। হায়রে জীবন, নিয়তির টানে কোথায় যাচ্ছি আল্লাহই জানেন!
ক্রমাগত ৭টি দিন আরব সাগর আর পারস্য উপসাগরের বুকে ঢেউয়ের লীলা দেখলাম। জাহাজে আবার কঠোর নিয়ম। তিনতলা জাহাজ। প্রত্যেক দিন সকালে উপর তলায় উঠে যার যার নির্ধারিত স্থানে ব্যায়াম করতে হয়। কীভাবে লাইফ জ্যাকেট পরতে হয় তার ট্রেনিং নিলাম। জাহাজডুবি হলে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হবে, তারও ট্রেনিং দেয়া হল। লাইফজ্যাকেট সব সময় সাথে রাখতে হয়। ঘুমাবার সময়ও তা হাতছাড়া করা যাবে না।
জাহাজে আবার রুটি খাবার পর্ব শুরু হল। সঙ্গে কালাই ডাল। আমার এগুলো খেতে মোটেও ভাল লাগত না। এরই মধ্যে হঠাৎ একটি সুসংবাদ পেলাম। মৌলভীবাজারের কনকপুর গ্রামের একজন মশালচি নাকি এ জাহাজে আছেন। অনেক কষ্টে তাকে খোঁজে বের করলাম। আমাকে পেয়ে তিনিও খুব খুশি হলেন। খুশিমনেই তিনি প্রত্যেক রাতে আমার জন্য রুই মাছ দিয়ে ভাত খাবার বন্দোবস্ত করে দিলেন। কাজেই এ সাতদিন আমার আর খাবারের কোন সমস্যাই হয়নি।
[আব্দুল ওয়াহেদ রেজভী, চল্লিশের দশকের মুসলিম কবি (১৪.১.১৯১৯-১৬.৪.১৯৮৪)]
মন্তব্য করুন