বিশ্ব মা দিবস আমার ঠিকানা “মা”
হোসাইন আহমদ॥“মা” শব্দটি ছোট কিন্তু এর মর্যাদা সীমাহীন। এ ছোট শব্দটির প্রতিক্রিয়া ও গতিবেগ এত বেশি যে, অনেক সময় সূর্যের গতিও তার কাছে হারমানায়। পৃথিবীতে সবচেয়ে আপনজন মা। সোহাগভরা মায়ের পরশ/সারা দেহে জড়িয়ে আছে আজো/কোথায় মাগো লুকিয়ে থেকে/স্বপ্নপুরীর রাজকন্যা সাজো।
কবির ভাষায় বলতে গেলে-
মা কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু যেন ভাই
মায়ের চেয়ে নাম যে মধুর, ত্রিভুবনে নাই।
সন্তানের কাছে সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছেন তার মা। মায়ের গর্ভে সন্তান যেমন রক্ত শুষে নিরাপদে ধীরে ধীরে বড় হয়, তেমনি জন্মের পরও তিল তিল করে মা-ই কেবল তার নাড়ি ছেঁড়া ধনকে তিলে তিলে বড় করে তোলেন আগামীর সম্ভাবনাময় একজন মানুষ হিসেবে।
আমাদের ঠিকানা ও পরিচয় সৃষ্টি হয়েছে মায়ের আগমনে। মা না আসলে এবং তিনি আমাদরে লালন পালন না করলে আমাদের পরিচয় পাওয়া যেত না। তাই বলতে পারি “আমার ঠিকানা মা”।
৮ মে বিশ্ব মা দিবস। আমরা এই দিনে মাকে অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি ভালবাসব কিন্তু সারাবছর মায়ের সেবা যতœ করা আমাদের উচিত। কেননা এই মর্যাদাশীল ব্যক্তির জন্য বিশেষ কোন দিন নয় সর্ব অবস্থায় মায়ের পাশে থাকতে হবে।
মার মর্যাদা সম্পর্কে ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে “আর তোমাদের প্রতিপালক এ আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাঁকে ভিন্ন অপর কারো ইবাদত করো না। আর পিতা-মাতার প্রতি উত্তম আচরণ করো। যদি তাঁদের একজন কিংবা উভয়ে তোমাদের জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাঁদের উদ্দেশ্যে কখনো “উহ” পর্যন্ত বলবে না। তাদেরকে ধমক দিও না, বরং তাদের সাথে মার্জিত ভাষায় কথা বল। আর তাদের উদ্দেশ্যে অনগ্রহে বিনয়ের বাহু অবনমিত কর। আর বল, হে আমার প্রতিপালক! তাদের উভয়কে অনগ্রহ কর, যেমন তাঁরা আমাকে শৈশবে প্রতিপালন করেছেন”। (সূরা বনী ইসরাঈল ২৩-২৪)
আজকের সমাজে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি, বিচারপতি, রাষ্ট্রদূত, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সাংবাদিক, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিণিয়ার থেকে শুরু করে সর্বনি¤œ শ্রেণীর কর্মচারী পর্যন্ত সকল মায়ের গর্ভ থেকে এসেছেন। কেউ আসমান থেকে বৃষ্টির মতো পড়েননি। মা ১০ মাস ১০ দিন গর্ভে রেখে আমাদের প্রসব করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে প্রেকেটিং করে নিরাপদে মায়ের গর্ভে রেখেছিলেন। প্রসবের পর সন্তানের মুখ দেখে মা সকল কষ্ট বেদনা ভুলে যান। আমি মহিলা না থাকায় কিংবা বিবাহ না করায় প্রসবের সময় মায়ের কি পরিমাণ কষ্ট হতে পাওে তা পূর্ণ বলতে পারছিনা। কিন্তু আমার বোন ও প্রতিবেশি আত্মীয় গর্ভবর্তী মহিলাদের প্রসবের সময় যতটুকু অনুধাবন করতে পারছি তা থেকে বুঝা যায় যে, পৃথিবীর আর কোন কাজে এত কষ্ট হয়না।
আমার নিজের কথা বলছি। বয়স এখন ২৬ বছর। ২০০৬ সালের জুন মাস থেকে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে ১০ বছর যাবত বাড়ির বাহিরে আছি। এই দীর্ঘ দিনগুলোতে প্রতিদিন রাতে অথবা বিকেলে মা-বাবা ফোন দিয়ে আমার খোঁজ নেন। বর্তমানে পেশাগত ব্যস্থতার কারণে অনেক সময় আমি ফোন দিতে না পারলেও মা প্রতিদিন আমাকে ফোনদেন। শুধু আমাকে নয় ছোট ভাইও মৌলভীবাজার থাকে এবং বড় ও ছোট বোনকে বিবাহ দেওয়া হয়েছে তাদেরকেও একবার ফোন না দিয়ে ঘুমান না।
আমার মায়ের প্রসংশা করছি না। সন্তানের প্রতি মায়ের কতটুকু আন্তরিকতা তা বুঝানোর জন্য এটা উদাহরণ মাত্র। এভাবে উদাহরণ দিলে হাজার হাজার মায়ের উদাহরণ দেওয়া যাবে। আমার মনে হয় সকল মা এরকম। মা সন্তানের সুখের জন্য নিজের রক্ত বিক্রি করে দিতেও প্রস্তুত।
আজকের আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় বৃদ্ধা অবস্থায় মায়ের সাথে কিছু কিছু সন্তানেরা যে আচরণ করে তা প্রাচীন বর্বরতাকে হার মানায়। অনাহারে, অর্ধাহারে, বিনা চিকিৎসায়, অবহেলায় ও নির্যাতনে মৃত্যুকুলে জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে অনেক মাকে। বৃদ্ধা মাকে মনে করা হচ্ছে পরিবারের বুঝা। অনেকে আবার মাকে পাটিয়ে দিচ্ছেন বৃদ্ধা শ্রমে। বছরে একদিনও খোঁজ নিচ্ছেননা তাদের। ধর্মীয় উৎসব সহ বিভিন্ন অনুষ্টানাধি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে তাদেরকে। বেধনায় এ সকল মায়ের অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে তাদের বুক। যান্ত্রিক মানুষ গুলো এত নরপশু হবে কখনো কল্পনা করা যায়নি।
আমাদের চোখের সামনে এরকম ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। অনেকে নতুন বিবাহ করে স্ত্রীর মন্ত্রনায় পড়ে মাকে নিজের শত্রু মনে করেন। শাশুড়-শাশুড়িকে ভক্তি করেন দেবতার মতো। তাদের আব্বা-আম্মা বলে ডাকেন। নিয়মিত চরণে সালাম করেন। এ জন্য আমি শশুড় শাশুড়িকে অসম্মান করার কথা বলছিনা। তাদেরকে সম্মান করবেন যা তাদের প্রাপ্য।
ডিসেম্বর ২০১৫ সালের ঘটনা। শ্রীমঙ্গল উপজেলার সিন্দুর খান গ্রামের স্বামীহীন জায়েদা বেগম। অনেক দিন আগে স্বামী মারা গেছেন। ৩ ছেলে ও ১ মেয়েকে নিয়ে তার কষ্টের সংসার। সন্তানদের বরন পোষণ ও পরিবারের খরচের জন্য তিনি নিয়মীত ইট ভাংঙ্গা, মাটি কাটা, রাজমিস্ত্রির জোগালী ও দিনমজুরের কাজ করে সন্তানদের লালন পালন করেছেন। বড় ছেলের বয়স ১৭/১৮ বছর হওয়ার পরে ঢাকাতে পাঠান থাই ও গ্লাসের কাজ শিখার জন্য। কয়েক বছর ঢাকায় কাজ শিখে শ্রীমঙ্গল এসে সে থাই ও গ্লালের ব্যবসা শুরু করে। অল্প দিনের মধ্যে শহরে একজন ভালো ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। মাকে নিয়ে সুখে বসবার করার জন্য শহরতলিতে জায়গা কিনে পাকা একটি বাড়ি বানিয়েছে। ছেলে উপযুক্ত হওয়ায় মা সুখের জন্য ছেলেকে বিবাহ করান। কিন্তু বিবাহের পরেই ধ্বংস হয়ে যায় তাদের সুখের সংসার। নতুন বউ কোন অবস্থাতেই শাশুড়িকে মানতে রাজিনয়। শাশুড়ির সাথে একি পরিবারে থাকতে চাননি। নতুন বাড়িতে স্বামীকে নিয়ে একা থাকতে চান। অবশেষে ছেলে বাধ্য হয়ে মাকে আগের পুরাতন কুড়ে ঘরে পাঠায়। মায়ের খরচের জন্য মাঝে মধ্যে কিছু টাকা পয়সা দিলেও তাতে বাধা। অবশেষে সে মেহনতি দিনমজুর মা তার বাছা ধনকে হারালেন। বিবাহের কয়েকদিন পরে অপরিচিত নাম্বার থেকে কাজ আছে বলে ফোন করে নিয়ে কে বা কারা তার শরীর টুকরা টুকরা করে নির্জন স্থানে পেলে রেখে তার কোন হদীস পাওয়া যায় না। কয়েকদিন পর টুকরা টুকরা অবস্থায় উপজেলার অন্য একটি জায়গায় তার লাশ পাওয়া যায়। আপনারাই ধারণা করে নেন এ ঘটনার নায়িকা কে। স্বামীর মৃত্যুর পর বাড়িতে তিনি নিশি কন্যার মতো বসবাস করছেন। এ ভাবে অনেক পুত্রবধূরা মা-বাবার সুখের সংসারকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
আজকের সমাজ ব্যবস্থায় যারা মা-বাবাকে নির্যাতন করেন তাদের একটু চিন্তা করা উচিত তাদের উৎপত্তিস্থল কোথায়। কিভাবে তারা এ পর্যায়ে এসেছেন।
মা-বাবার মর্যাদা সম্পর্কে ধর্মগ্রন্থের আরো অনেক জায়গায় বলা হয়েছে।
“আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতা সম্পর্কে আদেশ করেছি। তার মাতা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে তাকে গর্ভধারণ করেছেন। দুই বছর পর্যন্ত তাকে স্তন্য দান করেছেন। এ মর্মে যে, তোমরা আমার এবং তোমাদের পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। আমার দিকেই প্রত্যাবর্তন করতে হবে”। (সূরা লোকমান-১৪)
হাদীসে এসেছে “ হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করিম (সাঃ) বলেছেন, তার নাক ধূলায় মলিন হোক, তার নাক ধূলায় মলিন হোক, তার নাক ধূলায় মলিন হোক। সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সে হতভাগ্য ব্যক্তিটি কে? হুজুর (সাঃ) বললেন সে হলো সেই ব্যক্তি যে তার পিতা-মাতা উভয়কে অথবা কোন একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় পেয়েও বেহেশেÍ যেতে পারলনা। (মুসলিম)
মন্তব্য করুন