বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আছকির খাঁন : মেধাসম্পন্ন রাজনীতিবিদের বিদায়
রুহুল আমীন রুহেল॥ মানুষের জন্মের সাথে মৃত্যু অনিবার্য। মানুষ যে জায়গা থেকে আসে, সেখানেই ফিরে যায়। কেউ কেউ জায়গা করে নেন ইতিহাসের পাতায়। কেউ নায়ক হন, কেউ প্রতিনায়ক। তারা ইতিহাস তৈরী করেন।
তারমধ্যে একজন হচ্ছেন মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আছকির খান। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রচন্ড মেধাসম্পন্ন রাজনীতিবীদের বিশ্বময়কর জীবন পরিসমাপ্তি ঘটে।
মোঃ আছকির খাঁন’র জন্ম ৩১ জানুয়ারি ১৯৫২ সালে। কি আর বয়স, হঠাৎ করে চলে যাবেন ভাবতেই পারিনা। অল্প সময়ে মৌলভীবাজার ও রাজনগরের রাজনীতিতে ইতিহাসের অনেক উত্থান পথনের অংশ ছিলেন।
মোঃ আছকির খাঁন ষাটের দশকে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ দিয়ে রাজনীতি দিয়ে শুরু, হন রাজনগর ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। মৌলভীবাজার মহকুমা ছাত্রলীগের কার্যকরী সংসদের সদস্যও ছিলেন।
তরুণ বয়সে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে দেশ, মাটি-মানুষ ও স্বাধীনতার জন্য সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন তিঁনি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুব সমাজকে সংগঠিত করার জন্য তার মনে চিন্তা আসে। সেই চিন্তা চেতনা থেকে রাজনগরে আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সবার অনুরোধে হন আহবায়ক। সে থেকে তাকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি।
সম্ভবত ১৯৭৪ সালে অল্প বয়সে রাজনগর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার হাত ধরেই রাজনগরে আওয়ামী লীগ বৃহত্তর প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি মহকুমার রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। নদ-নদী খাল-বিল, মেটো ও রাজপথে বিকশিত এক নেতৃত্ব জনাব আছিকির খাঁন।
প্রায় চার দশক রাজনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ৭৫ সালে জাতির পিতা ও তাঁর পরিবারকে হত্যার পর প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও সংগঠনকে সংগঠিত করতে মাঠে ময়দানে কাজ করেন। সেই সময় সামরিক সরকার তাকে গ্রেপতার করে। দীর্ঘদিন তাকে জেল জুলুম নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে।
আরেক সামরিক জান্তা এরশাদেও সময় তাকে জেলে যেতে হয়েছে। কারণ প্রত্যেক সামরিক জান্তা সৈরশাসকদের বিরুদ্ধে রাজপথে তার উপস্থিতি মানে আন্দোলনে অগ্নি স্ফুলিঙ্গ। এই কারণেই সামরিক সরকার ও দেশ বিরুধী রাজনৈতিক দলও তার ভয়ে সব সময় তটস্ত থাকতো। রাজনগরের জনপদের প্রতিটি আন্দোলন লড়াই সংগ্রামে রাজপথের অপরিহার্য নাম আছকির খাঁন। আর একারণেই এই অঞ্চলে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেন।
২০১৪ সালে রাজনগর এর মানুষ তাদের প্রিয় নেতা আছকির খাঁনকে উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করেন।
খাঁন সাহেব সবসময় একটি কথা রাজনীতির পথচলায় বলতেন, ‘রাজনীতিতে সবদিক থেকে মানুষের কল্যাণ সাধনের চিন্তা কর। যে রাজনীতিতে এলাকায়, দলে, গ্রামে বিভক্তি এনে দেয়, সেই রাজনীতি আমি বিশ্বাস করিনা।’
ধর্ম বর্ণ গোষ্টি সম্প্রদায়ের উর্দ্ধে উঠে রাজনগরের রাজনীতি করে গেছেন বলেই সবার শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
রাজনগরের সৌহাদ্য পূর্ণ রাজনীতি ও সামাজিক আবহ নিয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু যেভাবে মানুষককে আপন করে নিতেন, বঙ্গবন্ধুর ভীষণ প্রভাবিত শিষ্য হিসেবে মো. আছকির খাঁনও মানুষকে সেভাবে আপন করে নিতেন। মেধা, প্রজ্ঞা, বিচক্ষনতা, দুরদর্শিতা, জ্ঞানের গভীরতা প্রচন্ড ছিল তাঁর।
মফচ্ছল থেকে রাজনীতি করলেও জাতীয় রাজনীতিতের গতিপথ কোন দিকে মোড় নিবে সে হিসাবে অত্যান্ত দক্ষ ছিলেন তিঁনি।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির সংবাদ নিয়ে খুব সচেতন ছিলেন। আরেকটি রড় গুন ছিল উনার, ধৈর্য্য সহকারে অন্যের কথা শুনতেন। তার শত্রুকেও শান্ত করার শক্তি ছিল তাঁর মধ্যে প্রবল। রাজনীতি করে অনেকে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়ে যান। কিন্তু খান সাহেব তার ক্ষমতা থাকার পরও সেই পথে হাত বাড়াননি। এই কারণেই তিনি পেয়েছেন মানুষের শ্রদ্ধ্যা ও ভালোবাসা। তার জানাযার নামাজে মানুষের উপস্থিতিই তার প্রমান ।
সারাজীবন রাজনীতিতে কালো টাকা পেশি শক্তি সন্ত্রাস, দুরবৃত্তায়ন, সাম্প্রদায়িক মৌলবাদ, দুর্নীতি প্রতিক্রিয়াশীল অসুস্থ রাজনীতির বিরুদ্ধে ছিলেন তিঁনি। ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে আপোষহীন। মানবিক, নান্দনিক, অহিংস, মাটির মানুষ সর্বপরি দেশ প্রেমিক রাজনীতির জন্য এক উজ্জল দৃষ্টান্ত হলেন মোঃ আছকির খাঁন। অসম্ভব মেধা সম্পন্ন রাজনীতিবিদ ছিলেন তিনি যা বর্তমান রাজনীতিতে প্রায় অনুপস্থিত।
বর্তমান রাজনীতিবিদরা তাকে অনুসরন করলে সমাজ রাজনীতি এবং রাস্ট্রের মঙ্গল বয়ে আনবে বলতে পারি।
লেখক পরিচিতি : রুহুল আমীন রুহেল, সাবেক ছাত্রনেতা, রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক।
মন্তব্য করুন