“বৃটিশ-ভারতের খ্যাতিমান শিক্ষানুরাগি ধর্ম ও সমাজ সেবক সহজ সরল সাদা মনের মানুষ মৌলভী মোহাম্মদ আনোয়ারঃ কর্ম ও জীবন দর্শন। উনচল্লিশতম ওফাত বার্ষিকীর শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥

July 23, 2020,

মুজিবুর রহমান মুজিব॥ ভারত থেকে বাংলা, চল্লিশ থেকে-আশি-সুদীর্ঘ সাড়ে চার দশকের ঐতিহ্যবাহী সুনামগঞ্জ শহরের শিক্ষা-সমাজ-সালিশ-পঞ্চায়েত-ধর্ম-কর্ম ও মুক্ত বুদ্ধির আন্দোলনের নীরব সৈনিক মৌলভী মোহাম্মদ আনোয়ার মৌলভীবাজার সদর উপজেলাধীন ইটা-রসুলপুর গ্রাম এর এক সম্ভান্ত শিক্ষানুরাগি-মধ্যবিত্ত-মুসলিম পরিবারেরই সু-সন্তান। মৌলভী মোহাম্মদ আনোয়াররা তিন ভাই, অপর দুই ভ্রাতা মোহাম্মদ আলফু এবং মোহাম্মদ মফিজ। তিন ভাই এর বড় ভাই মোঃ আনোয়ার কনিষ্ট দুই ভাইর সন্তানগণকে সুনামগঞ্জ নিয়ে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করে তুলেছেন। রসুলপুর গ্রামে তাঁর বিশাল বসতবাড়ি সামনে পিছে বৃহদাকৃতির পুকর প্রচুর পরিমানে মূল্যবান কৃষি জমি থাকলেও তিনি তা কোন দিন ভোগ দখলে আসেন নি কিংবা ক্ষেতের ফল-ফসলের উপস্বত্ব দাবী করেন নি। আজকাল এই ভোগ বাদি সমাজে যদিও ভাই, ভাইয়ের সম্পত্তি  আত্মসাত করছেন, সম্পত্তি নিয়ে দাঙ্গাঁহাঙ্গাঁমা পার্টিশন স্যুট, সালিশ পঞ্চায়েত এখন নিত্ত নৈমিত্তিক ব্যাপার। ভাই ভাইকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার জন্য লন্ডনী ভাই দেশী ভাই কে- ব্লাাডি ভাস্তর বলে গালি গালাজ এর উদাহরন এই সমাজে আছে। কিন্তু মোহাম্মদ আনোয়ার ছিলেন তার ব্যতিক্রম। তিনি ছিলেন নিলোর্ভ ও নিরহংকারি। লেখাপড়া শিখে সরকারি চাকরি করে সম্মান জনক জীবন যাপন করলেও তাঁর মধ্যে কোন-‘কি হনুরে’- ভাব ছিল না। বরং তিনি ছিলেন নিলোর্ভ, নিরহংকারি, সহজ সরল সাদামনের মানুষ, সৎ মানুষ, ভোগী নয়, ত্যাগী মানুষ। পারিবারিক তথ্য মতে মোহাম্মদ আনোয়ার এর পূর্ব পূরুষ আঠারোশত সাতান্ন সালের সিপাহী বিদ্রোহের বীর সিপাহী-বীর মোজাহিদ মির্জা জুনায়েদ বেগ যিনি কমলগঞ্জ উপজেলাধীন ঐতিহ্যবাহী রামপাশা গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন। মির্জা জুনায়েদ বেগ এর পরিবার এর একাংশ সদর উপজেলাধীন রসুলপুর, বিরাইমাবাদ এলাকায় এসে বসতি স্থাপন করেন। সদর উপজেলাধীন মাতার কাপানের বিখ্যাত বেগ এর বাড়ির পূর্ব পূরুষ ও এমনি এক বিদ্রোহী বীর সিপাহী মির্জা কানোয়ার বেগ। সাবেক পিপি এডভোকেট মির্জা সিরাজ উদ্দিন বেগ তারই অধঃস্থন বংশধর। মোহাম্মদ আনোয়ার-রা শারীরিক ও পারিবারিক ভাবে দীর্ঘ দেহী, অসম্ভব রকমের উজ্জল ফর্সা চেহারা, দেশ প্রেমিক ও শিক্ষানুরাগি। বৃটিশ ভারতের শেষ ভাগে শিক্ষানুরাগি মোহাম্মদ আনোয়ার এর জন্ম ও বেড়ে উঠা। তখন গ্রামাঞ্চলে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। শুস্কু মৌসুমে পদ ব্রজে এবং বর্ষাকালে নৌকা ও কলার ভেলাই ছিল আল্লাহ ভরসা। বাল্য কৈশৈর কাল থেকে অসম্ভব রকমের মেধাবী শিক্ষানুরাগি মোহাম্মদ আনোয়ার রসুলপুর থেকে পায়ে হেটে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে এসে লেখাপড়া করতেন। সরকারি স্কুল প্রতিষ্ঠার মাত্র আধা দশকের মাথায় উনিশশ বিশ সালে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মোহাম্মদ আনোয়ার কৃতিত্বের সাথে এন্ট্রান্স পাশ করেন। তিনিই ছিলেন এতদাঞ্চলের প্রথম ম্যেট্রিকুলেট। তখন মৌলভীবাজারে কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভালো ফলাফলের কারণে মোহাম্মদ আনোয়ার এর সরকারি চাকরি হয়ে গেলে শিক্ষা জীবনের পরি সমাপ্তি ঘটে। পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে নিজে অধিকতর উচ্চ শিক্ষা- প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে না পারলেও আজীবন শিক্ষা ও জ্ঞানের উদার পৃষ্ট পোষকতা অভিভাবকত্ব করেছেন সহজ সরল সাদা মনের ভালো মানুষ মোহাম্মদ আনোয়ার। পৃথিবীর পাঠশালা থেকেও আজীবন শিক্ষা গ্রহণ করেছেন তিনি। যৌবনে পদার্পন করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করেন সৌম্য দর্শন সুদর্শন মোহাম্মদ আনোয়ার। দীর্ঘ ছ’ফুট উচ্চতা সুম্পন্ন হালকা পাতলা মাঝারি গড়নের দীর্ঘদেহী, ছাফ গুরিয়ানা- অসম্ভব রকমের উজ্জল ফর্সা চেহারা, পিঙ্গঁল বর্ণের বুদ্ধিদিপ্ত দুই চোখ, উন্নত নাসিকা সমেত আকর্ষনীয় মুখাবয়ব, বাহারি কেশ বিন্যাসে পাজামা সার্ট পরিহিত নওজোয়ান মোহাম্মদ আনোয়ার যেকোন সুন্দরী নারীর স্বপ্নের রাজ কুমার হওয়ার কথা। সর্বোপরি তাঁর রয়েছে ভালো মাইনের সরকারি চাকরি, স্বচ্ছল সম্ভান্ত বংশ বিত্তবান পরিবার। মৌলভীবাজার সদর উপজেলাধীন শহরতলির ঐতিহ্যবাহী বালিকান্দি গ্রাম সেকাল থেকে একাল পর্য্যন্ত শিক্ষিত, সম্ভান্ত, অভিজাত ও ঐতিহ্যবাহী জনপদ। যেমন ধর্ম কর্ম তেমনি শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়ন, প্রশাসন ও গণ আন্দোলনে বালিকান্দির কৃতি পূরুষগণ যুগে যুগে যুগান্তকারি অবদান রেখেছেন-রাখছেন এই এলাকার ঢেউপাশা, মমরুজপুর, বলিয়ার ভাগ ও শিক্ষা দিক্ষায় অগ্রসর এলাকা। এমনি ঐতিহ্যবাহী বালিকান্দি গ্রামের বিখ্যাত সৈয়দ বংশে অপূর্ব সুন্দরী নারী সৈয়দা সামসুন্নেছা খাতুন এর সঙ্গেঁ পারিবারিক ভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ইটা রসুলপুর নিবাসী যোগ্য বর মোহাম্মদ আনোয়ার। বর-কনে ও একে অন্যকে পছন্দ হয়। সুখময় দাম্পত্য জীবন ছিল আনোয়ার-সামছুন্নেছা খাতুন দম্পত্তির। স্বামী-স্ত্রী হিসাবে একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ দিয়ে এই নব দম্পত্তি কঠিন মানব জীবনকে সুখময়-প্রেমময় করে তুলেন। সরকারি বদলির চাকরি, প্রিয় জন্মভূমি মৌলভীবাজার থেকে বদলি হয়ে শাহ জালালের সিলেট চলে যান সরকারি চাকরিজীবী মোহাম্মদ আনোয়ার। কিছু দিন পর সিলেট থেকে বদলি হন সুনামগঞ্জে। হাওর-বাওর সম্বলিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে অপরূপলিলী ভূমি সুনামগঞ্জ মহকুমা সদরে স্থায়ী বসতি গড়ে তুলেন আদর্শ গৃহি মোহাম্মদ আনোয়ার। সুনামগঞ্জ শহর ও শহর তলিতে তখন ভূমিও জমিনের তুলনায় লোক বসতি কম। বাসাবাড়িও ভূমির মূল্য ও সুবিধা জনক। শহরের ষোল্ল ঘর এলাকায় জমি কিনে ঘর-বাড়ি গড়ে তুলেন নিষ্টাবান গৃহী মোহাম্মদ আনোয়ার। তাঁর প্রিয় জীবন সঙ্গিনী প্রেম ময়ী পত্নি আদর্শ গৃহিনী ও সু-মাতা সৈয়দা সামছুন্নেছা খাতুন ষোল্ল ঘরের পর্ণ কুটিরকে পূর্ণ করে তুলেন, সোনার সংসার সাজিয়ে তুলেন মায়ায় মমতায়। কৈশোর কালে দিন কয়েকে নৌকা যোগে আমাদের পরিবার বর্গের সঙ্গেঁ তাঁর জীবদ্দশায় এক বারই সুনামগঞ্জ গিয়েছিলাম। ষোল্ল ঘর, সুনামগঞ্জের আনোয়ার-সৈয়দা সামছুন্নেছা খাতুনের এই স্বপ্নপুরী আমার বাবার মামার বাড়ি। নালায়েক-অধম-লাচার এই আমি এই দম্পত্তির নাতি। সেই বাল্য-কৈশোর কালে দাদা-নাতি দাদি-নাতি আত্মীয়তার বন্ধন-মায়া-মমতার মর্ম অনুধাবন করতে পারিনি, জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় আশির কোটায় এসে নিজে দাদা-নানা হয়ে নানা নাতির মায়া মমতার মর্ম হৃদয় দিয়ে অনুভব করছি। আমার এক অতি বুদ্ধিমান বন্ধু নানা হয়ে বলেছিলেন ভালোবাসা বরাবরই নিম্ন গামি। বেবুজ হয়েও বুঝলাম সেটাই সঠিক।
ষোল্ল ঘরে মোহাম্মদ আনোয়ার এর স্বপ্ন পুরির রানী-মহারানী গোলবাটা মুখি উজ্জল ফর্সা চেহারার বালিকান্দির সৈয়দ জাদি সৈয়দা সামছুন্নেছা খাতুন এর মায়াবি মুখ মন্ডলের দিকে তাকালে মনে হত-“চাঁদের ন্যায় মুখ চাঁদমুখ”-বলতে যা বুঝায় এ যেন তাই। পূর্ণিমার আকাশের পূর্ণ চাঁদ বুঝি মাটিতে নেমে এলে, ষোল্ল ঘরের আদর্শ গৃহী ভাগ্যবান মোহাম্মদ আনোয়ার এর সংসার জীবনের ষোল কলাই যেন পূর্ণ হয়েছে। সন্তান ভাগ্য ছিল মোহাম্মদ আনোয়ার সৈয়দা সামছুন্নেছা দম্পত্তির। মহান মালিকের অপার রহমত বরকতে এই দম্পত্তির সন্তানগণ হলেন রহিমা রহমান, নূরুল হক আম্বিয়া, ফজলুল হক আস্পিয়া, ছালেহা ছত্তার এবং সিরাজুল হক কুতুক। সন্তান গণ সকলেই উচ্চ শিক্ষিত, কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত। প্রথম সন্তান রহিমা রহমান ধর্মপ্রাণ আদর্শ নারী শিক্ষাবিদ সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলি উচ্চ বিদ্যালয়ের আদর্শ শিক্ষক আলতাফুর রহমানের সঙ্গেঁ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
ইংরেজী সাহিত্যের পন্ডিত, ছাত্র ও শিক্ষা অন্তপ্রাণ আমার প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষক জনাব আলতাফুর রহমানের কর্তব্য নিষ্টা, সততা ও অগাধ পান্ডিত্যের কথা এখনও ছাত্র অভিভাবকদের মুখে মুখে। আজীবন অকাতরে ছাত্রদের মধ্যে জ্ঞান বিতরন করে গেছেন, শিক্ষায় প্রশিক্ষন প্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষক আলতাফুর রহমান-ছাত্র পড়িয়ে পয়সা নেন নি। দ্বিতীয় সন্তান নূরুল হক আম্বিয়া লেখাপড়া শেষে পি.আই.এ.তে চাকরি নিলেও ফুটবল প্রীতির কারনে এয়ারলাইন্স এর লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে ক্রীড়াঙ্গঁনে নিজেকে নিবেদন করেন। একজন কৃতি ফুটবলার-গোল কিপার হিসাবে তিনি বৃহত্তর সিলেটের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে ঢাকায় জাতীয় ক্রীড়াঙ্গঁনে নাম লেখান।
পঞ্চাশের দশকের শেষ ভাগে কৃতি ফুটবলার আম্বিয়া ঢাকাস্থ সেন্ট্রাল ষ্টেশনারি ক্লাব দিয়ে ঢাকাই ক্লাব ফুটবল শুরু করে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান স্পোটিং ক্লাবে যোগ দেন। পাকিস্তান জাতীয় দলে স্থান পেয়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে ও অপূর্ব ক্রীড়া নৈপুন্য প্রদর্শন করেন। পেশাদারি ফুটবল জীবন থেকে অবসর নিলেও মাঠের মায়া পরিত্যাগ করেন নি ফুটবল যাদুগর নূরুল হক আম্বিয়া-নিজ জন্ম জেলা সুনামগঞ্জ এসে সুনামগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার দায়িত্ব নিয়ে ক্রীড়াঙ্গঁনকে আলোকিত করতঃ এখন মসজিদ কমিটির দায়িত্ব নিয়ে ধর্ম ও সমাজ কর্মে আছেন। আনোয়ার-সামছুন্নেছা দম্পতির সু-সন্তান মোহাম্মদ ফজলুল হক আস্পিয়া পেশাগত ভাবে বিশিষ্ট আইনজীবী একজন নিবেদিত প্রাণ সৎ ও আদর্শ রাজনীতিবিদ। দীর্ঘদিন সুনামগঞ্জ জেলা বি.এন.পি-র সভাপতির দায়িত্ব পালন শেষে বর্তমানে বি.এন.পি-র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন। এডভোকেট ফজলুল হক আস্পিয়া একাধিক মেয়াদে সুনামগঞ্জ জেলা সদরের সাংসদ এবং প্রতিমন্ত্রীর মর্য্যাদায় সরকার দলীয় হুইপ ছিলেন। তাঁর সন্তানগণ ও উচ্চ শিক্ষিত, কর্ম জীবনে প্রতিষ্ঠিত। এডভোকেট আস্পিয়ার সততা শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধ সর্বত্র প্রশংসিত। মোহাম্মদ আনোয়ার এর সুকন্যা, সুশিক্ষিতা ছালেহা ছত্তার সুমানগঞ্জের বিশিষ্ট চিকিৎসাবিদ-সমাজ সেবক ডা.আব্দুছ ছত্তারের সঙ্গেঁ পারিবারিক ভাবেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ডা.ছাত্তার-ছালেহা দম্পত্তির সু-সন্তান এডভোকেট রুহুল তুহিন জেলার বিশিষ্ট আইনজীবী ও সমাজ সংঘটক। সৌভাগ্যবান মোহাম্মদ আনোয়ার এর কনিষ্ট সন্তান মেধাবীও বৃত্তিধারি, সিরাজুল হক কুতুব সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়, ঐতিহ্যবাহী এম.সি.কলেজ সিলেট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এর কৃতি ছাত্র ছিলেন। তিনি ষাটের দশকে বাম প্রগতিশীল গণতান্ত্রীক ছাত্র-গণ আন্দোলনের বলিষ্ট নেতা এবং একাত্তোরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সংঘটক ছিলেন। বাম প্রগতিশীল তাত্বিক ও চিন্তাবিদ সিরাজুল হক কুতুব আদর্শিক-রাজনৈতিক কারনে সরকারী চাকরিতে যোগ না দিয়ে মুদ্রন ও প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গেঁ সম্পৃক্ত আছেন। তাঁর স্ত্রী-সন্তানগণ ও সুশিক্ষিত। শিক্ষানুরাগি মোহাম্মদ আনোয়ার শুধুমাত্র নিজের সন্তানগণ নহেন পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও আত্মীয় স্বজনের শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রেও দায়িত্ববান ও একান্তই আন্তরিক ছিলেন। তিন ভাইয়ের বড় ভাই হিসাবে তাঁর কনিষ্ট দুই ভ্রাতার সন্তান গণকেও তিনি মৌলভীবাজার থেকে সুনামগঞ্জে নিয়ে নিজ দায়িত্বে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতঃ মানুষের মত মানুষ করে তুলেন। তাঁর ভ্রাতস্পুত্রগণের মধ্যে এম.এ.মনির পাক আমলের মধ্য ভাগে শিক্ষা জীবন শেষে ভালো ফলাফল, স্মার্টনেছ ও সুদর্শন ফিগারের কারনে কোন তদবির ও উৎকোচ ছাড়াই পাকিস্তান ইন্টারন্যেশনেল এয়ার লাইন্স পি.আই.এ.তে যোগ দিয়ে স্বাধীনতা উত্তর কালে সুনামের সাথে বাংলাদেশ বিমানের ম্যেনেজার পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এম.এ.মতিন পাকিস্তানের শেষ ভাগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে একাত্তর সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে মেজর পদ মর্য্যাদায় থাকা কালে খান সেনাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেন। স্বাধীনতা উত্তর কালে বঙ্গঁবন্ধুর সরকার কর্তৃক বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা এম.এ.মতিনকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদ মর্য্যাদা থেকে অবসর দেয়া হয়। তিনি পঁচাত্তোরের পনেরোই আগষ্টে বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিব হত্যাকান্ড এবং স্বঘোষিত রাষ্ট্রপ্রতি খুনী খন্দকার মুশতাক আহমদ গং-দের সমর্থন না করার কারনে ন্যায্য পদোন্নতি পদায়ন থেকে বঞ্চিত হন। চাচার আদর্শে বেড়ে উঠা বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম.এ.মতিন পি.এস.সি.বি.পি. প্রেসিডেন্ট খন্দকার মুশতাক চক্রের সাথে আপোষ ও আঁতাত না করায় তাঁকে বার্মার বাংলাদেশ এমব্যেসিতে মিলিটারি এ্যটাসি হিসাবে বদলি করা হয়। তিনি বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ডি.জি.হিসাবেও কাজ করছেনে। সরকারি অবহেলা ও অপমানে দারুন মনোঃ কষ্টের কারনে অকালে ইন্তিকাল করেন একাত্তোরের এই বীরযোদ্ধা। শামসুল হক সিতু শিক্ষা জীবন শেষে কর্ম জীবনে প্রবেশ করতঃ বৈবাহিক সুত্রে আমেরিকা প্রবাসী হন। মৌলভীবাজারে অবস্থান ও অধ্যয়নরত মৌলভী মোহাম্মদ আনোয়ার এর দৌহিত্র মুজিবুর রহমান মুজিব (এই লেখক) আয়ূবী সামরীক স্বৈর শাসনামলে স্কুল ছেড়ে মার্শল ল’ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়লে তিনি তাঁকে মৌলভীবাজার থেকে সুনামগঞ্জ নিয়ে যান, সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্ত্তি করিয়ে দেন। তাঁর আদর্শ ও ছায়ায় তাঁর সন্তানদের মায়ায় মমতায় মুজিবুর রহমান মুজিব কৃতিত্বের সাথে এস.এস.সি. পাস করে, সিলেটের এম.সি.কলেজে ভর্ত্তি হয়ে অধ্যয়নের ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স এবং আইনে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করতঃ কর্ম জীবনে প্রবেশ করেন। শুধু পুত্র কন্যা, ভাতিজা, ভাগ্না-নাতি নয়, দূরের কাছের সকল আত্মীয় স্বজনের প্রতি সমান মায়া মমতা ও সহমর্মিতা ছিল আদর্শ মানুষ মোহাম্মদ আনোয়ার এর। স্কুলের ছাত্রাবস্থায় তাঁকে কাছে থেকে দেখেছি-আর বিমুগ্ধ হয়েছি। ইতিপূর্বে ১৯৫৫ সালে তাঁর জীবনে নেমে আসে এক কঠিন সময়। ঐ সালে তাঁর প্রিয় জীবন সঙ্গিনী সু-মাতা সৈয়দা সামছুন্নেছা খাতুন এ দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে চীরতরে চলে যান না ফেরার দেশে। প্রিয় পত্নিকে আকস্মিক ভাবে হারিয়ে মানষিক ভাবে দারুন আঘাত প্রাপ্ত হন আদর্শ স্বামী মোহাম্মদ আনোয়ার। ষোল্লঘরের সবুজ শ্যামলিমায় শ্যামল মাটির কোমল বিছানায় প্রিয় জীবন সঙ্গিঁনী সৈয়দা সামছুন্নেছা খাতুনকে চীর শয়ানে শায়িত করে শোককে শক্তিতে পরিণত করেন তিনি, মাতৃহারা সন্তানগণকে পরম মমতায় বুক আগলে মাতৃ-পিতৃ স্নেহ দিয়ে লালন পালন করতে থাকেন। পত্নী বিয়োগের কঠিন কষ্ট ও অব্যক্ত বেদনা বোধ নীরবে সহ্য করেছেন, প্রকাশ করেন নি। চোখে অব্যক্ত বেদনার ছাপ থাকলেও তাঁর উজ্জল ফর্সা মুখে এক চিলতে মুচকি মিষ্টি হাসি লেগে থাকত সব সময়। তখন বয়স কম থাকার কারনে সেই হাসি আনন্দের না বেদনার বুঝতে পারিনি। এ সময় সুনামগঞ্জ জেলাধীন ঐতিহ্যবাহী সৈয়দ পুরের পীর বংশীয় এক সৈয়দ জাদা এলেন স্কলারশিপ পরিক্ষা দিতে। সৈদপুরী সৈয়দ জাদা, সৈয়দ আলী আহমদ সম্পর্কে মোহাম্মদ আনোয়ার এর শালা হন। আধুনিক জমানার অত্যাধুনিক শালা দুলা ভাই যেভাবে হালকা রং তামাশা করেন তারা দুজনকে তেমন করা দেখিনি, তবে পরিশিল্পিত ভাবে দু’জনকে মিষ্টি মধুর আলাপ করতে দেখেছি। সকল আত্মীয় স্বজনের প্রতি সমান মায়া মমতা ছিল, দোয়া ছিল মোহাম্মদ আনোয়ার এর। এই সৈয়দ জাদা তাঁর পিতা-মাতা, পীর মুর্শিদ এবং তাঁর প্রিয় দুলা ভাই মোহাম্মদ আনোয়ার এর দোয়ায় সফল শিক্ষা জীবন শেষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করতঃ চৌকশ সেনা কর্মকর্তা হিসাবে লেঃ কর্ণেল পদ মর্য্যাদায় উন্নীত হয়ে সুনাম এর সাথে অবসর গ্রহণ করেন। কর্ণেল আলী হিসাবে খ্যাত লেঃ কর্ণেল সৈয়দ আলী আহমদ একজন শিক্ষানুরাগি ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞ হিসাবে জালালাবাদ কেন্টনমেন্ট কেডেট কলেজের পুরষ্কার প্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন। অবসর গ্রহনের পর তিনি সিলেটে ওয়েষ্ট পয়েন্ট স্কুল এন্ড কলেজ প্রতিষ্টা করে কৃতিত্বের সাথে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন, গবেষনা ও কাব্য চর্চা করছেন। তাঁর দুলা ভাইর নাতি হিসাবে তিনি আমাকে পরম মমতায় ভাতিজার বদলে চাচা বলেই সম্ভোধন করেন। সেই সেকাল থেকে একাল পর্য্যন্ত মায়া, মমতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বন্ধন আরো মজবুত হয়েছে।
এক জায়গায় এক পদে বেশিদিন চাকরি করলে গণবিরোধী ও অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারি উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের রুশের সম্মুখীন হন, সহকর্মি ও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিরাগ ভাজন হন, কিন্তু জনবান্ধব সরকারি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনোয়ার সততা, কর্তব্য নিষ্টা, শিষ্টাচার সৌজন্যবোধ ও বিনয়াচরনের কারনে সকল মহলের কাছে সমান গ্রহণ যোগ্য ছিলেন। পদোন্নতি কিংবা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অধিকতর স্বচ্ছল কোন এলাকায় অর্থনৈতিক ভাবে লাভের আশায় তিনি উৎসাহী ছিলেন না। নিজ জন্ম ভূমি জন্ম স্থান মৌলভীবাজার থেকে শত কিলোমিটার দূরে ঘনিষ্ট আত্মীয় স্বজনহীন সুদুর সুনামগঞ্জের মাটি মানুষ ও প্রকৃতিকে ভালোবেসে আজীবন সুনামগঞ্জ থেকে গেছেন। সুনাম বাহী সুনামগঞ্জের সর্ব্বস্থরের নাগরিক সমাজ তাঁকে আপন করে নিয়েছিলেন- তাঁকে তারা ভালোবাসতেন শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর প্রাণ প্রিয় দুই কন্যা রহিমা বেগম ও ছালেহা বেগমকে তিনি সুনামগঞ্জ শহরেই ভালোঘরে- ভালো বরে পাত্রস্থ করেন। সুনামগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক ও মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট এর বিশেষ সহকারি হিসাবে অবসর গ্রহণ করে মোহাম্মদ আনোয়ার তাঁর সুদীর্ঘ সরকারি চাকরি জীবনের অবসান ঘটান। চাকরি জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করলেও কর্ম জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন নি সমাজ সেবা, নাতি-নাতিনদের লেখাপড়া ও ধর্মে কর্মে নজর দারিতে সময় কাটাতেন তিনি। তাঁর প্রিয় সহকর্মি, শুভানুধ্যায়ীগণ ও তার কাছে নিয়মিত উপদেশ নিতেন- ধর্মালোচনা করতেন। পিয়ন গঙ্গাঁসিং প্রায় এসে তার কুশল জানতেন। ১৯৬৪ সালে সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে আমি ভালো ফলাফল সহ এস.এস.সি পাশ করে এমসি কলেজ ভর্ত্তি হয়ে সিলেট বাসি হলে মোহাম্মদ আনোয়ার এর মায়া ও সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হই।
আমাদের মহান স্রষ্টা ও প্রতিপালক দু’জাহানের খালিক-মালিক-সর্ব্ব শক্তিমান মহান আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের ধর্ম গ্রন্থ আসমানি কিতাব আল কোরআনে সুস্পষ্ট ভাবে ঘোষনা করেন “কুল্লিন নাফসিন জ্যায়িকাতুল মউত” জগতের সকল প্রাণীকেই একদিন মৃত্যোর মোকাবিলা ও আলিঙ্গঁন করতে হবে। সর্ব কালের সেরা দার্শনিক কবিও ইসলামি চিন্তাবিদ শেখ সাদি (র:আ:) মৃত্যো ও জীবন প্রসঙ্গেঁ তাই যথার্থ বলেন-দুনিয়া, এহিত হ্যায় এক মুসাফির খানা জানেহগা জরুর, কোয়ি আগে-কোয়ি পিছে”। প্রকৃত পক্ষেই এই পৃথিবীতে যাওয়ার জন্যই আসা। ইসলামী আইনের বিধান মোতাবেক আলমে আরওয়া থেকে হাসরের ময়দান পর্য্যন্ত মানবাত্বার ক্রম বিকাশ বিবর্তনের যে ধারা তন্মধ্যে দুনিয়ার জীবন খুবই ক্ষনস্থায়ী ও অনির্ধারিত। মোহাম্মদ আনোয়ার এর ও দুনিয়াবি মানব জীবন শেষ হয়ে গেল। ১৯৮১ সালের ২৯ শে জুলাই আনোয়ার পরিবার ও স্বজনদের জন্য একটি শোকাবহ দিন। প্রায় পরিনত বয়সে আল্লাহ ও রাসুল প্রেমে ফানাফিল্লাহ মানব প্রেমিক মোহাম্মদ আনোয়ার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে তার দুনিয়াবি জীবনে অবসান ঘটান-চীর তরে চলে যান না ফেরার দেশে। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁকে তাঁর প্রিয় শহর-প্রিয় কর্মস্থল সুনামগঞ্জে তাঁর পারিবারিক গোরস্থানে তাঁর প্রিয় জীবন সঙ্গিঁনী সৈয়দা সামছুন্নেছা খাতুনের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। তাঁর কেনা বসত বাড়ীর একাংশ এই পারিবারিক গোরস্থানে চীর শয়ানে আছেন তাঁর প্রিয় প্রথম কন্যা বেগম রহিমা রহমান, মরহুমের জামাতা আলতাফুর রহমান, তাঁর প্রিয় দৌহিত্র অকাল প্রয়াত আমিনুর রহমান রেজোয়ান। ষোল্ল ঘরের সবুজের শ্যামলি মায় গাছ গাছালির ছায়ায় মায়ায় পাখ পাখালির কলতান-কুজনের মাঝে চীর শয়ানে শায়িত তিনি। সবুজ শ্যামলিমা ও নানান গাছ-গাছালি কবর গাহকে মায়ায় মমতায় জড়িয়ে আছে। হয়ত রোদ-বৃষ্টিকে আগলে রাখছে। মরহুম মোহাম্মদ আনোয়ার এর মৃত্যোর চার দশক পর বর্ত্তমান প্রজন্ম তাঁর সম্মন্ধে ব্যাপক অবগত নহেন অনেকেই তাঁর নাম শুনেছেন মাত্র। তাঁর সম্মান ও স্মরনে গঠিত-“আনোয়ার স্মৃতি সংসদের”- উদ্যোগে আগামী উনত্রিশে জুলাই মরহুমের উনচল্লিশ তম মৃত্যোবার্ষিকীতে ঢাকা-মৌলভীবাজার-সুনামগঞ্জে মিলাদ-দোয়া মাহফিল-স্মরণ সভা এবং একটি স্মারক সংকলন প্রকাশিত হবে। ইতিপূর্বে বৃহত্তর সিলেটের প্রবীন আইনজীবী-সাংবাদিক-কলামিষ্ট ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুর রহমান মুজিবকে আহ্বায়ক এবং ঢাকার হবু আইনজীবী ও সমাজ সংঘটক আনোয়ার সামশ আদনানকে সদস্য সচিব করে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হয়েছে।
একজন ধর্মপ্রাণ সাচ্চা মুসলমান একজন সহজ সরল সাদা মনের মানুষ কর্মবীর মোহাম্মদ আনোয়ার এর উজ্জল স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করছি।
মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। মহান মালিক তাঁর বেহেশত নসীব করুন-এই মোনাজাত সহ আমীন। ছুম্মা আমীন।
[মরহুমের স্নেহ ধন্য দৌহিত্র। বীর মুক্তিযোদ্ধা। সিনিয়র এডভোকেট হাইকোর্ট-জজ কোর্ট। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব। কবি ও কলামিষ্ট।]

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com