ব্লাডকন্যা সানজানা শিরিনের এইসব দিনরাত

January 9, 2017,

মাহফুজ শাকিল : একজনের রক্ত আরেকজনের জীবন, রক্তই হোক আত্মার বাঁধন। রক্তই রক্তের বিকল্প, অন্য কিছু নয়। অনেক চেষ্টা করেও বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম রক্ত আবিষ্কার করতে সক্ষম হননি। রক্ত একটি অমূল্য সম্পদ। জরুরী প্রয়োজনে অনেক সময় রক্তের অভাবে মানুষের জীবন প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই অকালেই নিভে যায়। তবে সমাজের কিছু মানুষ আছেন, যারা বিষয়টি নিয়ে ভাবেন এবং চেষ্টা করেন অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। রক্তের অভাবে প্রাণ যাবে না কারও এই দৃঢ় প্রত্যয়ে নিয়ে মানুষের মুখে হাঁসি ফোঁটানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছেন ২৩ বছরের একটি মেয়ে।

মানুষের জীবন বাঁচানোর প্রেরণা নিয়ে স্বেচ্ছায় রক্তদান ও রক্ত সংগ্রহ করে দিতে সে মূর্তপ্রতীক হয়ে দাঁড়াচ্ছেন মুমূর্ষু রোগীদের পাশে। নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক এ্যাকাউন্টকে বেছে নিয়েছেন রক্ত সংগ্রহ করার প্রধান মাধ্যম হিসেবে। কারো রক্তের প্রয়োজন পড়লে সাথে সাথে ফেসবুকে স্ট্যাটাস। রক্তদিন জীবন বাঁচান। সারাক্ষণ অপেক্ষায় থাকেন একটি আহ্বানের, ‘একজন মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচাতে রক্তের প্রয়োজন।’ খবর পেলেই ছুট। রোগীর ঠিকানা নিয়ে পৌঁছে যান হাসপাতালে। রক্ত দিয়ে ফেরেন হাসিমুখে।

সেই রক্তপ্রেমী মেয়ের নাম সানজানা শিরিন। সময়মতো রক্ত পাওয়া নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সে দিনরাত অবধি কাজ করে যাচ্ছে। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ চিরন্তন কথাটি আক্ষরিক রূপদানে সচেষ্ট সানজানা শিরিন। নিজ উদ্যোগে মানবসেবার ধর্মকে বুকে লালন করে রক্তদান কাজে তার পদচারণা। নানা ধরণের মানুষের সঙ্গে পরিচয় আর অনেক পরিস্থিতি সামাল দেয়ার যোগ্যতা অর্জনকে নিজের অর্জন মেনে সামর্থ্যরে পুরোটা ঢেলে দিয়ে রাইট টার্গেট গ্রুপ অব বাংলাদেশ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী রক্তদান সংস্থা ও  রক্তদানের অপেক্ষায় বাংলাদেশ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপের সাথে কাজ করছেন শারমিন। সারাদেশ ব্যাপী এ গ্রুপের ২৯জন এডমিন রয়েছেন। সিলেট বিভাগের ৩জন এডমিন রয়েছেন। তন্মধ্যে শিরিন অন্যতম। অচেনা-অজানা মানুষের সঙ্গে তৈরি করে চলছেন রক্তের বন্ধন। প্রায় ৩ বছর ধরে রক্তদান উদ্বুদ্ধকরণে কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন বিভিন্নভাবে। সে সিলেট বিভাগের সবকটি জেলা বিশেষ করে মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ক্যাম্পের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় রক্তদান, রক্ত সংরক্ষণ, স্ক্রিনিং ও ক্রসম্যাচিং পরীক্ষার কাজেও সহযোগিতা করে আসছেন অত্যন্ত নিষ্টার সাথে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন মানুষের সাথে এক সেতুবন্ধন। যার একটু আহবানে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ রক্তদান করতে ছুটে চলে আসেন সানজানা শিরিনের কাছে।

শিরিন হবিগঞ্জ জেলা সদরের বহুলা গ্রামের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সৈয়দ আলী ও গৃহিণী আয়েশা বেগমের মেয়ে। পরিবারের ৬ বোন ও ২ ভাইয়ের মধ্যে সে ৩য়। শিরিন ২০০৯ সালে হবিগঞ্জ সদরের আইডিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি, ২০১১ সালে বৃন্দাবন সরকারী কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি, ২০১৬ সালে মৌলভীবাজার সরকারী কলেজ থেকে স্নাতক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। এবং মেডিকেল এ্যাসিসট্যান্ট কোর্স সম্পন্ন করে মৌলভীবাজার সদরে ৯মাস ইন্টার্ণি শেষ করেন। বর্তমানে হবিগঞ্জ সদরের নিজামপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্যারামেডিক্সে তার চাকুরী হয়েছে। বর্তমানে সে হবিগঞ্জে তাঁর কর্মস্থলে রয়েছে।

পৌষালী পড়ন্ত বিকাল। ঘড়ির কাটায় তখন বিকাল ৪টা। ফোন দিলাম সানজানা শিরিনকে। তোমার একটা সাক্ষাৎকার নেব। সে বললো ভাইয়া মৌলভীবাজার পৌরসভা প্রাঙ্গণের সামনে এসে আমাকে ফোন দিবেন। আমি বাসা থেকে চলে আসবো। পৌরসভা প্রাঙ্গণে যাওয়ার পর দেখলাম শিরিন অপেক্ষা করতেছে। যাক একটা সুন্দর জায়গায় বসলাম। আমার সাথে ছিলেন সাপ্তাহিক কুলাউড়ার ডাক পত্রিকার বার্তা সম্পাদক ও নিউনেশন প্রতিনিধি অগ্রজ এম, মছব্বির আলী। শুরু হলো কথোপকতন। সময় তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। পৌরসভার ইকোপার্কে বসে বসে আমরা কফি ও ফুচকা খাচ্ছিলাম। অনেক কথা হলো। জানতে চাইলাম শিরিনের রক্তদান কর্মকান্ড নিয়ে কিছু কথা। শিরিন জানায় ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে প্রথমে কুলাউড়া উপজেলার কাদিপুর ইউনিয়নের একজন মহিলাকে রক্তদান করে তার সেবা কার্যক্রম শুরু করে। এ পর্যন্ত সে ব্যক্তিগতভাবে ৮বার রক্ত দান করেছে মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য। এবং রাইট টার্গেট গ্রুপ অব বাংলাদেশের নামে স্বেচ্ছাসেবী রক্তদান সংস্থার সদস্যদের সহযোগিতায় প্রায় ১৭০০ রোগীকে রক্তদান করা হয়েছে। এ পর্যন্ত যত রোগীকে রক্ত যোগাড় করে দিয়েছে তার মধ্যে একটি বাচ্চাকে রক্তযোগাড় করে দিয়ে সবচেয়ে বেশি আত্মতৃপ্তি পেয়েছি। নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি গ্রামের সানি নামের ৬ বছরের বাচ্চা (থ্যালাসেমিয়া রোগীকে) এ পর্যন্ত ৭৭ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে দিয়েছি। বর্তমানে প্রতিমাসে তার ১ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। সানির পরিবারের অবস্থা শোচনীয় হওয়ায় শিরিনসহ তার রাইট টার্গেট গ্রুপ অব বাংলাদেশর সভাপতি আসম রাসেল চিকিৎসার সমস্ত খরচাদি ব্যয় করেন। আমরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেই রোগীদের জন্য রক্ত সংগ্রহ করার জন্য। আমাদের আহবানে অনেকে সাড়া দিয়ে নিজে আগ্রহ দেখিয়ে চলে আসে আমাদের কাছে রক্ত দেয়ার জন্য। কিন্তুু এমন কিছু মানুষ আছেন তারা মনে করেন আমরা আর্থিক অনুদানের জন্য এসব কাজ করতেছি। কিন্তুু এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা, কল্পনাতীত। আমরা আমাদের ব্যক্তিগত অর্থায়নে আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো মানুষদের সচেতন করে তোলা। রক্তদান করতে আগ্রহী করে তোলা। মানুষের রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করতে সব ধরণের সহযোগিতা করা। এই কাজের সাথে সম্পৃক্ত থেকে লোভ জিনিসকে কবর দিয়ে দিয়েছি।

এত মানুষের সাথে কিভাবে পরিচয় প্রশ্নের জবাবে শিরিন বলেন, ‘আগে থেকে কারও সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠেনি। বিভিন্ন সময় রক্ত দিতে গিয়ে মানুষের সাথে আমার পরিচয়। এরপর ফেসবুকে কথাবার্তা। একটা সময় চিন্তা করলাম, নিজের একটা প্লাটর্ফম দরকার। এরপর সবার সঙ্গে আলোচনা। অবশেষে ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে রক্তদানের যাত্রা শুরু।’

এত চাহিদা? সামাল দেন কীভাবে? শিরিন মুখে হাঁসি টেনে বলেন, আমাদের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা এখন অনেক বেশি। সামাল দেওয়া কঠিন বটে তবে পারছি তো। কারণ আমাদের বড় শক্তি ফলোয়াররা। ফেসবুকে রক্তের আহ্বান পোস্ট করলেই ফলোয়াররা যোগাযোগ শুরু করেন। এরপর আমাদের নির্দেশনা অনুযায়ী রক্তদাতা পৌঁছে যান রোগীর কাছে। অবশ্য রোগীর বিস্তারিত জেনে তারপর আমরা উদ্যোগ নিই।’

শিরিন বলেন, ‘রক্ত দেওয়ার পর রোগীর স্বজনদের মুখে যে হাসি দেখি তাতে মন ভরে যায়।’ তবে তিনি রোগীর স্বজনদের জন্য শোনান সতর্কবাণীও, ‘রক্ত দেওয়ার জন্য কাউকে কোনো ধরনের টাকা দেবেন না। আমরা এই কাজটা করি মানবসেবা হিসেবে স্বেচ্ছায়। অনেকে রোগীর স্বজনদের বিভ্রান্ত করেন।’ শিরিন আরো বলেন, গত ৩ বছর ধরে আমরা বিভিন্নভাবে রক্তদান কার্যক্রম চালিয়ে আসছি। একজন মানুষের সবচেয়ে দামি উপহার রক্ত। জীবনের জন্য রক্তের প্রয়োজন। রক্তদান হল সামাজিক অঙ্গীকার। এটি মানবিক দায়বদ্ধতাও বটে। একমাত্র মনের আত্মতৃপ্তি ও মানুষের মুখে সুন্দর হাসি ফোঁটানোর জন্য আমাদের এ কাজ করা। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মানুষের কল্যাণে কাজ করে যেতে চাই। সেজন্যে চাই আপনাদের সকলের আন্তরিক সহযোগিতা ও ভালোবাসা। আপনার দেয়া এক ব্যাগ রক্ত কতগুলো জীবন বাঁচাতে পারে ভেবে দেখেছেন? আপনার এক ব্যাগ  রক্তই হয়ত কোন মায়ের কাছে তার আদরের ছেলের প্রাণ কিংবা কোন ভাইয়ের কাছে তার স্কুলপড়–য়া ছোট্ট বোনের হৃদয় তোলপাড় করা মুখের হাঁসি। সর্বোপরি যারা মানুষের জীবন প্রদীপ বাঁচাতে এ ধরনের কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের জীবন বাঁচানোর দূত বলা হয়।

পাঠকের সুবিধার্তে সানজানা শিরিনের মোবাইল নাম্বার দেয়া হলো (০১৭৮৫-৮৯ ০৩ ১৬)

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com