বড়দিন : ভালবাসা-স্নেহে পূর্ণ শান্তা ফারজানা

December 25, 2018,

‘ঘৃণা নয়, ভালোবাসো। ভালোবাসো সবাইকে, ভালোবাসো তোমার প্রতিবেশীকে, এমনকি তোমার শত্রুকেও। মানুষকে ক্ষমা করো, তাহলে তুমিও ক্ষমা পাবে। কেউ তোমার এক গালে চড় মারলে তার দিকে অপর গালটিও পেতে দাও।’

মানুষকে অকৃত্রিমভাবে ভালবাসতে শিখিয়ে গেছেন যিনি তিনি হলেন মহামানব যিশু খ্রিস্ট।২৫ ডিসেম্বর  তাঁর জন্মোৎসব উপলক্ষ্যে পালিত হয় বড়দিন। খ্রিস্টমাস খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। খ্রিস্টান ধর্মানুসারীদের বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী- এইদিনে ফিলিস্তিনের বেথলেহেমে জন্ম নিয়েছিলেন মহামানব, যিশুখ্রিস্ট। খ্রিস্টমাসের এই পবিত্র তারিখের ঠিক নয় মাস পূর্বে মেরির গর্ভে প্রবেশ করেন যিশু।  তখন থেকেই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা এই দিনটিকে বড়দিন হিসেবে উদযাপন শুরু করে। প্রতিটি মানুষের মনকে ভালোবাসা ও ত্যাগের মহিমায় সিক্ত করে তোলাটাই বড়দিনের মূল লক্ষ্য। ইংরেজী খ্রিস্টমাস(ঈযৎরংঃসধং) শব্দটির উৎপত্তি আদি ইংরেজি ঈৎরংঃবং সধবংংব শব্দবন্ধ থেকে। ঈৎরংঃবং শব্দটি গ্রিক ঈযৎরংঃড়ং এবং গধবংংব শব্দটি লাতিন গরংংধ (পবিত্র উৎসব) থেকে উদগত।

আবার প্রাচীন গ্রিক ভাষায় ঢ হল ঈযৎরংঃ বা খ্রিস্ট শব্দের প্রথম অক্ষর। পরবর্তীতে খ্রিস্টমাসের নাম সংক্ষেপ হিসেবে এক্সমাস শব্দটিও বহুল প্রচলিত হয়। যিশু খ্রিষ্ট পৃথিবীতে মানুষের রূপ ধরে জন্মগ্রহণ করেন। এই পৃথিবীর সকল পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে, মানুষে মানুষে বন্ধনকে আরও সুসংহত করতে। রোম সাম্রাজ্যের শাসনামলে ইউরোপে সব থেকে বড় উৎসব ছিল তাঁদের কৃষি দেবতা ও শনি গ্রহের সম্মানে এক বিশেষ ‘উৎসব’। এই উৎসবটি শীতকালের মাঝামাঝিতে ২৫ ডিসেম্বরের দিকে পালন হতো। ওই সময় রোম সাম্রাজ্যের সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি কর্মকান্ড বন্ধ থাকত। সে উৎসবে সবাই ছোট-বড়, ধনী-গরিবের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে যেত কিছুদিনের জন্য। সেই সময় যিশুর অনুসারীরা এই উৎসবকে ‘বিধর্মী উৎসব’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল। যিশুর জন্ম দিন সম্পর্কে তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন না বলে তাঁরা তাঁর পুনরুত্থানের দিনের কাছাকাছি সময়কেই তাঁর জন্মদিন হিসেবে পালন করতে শুরু করেন। তাঁদের কেউ কেউ ৬, ১০ জানুয়ারি আবার কেউ কেউ ১৯, ২০ এপ্রিল আবার কিছু অংশ ২০ মে আবার অনেকেই ১৮ নভেম্বরকে বড়দিন উৎসব হিসেবে পালন করতেন। তাঁর অনুসারীরা এও বিশ্বাস করত ২৫ মার্চেই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে এবং এই দিনেই যিশুকে ক্রুশে দিয়ে হত্যা করা হয়। পুরাতন বাইবেল বা ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ী পুরোহিতগণ বিশ্বাস এবং প্রচার করতেন যে, “প্রবক্তাগণ সকলেই পূর্ণ বছর বাঁচেন এবং জন্ম দিনেই তাঁদের দেহত্যাগ ঘটে।” যুক্তি হিসেবে তাঁরা বলতেন, “ঈশ্বর অসম্পূর্ণতা বা ভগ্নাংশ পছন্দ করেন না।” পুরোহিতদের এই বিশ্বাসকে অকাট্য প্রমাণ করতেই, ২৫ মার্চকে ঠিক করা হয় একটি মহান দিন হিসেবে। যে দিনে স্বর্গ-মর্ত্যের স্রষ্টা, রাজাধিরাজ, সর্ব শক্তিমান ঈশ্বর তাঁর মহাদূত গ্যাব্রিয়েলকে কুমারী মরিয়মের কাছে পাঠিয়ে এই সংবাদ দেন যে, “ঈশ্বরের ইচ্ছায় ও অলৌকিক ক্ষমতায় মরিয়ম গর্ভবতী হবেন এবং ঈশ্বরের পুত্রকে গর্ভে ধারণ করবেন। তাঁর নাম রাখা হবে যিশু।”

কুমারী মরিয়ম গর্ভবতী হওয়ার দিন থেকে ৯ মাস হিসেবে ২৫ ডিসেম্বর যিশু খ্রিষ্টের দিন। ৩৩৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে রোমান বর্ষপঞ্জিতে ২৫ ডিসেম্বরকে বড়দিন উৎসব হিসেবে উদ্যাপন করার নির্দেশনা দেওয়া হয় বলে জানা যায়। রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিষ্ট ধর্ম রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দিনে দিনে বড়দিন উৎসব আরও প্রাণ পেতে শুরু করে। ইউরোপে যিশুর অনুসারীরা নিশি জাগরণ, প্রার্থনার পাশাপাশি উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে বড়দিন পালন করা শুরু করে। বড়দিন উৎসবে তাঁরা ‘ক্রিসমাস ক্যারল’ বা আনন্দ গানের আয়োজন করে। আর এই সংস্কৃতি আমাদের বাংলাদেশি সংস্কৃতিতে ‘বড়দিনের কীর্তন’ হিসেবে জায়গা করে নেয়।

বিশ্বজুড়ে ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন পালন করে। আধুনিক বিশ্বে বর্তমান সময়ে বছরের যে দিনটিকে ঘিরে বিশ্বজুড়ে ছোট-বড় সব মানুষের প্রবল আগ্রহ, উৎসাহ, উদ্দীপনা তার কেন্দ্র হচ্ছে ২৫ ডিসেম্বর, যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিন। এই দিনটি সবার কাছে পুণ্যময় বড়দিন বলেই পরিচিত।উপহার প্রদানের রীতিটি সহ বড়দিন উৎসবের নানা অনুষঙ্গ খ্রিষ্টান ও অ-খ্রিষ্টানদের অর্থনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই উৎসব উপলক্ষে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয়ের একটি বিশেষ মরসুম চলে। বিগত কয়েকটি শতাব্দীতে বিশ্বে বিভিন্ন অঞ্চলে বড়দিনের অর্থনৈতিক প্রভাবটি ধীরে ধীরে প্রসারিত হতে দেখে গেছে। বর্তমান সময়ে ‘বড়দিন উৎসব’-এর অতিমাত্রায় বাণিজ্যিকীকরণ এবং বাণিজ্যিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে আরও আড়ম্বরপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

এখন বড়দিন আর কেবল ‘ক্রিসমাস ট্রি’ সাজানোর মধ্যে থেমে নেই। এতে যোগ হয়েছে আলোকসজ্জা, শুভেচ্ছাকার্ড বিনিময়, উপহার দেওয়া-নেওয়া, চকলেট আদান-প্রদান, ঘুরতে যাওয়া, বড়দিনের পিঠা বানান, কেক কাটা ও মিলন ভোজ-সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় উচ্চাসনে থাকা প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়। খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস মতে, গোয়াল ঘরে যিশুর মনোরম ‘জন্মদৃশ্য’ এবং এর ‘ভাস্কর্য’ বা চিত্রকলার ব্যবহার রীতি এখন খুব প্রচলিত। মধ্যযুগে এর প্রচলন করেছিল যিশুর অনুসারীরাই এবং তাঁরা ছিলেন ইউরোপিয়ান। উত্তর ইউরোপের অনুসারীরাই বড়দিন উৎসবের অন্যতম আনন্দ উপাদান ‘ক্রিসমাস ট্রি’র প্রবর্তক। তারাই এই রীতিকে লালন করে এই পর্যায়ে এনেছে এতে সন্দেহ নেই। এছাড়াও রয়েছে নানারকম খাদ্যায়োজন।

ইংল্যান্ডের পারিবারিক ভোজসভায় থাকে ক্রিসমাস পুডিং। ভোজসভার খাদ্যতালিকা অবশ্য একেক দেশে একেক রকম হয়। সিসিলি প্রভৃতি কয়েকটি অঞ্চলে ক্রিসমাসের পূর্বসন্ধ্যায় যে ভোজসভা আয়োজিত হয় তাতে থাকে বারো রকমের মাছ। ইংল্যান্ড ও ইংরেজি সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত দেশে বড়দিনের ভোজসভায় দেখা যায় টারকি (উত্তর আমেরিকা থেকে আনা), আলু, শাক-সবজি, সসেজ ও গ্রেভি ছাড়াও থাকে ক্রিসমাস পুডিং, মিন্স পাই ও ফ্রুট কেক। পোল্যান্ড, পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশ ও স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলের ভোজে মাছের উপস্থিতি লক্ষণীয়। তবে এসব অঞ্চলে ভেড়ার মাংসের ব্যবহারও হয়। জার্মানি, ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ায় হাঁস ও শূকরের মাংস বেশ জনপ্রিয়। এ ছাড়া প্রায় সারা বিশ্বেই গোমাংস, হ্যাম ও মুরগির যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। ফিলিপাইনে ভোজসভার প্রধান খাদ্য হলো হ্যাম। বিশেষ ধরনের টার্ট ও কেকের সঙ্গে বিশেষ ডেজার্টও তৈরি হয়। ক্রিসমাস উপলক্ষে মিষ্টি আর চকোলেট সারা বিশ্বেই জনপ্রিয়। ক্রিসমাসের বিশেষ মিষ্টিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জার্মান স্টোলেন, মারজিপান কেক বা ক্যান্ডি এবং জামাইকান রাম ফ্রুট কেক। উত্তরের দেশগুলোতে শীতকালে যে অল্প কটি ফল পাওয়া যায় তার মধ্যে কমলালেবু ক্রিসমাসের বিশেষ খাদ্য হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে পরিচিত। বড়দিন উপলক্ষে বিশেষ ধরনের সাজসজ্জার ইতিহাসটি অতি প্রাচীন। প্রাক-খ্রিস্টীয় যুগে, রোমান সাম্রাজ্যের অধিবাসীরা চিরহরিৎ বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা দিয়ে বাড়ি সাজাত। খ্রিস্টানরা এ জাতীয় প্রথাগুলোকে তাদের দৃশ্যমান রীতিনীতির মধ্যে স্থান দেয়। বাংলাদেশে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক প্রবৃত্তিও আনন্দিতচিত্তে অংশগ্রহণের উপলক্ষ্যে পরিণত করেছে খ্রিস্টমাসকে অর্থাৎ বড়দিনকে। ২৫ ডিসেম্বর দিনটি শুধুমাত্র মানবজাতির ত্রাণকর্তা যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিন নয়, বরং চিরমঙ্গলময় ঈশ্বর এবং মানুষের মাঝে ভালোবাসার এক উজ্জ্বল স্বাক্ষর। যিশু বলেছেন, ‘পাপীকে নয়, ঘৃণা করো পাপকে। গরিব-দুঃখীদের সাধ্যমতো সাহায্য করো, ঈশ্বরকে ভয় করো।’

সুন্দর এই দিনের, সুন্দর এই বাণীগুলো সবার মাঝে ছড়িয়ে যাক এই কামনা নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে বরাবরের মত অবিরত… শান্তা ফারজানা, প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, সাউন্ডবাংলা স্কুল ও সভাপতি, জাতীয় শিক্ষাধারা॥

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com