বড়লেখার জীবন সংগ্রামী ৪ জয়িতার গল্প
আব্দুর রব॥ জীবনে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ইচ্ছেশক্তির জোরে সমাজে নিজের অবস্থান করে নিয়েছেন অনেক নারী। পরিবারের পাশাপাশি সমাজের উন্নয়নেও তারা ভূমিকা রেখে চলেছেন। বন্ধুর পথে চলেও নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব তারা প্রমাণ করতে পারা এসব নারীরা সমাজের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছেন। প্রকৃত অর্থে তারাই জয়িতা, বাংলাদেশের আলোক বর্তিকা, সকলের অনুপ্রেরণা।
এরকম ৪ জয়িতা মৌলভীবাজারের বড়লেখায় নানা প্রতিবন্ধকতা ও সমস্যা-সংকটের সঙ্গে লড়াই করে অর্থনৈতিকভাবে সফলতা অর্জন করেছেন। জীবন সংগ্রামের বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে সফলতার জন্য তারা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়িত ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ ২০১৮’ নির্বাচিত হয়েছেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ ৪ জয়িতার হাতে তুলে দেয়া হয়েছে তাদের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পুরস্কার। কীভাবে জীবন সংগ্রামে জয়ী হলেন এই চার নারী? সেটা জানতে কথা হয় তাদের সঙ্গে। সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হলো অনুপ্রেরণাময় গল্পগুলো।
জবা রানী দত্ত : পৌরসভার তেলিগুলের বাসিন্দা প্রদীপ রঞ্জন ধরের স্ত্রী জবা রানী দত্ত অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসেবে জয়িতার পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি জানান, পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে এইচএসসি পাশ করার পরপরই তার বিয়ে হয়। পড়াশোনার প্রতি ছিল তার খুব আগ্রহ। কিন্তু তা আর হয়নি। স্বামীর সংসারেও অভাব-অনটন। বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে ডিএইচএম পাশ করেন। এরই মাঝে প্রথম ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। অর্থ সংকট আরো বেড়ে যায়। ছেলেটাকে ভালোভাবে মানুষ করার মত কোনো টাকা-পয়সা ছিল না। চিন্তা করলেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। এরপর শুরু করেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশনি করা। টিউশনির অর্থ দিয়ে মোরগ কিনে বাড়িতে পালন শুরু করেন। এভাবে ধারাবাহিকভাবে একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা, বাড়িতে হোমিও ওষুধ বিক্রি, সেলাই মেশিন দিয়ে কাপড় তৈরি করে অর্থনৈতিক সংকট দূর করেন। এরপর কয়েকজনের সহোযোগিতায় ও জমানো টাকায় ৮০ হাজার টাকা দিয়ে হোমিও ফার্মেসি করেন। ২০১২ সালে প্রাক প্রাথমিক মন্দির স্কুলেও শিক্ষকতার সুযোগ পান। বর্তমানে তিনি তিন সন্তানের জননী। সকলেই লেখাপড়া করে ভালো অবস্থানে রয়েছে। পরিবারের কষ্টও দূর হয়েছে। এই অবস্থানে আসতে তাকে সবচেয়ে বেশি প্রেরণা জুগিয়েছেন তার শ্বশুর। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
রাবিয়া বেগম : উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের আলালপুর গ্রামের আব্দুল মুকিতের মেয়ে রাবিয়া বেগম শিক্ষা ও চাকুরীর ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসেবে জয়িতা পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি জানান, ৪ বোনের সবার বড় তিনি। সংসারের আর্থিক সংকটের কারণে স্বচ্ছল জীবনের আশায় বাবা বিদেশ পাড়ি জমান। কিন্তু সংসারে স্বচ্ছলতা আসেনি। সংকট বেড়ে চলে। বাবা তিন-চার মাসে একবার টাকা পাঠান। যা সংসার চালানোর জন্য যতেষ্ট নয়। কিশোরী বয়স থেকে মাকে সাহায্য করতে শুরু করেন। শত কষ্টের মাঝে ৯৩ সালে এসএসসি পাশ করেন। এরপর সম্পূর্ণ চাপ পড়ল পরিবারে। টিউশনি শুরু করেন। টিউশনির টাকায় মাকে সহযোগিতা, পড়ালেখা চালিয়ে যান। তৎকালিন বড়লেখা ডিগ্রি কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হন। তখন ট্রেনে যাতাযাত করতে হতো। কলেজ শেষে ট্রেনে সীমান্ত এলাকা শাহবাজপুর যেতে অনেক সময় রাত হয়ে যেত। মা কুপি বাতি নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। অনেকে নানান কথা বলত। তারপরও লক্ষ্যে স্থির ছিলেম। ৯৫ সালে করমপুর কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঁচশত টাকা বেতনে চাকরি নেন। এই টাকাও পেতে পাঁচ-ছয় মাস লাগত। ভাই বোনেরাও বড় হতে লাগল। চাপ বেড়ে গেল। হাল ছাড়িননি। অনেক প্রতিকূলতা মাড়িয়ে বিকম পাশ করেন। ২০০৩ সালে বিয়ে হয়ে যায়। এই দু:খের মাঝে একমাত্র ভাইটিও মারা গেল। ভাইয়ের শোকে মা অসুস্থ হয়ে গেলেন। দিন দিন অবস্থার অবনতি হয়ে থাকে। ২০০৭ সালে মা মারা যান। এই পরিস্থিতিতে বোনদেরও দায়িত্ব পড়ে নিজের ঘাড়ে। এক্ষেত্রে স্বামীও সহায়তা করেন। ওদের দায়িত্ব নিলেন। বোনেরা চাকরির পাশা পাশি পড়াশোনাও করছে। শত প্রতিকূলতার মাঝে তিনি এখন সফল।
স্বপ্না রানী শীল : পৌরসভার মুড়িরগুলের বাবুল কুমার চন্দের স্ত্রী সফল জননী হিসেবে সাফল্য অর্জনকারী নারীর পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি জানান, ৮৭ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগাদান করেন। ৮৯ সালে সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা বাবুল কুমার চন্দের সাথে বিয়ে হয়। দুটি ছেলে সন্তান রয়েছে। ছেলেদের সফল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। বড় ছেলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হতে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে অনার্স পাশ করেছে। সে স্কলারশিপ নিয়ে কানাডায় পড়াশোনা ও একটি কম্পিউটার ফার্মে কর্মরত। ছোট ছেলে ঢাকায় আমেরিকান ইন্টারন্যাশনেল ইউনিভারসিটি অব বাংলাদেশে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশুনার পাশাপাশি একটি কমম্পিউটার ফার্মে কাজ করছে। সেও স্কলারশিপ নিয়ে কানাডায় পড়াশোনায় যাওয়ার চেষ্টা করছে।
সেফালী বেগম : দক্ষিণভাগ উত্তর ইউনিয়নের মুছেগুল গ্রামের হেলাল উদ্দিনের স্ত্রী সমাজের উন্নয়নের অবদান রাখায় পুরস্কার পেয়েছেন। সেফালী বেগম জানান, ভাই বোনদের মধ্যে তিনি ৩য়। দরিদ্র বাবার পরিবারে বেশি দূর লেখাপড়া করা হয়নি। মানুষের জন্য কাজ করার প্রবল ইচ্ছা ছোট বেলা থেকেই। কিন্তু ১৮ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের আগে সমাজসেবা ও মহিলা বিষয়ক অফিস থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ নেন। ২০১৪ সালে সমাজসেবামূলক কাজে নেমে পড়েন। পল্লী উন্নয়ন সংস্থা নামে একটি মহিলা সমিতি খুলেন। ৩৫ সদস্যকে নিয়ে সমিতির যাত্রা। ২০১৫ সালে মহিলা বিষয়ক অফিসে সমিতি রেজিষ্ট্রেশন করেন। বর্তমানে তিনি সমিতির কোষাধক্ষ্য হিসেবে কর্মরত। তিনি এবং সমিতির সদস্যরা মিলে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করছেন। এ পর্যন্ত প্রশাসনের সহযোগিতায় ১২টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছেন। বর্তমানে নারীদের নিয়ে সেলাইয়ের কাজ চালু করতে অগ্রসর হচ্ছেন।
মন্তব্য করুন