বড়লেখায় বন্যার্তদের দাঁড়ানোর লড়াই ‘রাত কাটে আফাল ও সাপ আতঙ্কে’ ভাঙা ঘর নিয়ে দুশ্চিন্তা,
আবদুর রব॥ তৃতীয় দফা বন্যায় মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার হাকালুকি হাওরপাড়ের সুজানগর, বর্নি ও তালিমপুর ইউনিয়নের বিধ্বস্ত ঘরবাড়ির সংখ্যা প্রায় দেড় সহ¯্রাধিক। গত মার্চ মাস থেকে এ উপজেলায় চলছে টানা বন্যা। তলিয়ে গেছে রান্না ঘর, টিউবওয়েল ও শৌচাগার।
এমনিতেই হাওড়পারের বাসিন্দাদের টানাপোড়নের সংসার। এরই মধ্যে টানা ৬ মাস ধরে বন্যা। প্রথম দফা বন্যায় তলিয়ে যায় ধান, দেখা দেয় মাছের মড়ক। ২য় দফা বন্যায় তলিয়ে যায় ঘরবাড়ি। এরপর পানি কিছুটা কমতে শুরু করে। ঘর-বাড়িসহ বিভিন্ন দিক থেকে ক্ষতির পর যখন ঘুরে দাঁড়ানের চেষ্টা করছিলেন হাওড় পাড়ের সংগ্রামী মানুষ। ঠিক তখন থেকে টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে আবারও হাকালুকি হাওরের পানি বৃদ্ধি পেয়ে তলিয়ে যায় বাড়ি ঘর। সব মিলেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এ ব্যনায় হাওড় পাড়ের মানুষ এখন দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন।
সুজানগর ইউনিয়নের আজিমগঞ্জবাজার থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে ভোলারকান্দি গ্রাম। আজিমগঞ্জ বাজার থেকে নৌকা করে ভোলারকান্দি গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ে পানিবন্দী বাড়িগুলো। গ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে দেখা যায়, অনেক বাড়িরই ভিটে বাঁশ ও কচুরিপানা দিয়ে ঢেউ থেকে রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছে। অনেক ঘরের ভিটার মাটি হাওরের ঢেউয়ে ভেসে গেছে। মাটি ভেসে যাওয়ায় ঘরের তলা ফাঁকা হয়ে আছে। বাঁশের খুঁটির উপর টিনের চালা ও বেড়া দাঁড়িয়ে আছে।
রোববার সরেজমিনে সুজানগর ইউনিয়নের ভোলারকান্দি, দশঘরি, রাঙ্গিনগর, বাড্ডা, ঝগড়ি, পাটনা, চরকোনা, কটালপুর ও তালিমপুর ইউনিয়নের ইসলামপুর, হাল্লা, আহমদপুর, কুটাউরা, মুর্শিবাদকুরা, নুনুয়া, পাবিজুরী, শ্রীরামপুর, বাড্ডা, পশ্চিম গগড়া, কুঁচাই গ্রাম ঘুরে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকজন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে এসব চিত্র ও তথ্য পাওয়া গেছে।
গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তের আব্দুল মতলিবের বাড়ির পাঁচটি ঘরের প্রায় সবকটি ঘরেরই ভিটের মাটি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে ঢেউ। আব্দুল মতলিব বলেন ‘তিনবারকুর বন্যায় আমরারে একবারে শেষ করি দিছে। আমার কষ্টের বানাইল ঘরটিও বন্যায় ভাঙ্গি দিছে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আফাল (ঢেউ) উঠে। রাইত অইলে ঘুম নাই। ঘরে ঠিকা দায়। সাপেরও ডর লাগে। বন্যায় অনেকে ভিটা ছাড়া করছে। ঘুমাইবার জাগা নাই। খুব কষ্টে দিনকাল কাটের। খাইতাম পারিয়ার না, ঘর বানাইতাম কিলা।’
মুতলিব আলীর মতো একই অবস্থা প্রতিবেশি করিম উদ্দিন, নুরুল ইসলাম ও তৈমুন বিবির। বন্যায় তাদের ঘর একেবারেই ভেঙ্গে দিয়েছে। এই তিন বাড়িতে লোকজন নেই। তারা এখন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।
একই গ্রামের কনই মিয়া (৫০)। আফালে তার ঘরের ভিটা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। কনই মিয়া বলেন, ‘আফালে (ঢেউয়ে) আমার ঘরখান একেবারে ভাঙ্গিলাইছে। এখন আশ্রয় নিয়েছেন প্রতিবেশীর বাড়িতে। খুব কষ্টের মাঝে আছি। অন্যের বাড়িতে থাকিয়ার, খাইয়ার। ঘর বানাইতাম কিলান। এখন ওউ চিন্তায় রাইত কাটে।’
তছিরুন বেগম (৩৫) বলেন, ‘সারা ঘর দুয়ার পানিয়ে নিছেগি।’ পানি ও ঢেউয়ে ঘর ভেঙে যাওয়ার কথা জানালেন, মজিরুন বেগম, আমিনা বেগম, শফিকুল ইসলাম, আকলিছুন বেগম, আখতার আলী, মনাই মিয়া, রোশনা বেগম, আলেকজান বেগম, সালাম উদ্দিন প্রমুখ।
সুজানগর ইউনিয়নের ১নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে দশঘরী ও ৪নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে ভোলারকান্দি। ১ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শহীদ মিয়া ও ৪নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মাসুক আলী বলেন, ‘এলাকার বেশিরভাগ মানুষই মৎস্যজীবী। এরা মাছ ধরে জীবিকা চালায়। পানি বেশি হওয়ায় হাওরে মাছ নেই। বন্যায় অনেকেরই ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত। এগুলো ঠিক করাতে সরকারি সাহায্য তাড়াতাড়ি দরকার।
সুজানগর ইউপি চেয়ারম্যান নছিব আলী বলেন, ‘আমার ইউনিনে প্রায় সাড়ে পাঁচশত ঘর বিধস্ত হয়েছে। এসব ঘর নতুন করে নির্মাণ করা ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে সম্ভব নয়। ঝুঁকি নিয়ে মানুষ ঘরে বসবাস করছে। দ্রুত সরকারি সাহায্য প্রয়োজন।’
তালিমপুর ইউপি চেয়ারম্যান বিদ্যুৎ কান্তি দাস বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে পাঁচ শতাধিক ঘর নষ্ট হয়েছে। জরুরী ভিত্তি এসব ঘর নির্মাণের জন্য সাহায্য দরকার। সরকারি কিংবা ব্যক্তিগত সাহায্য ছাড়া কেউই উঠে দাঁড়াতে পারবে না।’
ইউএনও এসএম আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের গৃহ নির্মাণে সাহায্যের জন্য ১০০০ বান্ডেল ঢেউটিন বরাদ্দ চাওয়া হয়। সম্প্রতি ৩৫০ বান্ডেল পাওয়া গেছে। যতই দিন যাচ্ছে ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। আবারও বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। মানবিক সহায়ত কর্মসূচির আওতায় প্রাপ্ত এ টিন প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের চিহ্নিত করে দেয়া হবে।’
মন্তব্য করুন