ভারতবর্ষে মুঘল শাসনঃ মুঘল যুগের বিচার ব্যবস্থাঃ বাবর থেকে বাহাদুর শাহ্ জাফর
মুজিবুর রহমান মুজিব॥ প্রাচীন ভারতবর্ষ প্রসঙ্গেঁ বিশ^বিখ্যাত বৃটিশ ইতিহাসবিদ ভিনসেন্ট স্মিথ (Vinsent Smith) এর “বিশে^র নৃতাত্বিক যাদুশালা”- অভিমতটি সবিশেস প্রনিধান যোগ্য। এই প্রেক্ষিতে বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী প্রতিভা বিশ^ কবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাচীন ভারত বর্ষের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সভ্যতা ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গেঁ যথার্থই বলেন -“হেথা আর্য্য, হেথা অনার্য্য-হেথা দ্রাবিড় চীন, শক হুনদল পাঠান মুঘল এক দেহে হল লীন”- বিশাল ভারতবর্ষের নান্দনিক রূপ ও ভূ-প্রকৃতি-দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ, পাহাড়-পর্বত, হাওর-বাওর, ভূপৃষ্টের নীচ ও উপরিভাগের অফুরান প্রাকৃতিক সম্পদ, নয়নাভিরাম নিসর্গ এবং ভারত বাসির ভালোবাসা- মায়া মমতায় বিমুগ্ধ- আকৃষ্ট হয়ে এদেশে এসেছেন ভিনদেশীগন। রাজ্য জয় ও বসতি স্থাপন করতঃ ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। ১৫২৬ খৃষ্টাব্দে দিল্লি সালতানাত এর লোদী বংশীয় শেষ শাসক ইব্রাহিম খান লোদীকে পানি পথের প্রথম যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করেন জহিরুদ্দীন মোহাম্মদ বাবর। মাত্র পচিশ হাজার মুঘল সৈন্য নিয়ে ইব্রাহিম লোদীর লক্ষাধিক সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন। পিতৃ-মাতৃকুলের দিক দিয়ে বীর বাবর এশিয়ার দুই মহাবীর চেঙ্গিঁস খাঁন এবং আমীর তৈমুর লং এর অধঃস্থন বংশধর। ১৫২৬ থেকে ১৮৫৭ সাল ভারতে মুঘল স্রমাজ্যের প্রতিষ্টাতা জহীরুদ্দীন মোহাম্মদ বাবর থেকে দিল্লীর শেষ মুঘল স¤্রাট- সিপাহী যুদ্ধের সিপাহ্ শালার আবু জাফর সিরাজউদ্দীন মোহাম্মদ বাহাদুর শাহ্ এর শাসনামল পর্যন্ত সোয়াতিন শতাধিক বৎসরের অভিজাত মুঘল শাহী ভারতের মধ্যযুগীয় ইতিহাসের স্বর্ন যুগ-ঐতিহাসিক অধ্যায়। আয়তন ও আভিজাত্যে অভিজাত ছিলেন ভারতের মুঘল শাসকগন। সাড়ে বারো লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকার বিশে^র মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ-পনেরো কোটি মানুষের শাসক ছিলেন মুঘল স¤্রাট আলমগীর আওরঙ্গজেব। মধ্যযুগের ভারত শাসক, মধ্য এশিয়ার মুঘল সা¤্রাজ্য ভারতের ইতিহাসে শাহান-ই-গুরখানি, শাহান-ই-মুঘল, সালতানাত-ই-মুগলিয়া দৌলত-ই-মুগলিয়া নামেও অভিহিত ও পরিচিত। মুঘলগন বীরের জাতি। মহাবীর, বীর যোদ্ধা হলেও কঠিন হৃদয়ের অধিকারি ও নিস্প্রান ছিলেন না বরং ছিলেন হৃদয়বান সংবেদনশীল, শিল্প সংস্কৃতির উদার পৃষ্ট পোষক। এ যেন বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুলের ভাষায়-“মম এক হাতে বাশের বাঁশরী আর হাতে রনতুর্য্য-” এর মত অবস্থা। প্রকৃতি প্রেমি ও নিস্বর্গবিদ প্রয়াত দ্বিজেন শর্ম্মার মতে – ভারতবর্ষে বাগান চর্চার পথিকৃত মধ্য এশিয়ার মুঘলরা”। ভারতের মুঘল শাসকগন চিত্রকলা, স্থাপত্য, কৃষি, শিল্প ও সংস্কৃতিতে যে ঐতিহাসিক অবদান রেখে গেছেন তা ভারত বর্ষের মধ্যযুগের ইতিহাসে ঐতিহাসিক সংযোজন। আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্টায় ভারতের মুঘল স¤্রাটদের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা মানব সভ্যতার ক্রম বিকাশের ইতিহাসকে সমুজ্জল করেছে।
ন্যায় বিচার প্রাপ্তি একজন নাগরিকের জন্মগত মৌলিক অধিকার। আদালত মানুষের শেষ ভরসার স্থল। জন্ম থেকে মৃত্যু পরবর্ত্তী কালে ও একজন ধর্ম্ম বিশ^াসীকে বিচার প্রথা মানতে হয়, বিচারের সম্মুখীন হতে হয়। ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের শেষ বিচারের দিন রোজ হাসরের ময়দান। সেখানেই শেষ বিচার। ফলাফল জান্নাত কিংবা জাহান্নাম। মুঘলযুগে ভারতের বিচার ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং মান সম্পন্ন। দেশের প্রধান বিচারপতি – কাজি উলকুজ্জা- একজন পরম সম্মানিত ও স্বাধীন ব্যাক্তি ছিলেন। বিচারকগন কাজি সাহেব নামে অভিহিত হতেন। কেন্দ্র ছাড়াও বিভিক্ত-সুবা-সমুহে সুবাদার দের পরই ছিল কাজী সাহেবদের অবস্থান। মুঘল যুগের কাজির বিচার এর সুনাম শত বৎসর পর এখনও লোক মুখে আলোচিত প্রসংসিত। তখন আইনের কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়, লিখিত আইনপুস্তক, ভারতীয় কোড-পেনাল কোড ছিলনা কিন্তু ছিল আইন ও আইনের শাসন। বর্ত্তমানে দেশে প্রচলিত সকল আইনের প্রবর্তক কোম্পানী এবং ইংরেজ শাসকগন। তখন বিচারক-কাজি সাহেবগন ছিলেন সৎ ও স্বাধীন। স্বাক্ষী ও বিচারকগন যাবতীয় ভয়ভীতির উর্দ্ধে ছিলেন। তারা নীতি ও নৈতিকতাবোধ অনুসরণ করে ন্যায় বিচার করতেন।
১৮৫৭ সালে দিল্লীর শেষ মুঘল স¤্রাট সিপাহী যুদ্ধের সিপাহ সালার স¤্রাট বাহাদুর শাহ্ স্বাধীনতা যুদ্ধে কোম্পাীর কাছে হেরে গেলে গোপনে পালিয়ে যান নি ইংরেজদের কাছে প্রাণ ভিক্ষাও চাননি। গ্রেপ্তার হওয়ার পর ন্যায় বিচার চেয়ে ছিলেন। কোম্পানী তার বিরুদ্ধে চারটি অভিযোগ আনয়ন করেছিল। ১। কোম্পানীর নেটিভ সৈন্যগনকে বিদ্রোহে উস্কানী, ২। তাঁর পুত্র মির্জা মুঘল বৃটিশ সরকারের প্রজা হওয়া সত্বেও তিনি তাঁকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করতে উৎসাহ দিয়েছেন, ৩। বৃটিশের প্রজা হওয়া সত্বেও তিনি নিজেকে ক্ষমতাসীন বাদশাহ্ এবং ভারতের সর্বভৌম শাসক হিসাবে ঘোষনা দিয়েছেন, ৪। ১৮৫৭ সালের ১৬ই মে রাজ প্রাষাদের চৌহদ্দিতে ৪৯ জন ইংরেজকে হত্যা করায় তিনি সহায়তা দিয়েছেন। অভিযোগ অস্বীকার করে বিচার চান বন্দী বাহাদুর শাহ। ক্ষমতা লোভী ও ধূর্ত ইংরেজগন তার দাবী মেনে নিয়ে প্রহসনের বিচারের প্রস্তুতি নেয়। বিগ্রেডিয়ার শাওয়ার্স এর নেতৃত্বে তিন জন মেজর এবং একজন কেপ্টেন সমন্বয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠন করলেও পরে শাওয়ার্স এর পরিবর্তে লেঃ কর্নেল ডয়েসকে সেপদে নিয়োগ দেয়া হয়। এই বোর্ডে কোন ভারতীয় কিংবা সিভিলিয়ান ছিলেন না। বন্দী বাদশা গোলাম হোসেন নামক উকিলকে তার পক্ষে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দিলে কোম্পানী তা মেনে নেয়। এই মামলায় ইংরেজ পক্ষের আইনজীবি ছিলেন এডভোকেট হ্যারিয়েট। মামলার বিচারকালে স¤্রাটের পক্ষে, কোন আইনজীবী কিংবা স্বাক্ষী ছিলেন না। স¤্রাটের আইনজীবী গোলাম আব্বাস এবং প্রাক্তন সচিব মুকুন্দ লাল সম্্রাটের বিরুদ্দে ইংরেজের পক্ষে স্বাক্ষীদেন। তাঁরা বাহাদুর শাহ্র দিকে চোখ তুলেও তাকান নি। ১৮৫৭ সালের ৪ঠা মার্চ মুঘল স¤্রাট বাহাদুর শাহ নিজেকে ভারতের স¤্রাট দাবী করতঃ আত্বপক্ষ সমর্থন করে বিশুদ্ধ উর্দূতে যে মর্ম স্পর্শী ভাষন দিয়ে ছিলেন তা ছিল হৃদয় গ্রাহীও। ভারত স¤্রাট হিসাবে ভারতবাসির উদ্দেশ্যে স¤্রাট বাহাদুর শাহের শেষ ভাষন। ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হলেও ভারত স¤্রাট বাহাদুর শাহ্ ভিনদেশী কোম্পানীর কাছে আত্ব সমর্পন করতঃ জীবন ভিক্ষা কিংবা কোন করুনাই চাননি। ইংরেজ এডভোকেট হ্যারিয়েট আদালতে বলেন- বৃটিশ সরকারকে ভারত থেকে উৎখাত করাই ছিল বিদ্রোহের উদ্দেশ্য।। ১৮৫৮ সালের ৯ই মার্চ বিকালে এই ঐতিহাসিক মামলায় রায় হয়। আশিত পর বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ্ কে বার্মায় নির্বাসনে পাঠানো হয় আজীবন কারা বাসের আদেশ দিয়ে। ১৮৬২ সালের ৭ইং নবেম্ভর অর্ধাহারে অনাহারে বিনা চিকিৎসায় মহান মৃত্যুকে আলিঙ্গঁন করেন মহাবীর চেঙ্গিঁস-তৈমুরের অধঃস্থন বংশধর সুফি বাদি দার্শনিক কবি ও ন্যায় বিচারক আবু জাফর সিরাজুদ্দীন মোহাম্মদ বাহাদুর শাহ্।
অভিবক্ত ভারতবর্ষ ও আর তা নেই। নেই মুঘল বংশ কিংবা শাসনের শেষ চিহ্ন, কিন্তু টিকে আছে বেঁচে আছে মুঘলাই সভ্যতা ও সংস্কৃতি-স্থাপত্য কলা ও কাব্যপ্রীতি। এখনও এই আধুনিক শিক্ষিত ও সভ্য সমাজে মুঘল যুগের মান সম্মত-উন্নত বিচার ব্যবস্থার আলোচনা হয়। প্রসংশিত হয়। মুঘল শাহীর প্রজাবৎসল শাসক এবং ন্যায় পরায়ন-আদর্শ বিচারকদের উজ্জল স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি-তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।
[লেখকঃ ষাটের দশকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের ছাত্র। সত্তোর দশকে ইতিহাসের ক লেজ শিক্ষক। সাংবাদিক। মুক্তিযোদ্ধা। সিনিয়র এডভোকেট হাই কোর্ট। সাবেক সভাপতি মৌলভীবাজার প্রেস ক্লাব]
মন্তব্য করুন