ভাষা সৈনিক শ্রমিক কৃষকের নেতা মফিজ আলী : ১০ অক্টোবর ৮ম মৃত্যুবার্ষিকী

October 9, 2016,

প্রনীত রঞ্জন দেবনাথ ॥  আদর্শের কাছে নিজের জীবনকে জলাঞ্জলি দিয়েও কোন ধরনের সুযোগ-সুবিধার কাছে হার মানতে রাজি হননি। প্রচলিত সমাজে প্রতিনিয়ত অবহেলিত, শোষিত, নিষ্পেষিত হচ্ছে মানুষ। এই সব শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া আদর্শিক একটি নাম মফিজ আলী। তিনি ছাত্রত্ব জীবনে রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি তুখোড় সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা, লেখনির ক্ষুরধার, প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ, চা শ্রমিক নেতা, ভাষা সৈনিক, বালিশিরা কৃষক আন্দোলনসহ বিভিন্ন কৃষক আন্দোলনেরও একজন বলিষ্ট নেতা হিসাবে সমধিক পরিচিত ছিলেন। এসব কারনেই হয়তো অসংখ্য সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাখান করে ভাঙ্গা কুড়েঘরে দু:খ-কষ্টের সাথেই জীবন কাটিয়েছেন। তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ৬ টি বছরেও তিনি রাজবন্দী হিসাবে কারাভোগ করেছেন। জীবনের শেষ সময়েও লেখালেখির পাশাপাশি শ্রমিক শ্রেণির অধিকার আদায়ে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালনকালীন ২০০৮ সনের ৩০ আগষ্ট দুর্ঘটনা কবলিত হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩০ অক্টোবর হাসপাতালেই মৃত্যুবরন করেন।  ১০ অক্টোবর সোমবার এই মহান নেতার ৮ম মৃত্যুবার্ষিকী।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শ্রীসূর্য ধূপাটিলা গ্রামের একটি স¤্রান্ত পরিবারে ১৯২৭ সালের ১০ ডিসেম্বর মহান এই ব্যক্তিত্ব জন্মগ্রহন করেন। বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে ছাত্রজীবনে বি.এ ৪র্থ বর্ষ পর্যন্ত অধ্যয়ন করেছেন। মৌলভীবাজার সরকারী হাইস্কুল থেকে ১৯৪৯ সালে তিনি মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৫০ এর দশকে শুরু হয় তাঁর কলেজ জীবন। মদন মোহন কলেজ থেকে আই.এ পাশ করার পর এম.সি কলেজে ভর্তি হন। ছাত্র ইউনিয়নের কার্যকলাপের জন্য এম.সি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ সুলেমান চৌধুরী মফিজ আলীকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করায় তাঁর পক্ষে ডিগ্রি পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হয়নি।

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছিলেন একজন তুখোড় সাংবাদিক ও কলামিষ্ট। তিনি পাকিস্তান আমলে ডন, ইত্তেফাক, সংবাদ, জনতা, আজাদ, গণশক্তিসহ বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত সংবাদ ও কলাম লিখেছেন। ষাটের দশকে তিনি দৈনিক সংবাদ এর নিজস্ব প্রতিবেদক ছিলেন। ছাত্রজীবনে তার প্রকাশিত পুস্তিকার নাম “পাকিস্তানে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের নমুনা।” পঞ্চাশের দশকে সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে তাঁর লেখা প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে “রাষ্ট্রভাষা ও আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন”, “মে দিবসের ইতিহাস” এবং ঈদ সংখ্যায় ছোট গল্প “একটি গামছা।” সাপ্তাহিক সেবার নিয়মিত লেখক ছিলেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সেই সংগ্রামী দিনগুলোতে মফিজ আলী সিলেট এমসি কলেজের ছাত্র অবস্থায় কলেজে আন্দোলনের ফাঁকে তিনি এলাকায় ছুটে আসেন। ক্ষমতাসীন সরকারের রক্তচক্ষুতে আঙ্গুল দিয়ে কমলগঞ্জে তখনকার সময়ে ভাষা আন্দোলনের জন্য সাহসী নেতৃত্ব প্রদান করেন তিনি। অত:পর সিলেটে ছাত্র ইউনিয়নের জেলা কমিটিতে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। মৌলানা ভাসানীর গঠিত কৃষক সমিতির বৃহত্তর সিলেট জেলা কমিটির প্রথমে সহ সম্পাদক এবং পরবর্তীকালে সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। রাজনৈতিক কারনে ১৯৬০ সালে আব্বাকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করার ২ বছর পর মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৬৩ সালে তিনি শ্রীমঙ্গলে বালিশিরা কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ছালিক ও গনু মিয়া নামের ২ কৃষক মারা যান। ১৯৫৪, ১৯৬০, ১৯৬৪, ১৯৬৫, ১৯৬৭, ১৯৬৯ ও ১৯৭২ সালে রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তান নিরাপত্তা আইন ও বিভিন্ন মামলায় তিনি দীর্ঘ ৬ বছর রাজবন্দী হিসাবে কারাবরন করেছেন।

চা শ্রমিকদের দুঃখ দুর্দশা দেখে তিনি ১৯৬৪ সালে চা শ্রমিক নেতা কর্মীদের নিয়ে “পূর্ব পাকিস্তান চা শ্রমিক সংঘ” নামে একটি শ্রমিক ইউনিয়ন দাঁড় করান। এই ইউনিয়নের খবর পেয়ে চা বাগান মালিক ইউনিয়নের নেতারা মফিজ আলীকে গ্রেফতার করাতে মরিয়া হয়ে উঠে। নিজের লোভ লালসার উর্ধ্বে থেকে দেশের শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তিনি আপোষহীন রাজনীতি করেছেন। এ ধরনের সম্পূর্ন নির্মোহ, নিঃশ্বার্থবান একজন মানুষ জীবনে কখনও নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য অর্থবিত্তের দিকে ফিরেও তাকাননি। তিনি নিজেকে উৎসর্গ করে গেছেন নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য তা ধ্রুব নক্ষত্রের মতো পথ দেখাবে পথের মানুষদের। তাঁর জীবন দর্শন অনন্তকাল সকলকে প্রেরণা যোগাক, তাঁর এ স্বপ্ন বাস্তবায়িত হোক।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com