(ভিডিওসহ) ফারুকুল মাকে নিয়ে এক সাথে থাকতে গিয়ে স্ত্রীর পরিকল্পনায় খুন হলো : পিবিআইর তদন্তে রহস্য উদঘাটন
স্টাফ রিপোর্টার॥ মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ফারুকুল ইসলাম হত্যাকান্ডের মূল রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। মাকে অন্যত্র রেখে স্ত্রীর সাথে থাকার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় দুই বছরের একমাত্র মেয়ে ফাইজা তাবাছুম রাহা’র সামনে ফারুকুল ইসলামকে হত্যা করেন স্ত্রী শিরিন আক্তার, স্ত্রীর বড় ভাই ইউনুস হোসেন সুজন ও শাশুড়ি মালেকা বেগম মিলে। হত্যার ঘটনাকে ভিন্ন খাতে দেখাতে মেঝেতে শুইয়ে লাশের উপর ঘরের আসবাব পত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে। হত্যাকান্ড চলা কালে শ্বাশুড়ী মালেকা বেগম বাসার বাহিরে দাঁড়িয়ে কেউ আসে কি না তা পাহারা দেয়। বাসার মালামাল সরাতে গিয়ে দূর্ঘটনায় মারা গেছেন ফারুকুল বলে চিৎকার করেন স্ত্রী শিরিন।
মামলার এজহার সূত্রে জানা যায়, নিহত ফারুকুল ইসলামের মা জয়না বেগম গত ২৫/০৭/২০১৭ শ্রীমঙ্গল থানায় ছেলে হত্যার দায়ে স্ত্রী শিরিন আক্তার (২৫) সহ আরো ২/৩ জন অজ্ঞাত নামা আসামী করে মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এস আই মোঃ কামাল উদ্দিন মামলার একমাত্র আসামী ফরুকুলের স্ত্রী শিরিন আক্তার (২৫) কে অভিযুক্ত করে ৩১/১০/২০১৭ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
মামলার বাদী উক্ত রিপোর্টের উপর আদালতে না-রাজী দাখিল করিলে আদালত বাদীনির না-রাজী গ্রহন করে অধিকতর তদন্তের জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, পিবিআই, মৌলভীবাজারকে নির্দেশ প্রদান করেন।
বিজ্ঞ আদালতের আদেশ ১ মার্চ ২০১৮ খ্রিঃ প্রাপ্ত হয়ে উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ইন্সপেক্টর মুহাম্মদ শিবিরুল ইসলাম, কে তদন্তকারী অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়।
সোর্স নিয়োগ করে ঘটনার সাথে জড়িত মর্মে ৩০/০৫/২০১৮ খ্রিঃ তারিখে হবিগঞ্জ জেলা শায়েস্তাগঞ্জ বিশ্বরোড হতে শিরীন আক্তারের আপন ভাই মোঃ ইউনুছ হোসেন সুজন (২৭) কে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে উক্ত আসামীকে পুলিশ রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করিলে ঘটনার সাথে জড়িত মর্মে ০১/০৬/২০১৮ খ্রিঃ তারিখে বিজ্ঞ আদালতে ভিকটিম ফারুকুল ইসলামকে হত্যার বর্ননা দিয়ে ফৌঃ কাঃ বিঃ ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করেন।
৫ জুন মঙ্গলবার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কার্যলয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ শাহাদাত হোসেন এক প্রেস ব্রিফিং করে সাংবাদিকদের জানান, ৩ বছর মন দেয়া নেয়ার পর নিহত ফারুকুল ইসলাম ২০১০ সালে ৯ নভেম্বর আসামী শিরিন আক্তারকে বিবাহ করেন। নিহত ফারুকুল একজন সিএনজি পাম্প এর মেকানিক ছিলেন। এই ছাড়া তার ১ টি মাইক্রবাস ও একটি প্রাইভেট কার রয়েছে। মাইক্রবাসটি যা তিনি ভাড়া খাটাতেন এবং প্রাইভেটকারে তিনি নিজে চলতেন। আসামী শিরিন আক্তারের পরিবারের আর্থিক অবস্থার অসচ্ছল থাকায় ভিকটিম আসামীর পরিবারকে আর্থিক সহ অন্যান্য সহযোগিতার মাধ্যমে উক্ত পরিবারকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে। এরই ধারাবাহিকতায় আসামী মোঃ ইউনুছ হোসেন সুজনকে শায়েস্তাগঞ্জ জিএস ব্রাদার সিএনজি ফিলিং ষ্টেশনে নজেল ম্যান হিসেবে চাকুরী দেয়। দাম্পত্য জীবনে ফাইজা তাবাছুম রাহা নামে একজন কন্যা সন্তান রয়েছে।
বিবাহের পর হইতে নিহত ফারুকুল ইসলাম, আসামী শিরিন আক্তার ও ফারুকুলের মা অত্র মামলার বাদীনি জয়না বেগমকে নিয়ে একত্রে হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জে ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন। কিন্তু আসামী শিরিন আক্তার ভিকটিমের মা তাদের সাথে থাকুক তা সহ্য করতে না পারা সহ বিভিন্ন পারিবারিক কারনে ফারুকুলের সাথে আসামী শিরিন আক্তারের মতবিরোধ দেখা দেয়। উক্ত বিরোধ নিস্পিত্তি কল্পে স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে একাধিক সালিশ বৈঠক হয়। পরবর্তীতে ফারুকুল আসামী শিরিন আক্তার ও তার কন্যা সন্তাকে নিয়ে বিরামপুর সুরভীপাড়া রহিম লন্ডনীর বাড়ীতে ভাড়াটিয়া হিসাবে বসবাস শুরু করে। ফারুকুল দীর্ঘ দিন তার মাকে ছেড়ে আলাদা ভাবে বসবাস করা মনে মনে মেনে নিতে পারেন নি। তাই ফারুকুল ২০১৭ সালের জুলাই মাসে তার ভাড়া বাসা ছেড়ে দিয়ে পুনরায় স্ত্রী সন্তান নিয়ে তার মাতা জয়না বেগমের সহিত নিজ বাড়ী নোয়াগাঁও সাকিনে বসবাসের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। উক্ত সিদ্ধান্ত স্ত্রী শিরিন আক্তার সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেননি। ফলে এ বিষয় নিয়ে পূনরায় তাদের মধ্যে ঝগড়া সৃষ্টি হয়। আসামী শিরিন আক্তার প্রথমে ফারুকুলকে বুঝানোর চেষ্টা করেন, এতে ভিকটিম রাজী না হলে তার মা মালেকা বেগম ও ভাই মোঃ ইউনুছ হোসেন সুজনকে দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক গত ২৪/০৭/২০১৮ তারিখে সকাল অনুমান ১০ ঘটিকার সময় আসামী মোঃ ইউনুস হোসেন সুজন, মালেকা বেগম নিহত ফরুকুলের ভাড়াটিয়া বাসায় আসে। বাসায় এসে আসামী মোঃ ইউনুস হোসেন সুজন, মালেকা বেগম ও শিরিন আক্তার বাসা ছেড়ে দেওয়া নিয়ে ভিকটিমকে পূনরায় জিজ্ঞাসাবাদ করিলে পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। এক পর্যায়ে ভিকটিম ভাড়া বাসা ছেড়ে দিয়ে পরিবার নিয়ে তার গ্রামের বাড়ীতে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকিলে আসামী মোঃ ইউনুছ হোসেন সুজন ভিকটিমের সামনে থেকে জোরে গলা চেপে ধরে দেওয়ালের পাশে থাকা সেলাই মেশিনের উপর আছাড় মারে ও ঝাপটে ধরে ফরুকুলের মুখ মন্ডলে ৩/৪ টি বক্সিং মারে। এতে ফরুকুল কিছু দূর সরে গিয়ে প্রতিহিত করার চেষ্টা করিলে ফরুকুলের স্ত্রী শিরিন আক্তারের হাতে থাকা স্ট্রীলের ট্রে দিয়ে তাকে ২/৩ টি বাড়ী মারে। এতে মুখমন্ডল ও মাথা রক্তাক্ত হলে মোঃ ইউনুস হোসেন সুজন প্রথমে সেলাই মেশিনটি উপরে তুলে ফরুকুলের মুখ মন্ডলের উপর ছুড়ে মারেও রান্নাঘরের খালি গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে আঘাত করে।
ক্রমাগত আঘাতের কারনে ফরুকুলের মাথা ও মুখমন্ডল থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরনের ফলে অল্প সময়ের মধ্যে নিঁস্তেজ হয়ে যায়। মৃত্যু নিঁিশ্চত করে শিরিন আক্তারের সহযোগিতায় ফরুকুকে মেঝেতে শুইয়ে তার উপর বিছানার আসবাব পত্র সোফার কুশন সহ অন্যান্য আসবাব পত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে। পুরো ঘটনার সময় আসামী শিরিনের মা মালেকা বেগম বাসার বাহিরে দাড়িয়ে কেউ আসে কি না তা পাহারা দেয়। মৃত্যু নিশ্চিত হলে শাশুড়ি মালেকা বেগম ফরুকুলের মেয়েকে কোলে নিয়ে ও মোঃ ইউনুস হোসেন সুজন কে বাসা থেকে নিরাপদে চলে যাওয়ার জন্য স্ত্রী শিরিন আক্তার গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে যায়।
মন্তব্য করুন