(ভিডিওসহ) বড়লেখায় চাঞ্চল্যকর স্কুলছাত্র আব্দুলাহ হাসান হত্যা কান্ডের রহস্য উদঘাটন : হত্যাকারী গাড়ী চালক আটক
এস এম উমেদ আলী॥ মৌলভীবাজারের বড়লেখায় চাঞ্চল্যকর ৮ম শ্রেণীর স্কুল ছাত্র আব্দুলাহ হাসান এর হত্যা কান্ডের রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
২৪ মে বৃহস্পতিবার বিকেল ৩ ঘটিকায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কার্যলয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ শাহাদাত হোসেন এক প্রেস ব্রিফিং করে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেন, হত্যাকান্ডের প্রায় তিন মাস আগে নিহত স্কুল ছাত্র আব্দুলাহ হাসানের বাবার ব্যক্তিগত গাড়ি চালক ছিল এরশাদ মিয়া। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় গাড়ী থেকে নেমে দোকান থেকে খাওয়ার কেক ক্রয়করে ফেরার সময় কিশোর হাসানের শরীরে গাড়ি লাগিয়ে দেয় এরশাদ। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে হাসান এরশাদকে চড় মারে ও গালিগালাজ করে। পরে হাসান গাড়ি চালকের নিকট কয়েকবার ক্ষমাও চেয়েছিলো। কিন্তু এরশাদ তাকে ক্ষমা করেননি। ঘটনার প্রায় তিন মাস পর জরুরী কথা আছে বলে হাসানকে নির্জন পাহাড়ী টিলায় নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে এরশাদ।
মামলার এজহার সূত্রেজানা গেছে, চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি রাতে আব্দুল্লাহ হাসান বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হয়। ১০ দিন পর ২৮ জানুয়ারি রাতে মোহাম্মদনগর এলাকার একটি নির্জন পাহাড়ী এলাকায় খন্ডিত পচা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। খবর পেয়ে বড়লেখা মোহাম্মদনগর গ্রামের সৌদি আরব প্রবাসী আব্দুর রহিম বাড়িতে আসেন। ৩০ জানুয়ারি নিহতের বাবা ৬ জনকে আসামি করে বড়লেখা থানায় হত্যা মামলা করেন।
হত্যাকান্ডটি চাঞ্চল্যকর ও রহস্যজনক হওয়ায় পিবিআই হেডকোয়াটার্স এর ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার নির্দেশে ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে মামলাটি পিবিআই মৌলভীবাজারের পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ শিবিরুল ইসলাম তদন্তভার গ্রহন করে। পিবিআইর তদন্তে এজহারভুক্ত ৬জন আসামীর থেকে গুরুত্ব পূর্ন তথ্য না পাওয়ায় গাড়ী চালক এরশাদ মিয়াকে আটক করে। সে ভোলা জেলার শশীভূষণ উপজেলার চরমায়া গ্রামের মোঃ কবির শিকদার এর পুত্র।
এ ব্যাপারে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ শিবিরুল ইসলাম স্কুল ছাত্র আব্দুল্লাহ হাসানের বাবার ব্যাক্তিগত গাড়ীচালক এরশাদ আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, আব্দুল্লাহ হাসান সিলেটের মোগলাবাজার থানাধীন মনির আহমদ একাডেমিতে ৮ম শ্রেনীতে পড়াশুনা করত।
হত্যাকারী মোঃ এরশাদ তাকে ঐ স্কুল থেকে আনা নেয়া করত। ২০১৭ সনের অক্টোবর মাসে বড়লেখা হতে ভিকটিম আব্দুল্লাহ হাসানকে মনির আহমদ একাডেমিতে নিয়ে যাওয়ার পথে গোলাপগঞ্জ থানাধীন চন্দরপুর পেট্রোল পাম্পের নিকট দোকান থেকে কেক ও ঠান্ডা কেনার জন্য গাড়ী থামায়। দোকান কেক আনার সময় কিশোর হাসানের শরীরে গাড়ি লাগিয়ে দেয় এরশাদ। এ সময় হাসান এরশাদকে চড় মারে ও গালিগালাজ করে। এতে এরশাদের মনে ক্ষোভ জন্মে। এ থেকেই সে ঘটনাটি ঘটিয়েছিল বলে স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছে। এরশাদ ঠান্ডা মাথায় পূর্বপরিকল্পনা মতে এ হত্যাকান্ড ঘটালেও থেকেছিল সন্দেহের উর্ধ্বে।
গত ১৯ মে শনিবার থাকে আটক করে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হয়। আদালতে ১০ দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করলে আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এরশাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করেলে ৩ দিনের মধ্যে লোমহর্ষক এ হত্যাকান্ডের স্বীকারোক্তি প্রদান করে।’ হত্যার কথা স্বীকার করে ২৩ মে বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বড়লেখায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে।
তার কয়েকটি কর্মকান্ডের উপর ভিত্তি করে আমরা তদন্ত করি। এর মধ্যে সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে আত্মগোপন করে। ঘটনার রাতে গাড়ি চালক এরশাদ সচরাচর যেখানে ঘুমায় সেখানে না ঘুমিয়ে অন্যস্থানে ঘুমিয়েছে। হত্যাকান্ড ঘটনার কয়েকদিন আগেই স্ত্রী-সন্তানদের অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়া। ঘটনার পর চাকুরী ছেড়ে দেয়া, মূখে দাড়ি রাখে। এসব সন্দেহজনক কারণে তাকে আটকের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
গাড়ি চালক এরশাদ কিভাবে হত্যার পরিকল্পনা করে :
চড়-থাপ্পর মারায় মোঃ এরশাদ প্রচন্ড রাগ হয় এবং আব্দুলাহ হাসানকে হত্যার প্রতিজ্ঞা করে। ডিসেম্বর-২০১৭ ইং মাসের শেষের দিকে পরীক্ষা শেষে গাড়ি চালক মোঃ এরশাদ ভিকটিম আব্দুল্লাহ হাসানকে বাড়ীতে নিয়ে আসে। সেই থেকে আসামী মোঃ এরশাদ ভিকটিম আব্দুল্লাহ হাসানকে টার্গেটে রাখে এবং তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করে সুযোগ খুঁজতে থাকে। ঘটনার কিছুদিন পূর্বে জানুয়ারী/১৮ ইং মাসে ৫/৭ তারিখে তার পিতা মাতার অসুস্থতার অযুহাতে আসামী মোঃ এরশাদ তার পরিবারকে ঢাকার মাতুয়াইলস্থ মির্দা বাড়িতে তার পিতা মাতার কাছে পাঠিয়ে দেয়। এরপর থেকে আসামী মোঃ এরশাদ বাদীর বাড়ির দোতলায় একটি রুমে থাকত এবং বাদীর বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করত। ঘটনার ২/৩ দিন আগে তার ব্যবহৃত খাসিয়া দা টি বালি দিয়ে ঘষে ধার দেয়। ঘটনার দিন ১৮/০১/২০১৮ ইং তারিখ সকাল অনুমান ৮ ঘটিকায় আসামী মোঃ এরশাদ আলী ভিকটিম আব্দুল্লাহ হাসানের বড় বোন সুমাইয়া ইসলাম হাসিকে নিয়ে প্রাইভেট পড়ার জন্য কোচিং সেন্টারে নিয়ে যায় এবং দূপুর অনুমান ১২.৩০ ঘটিকার দিকে বাসায় নিয়ে আসে। আছরের নামাজের সময় আসামী মোঃ এরশাদ স্থানীয় মোহাম্মদনগর বাজারে যায়। তখন আসামী মোঃ এরশাদ এর পরনে ছিল জ্যাকেট, গ্যাবাডিন প্যান্ট, এবং পায়ে সিঙ্গেল বেল্ট জুতা। বাজারে গিয়ে আসামী মোঃ এরশাদ ভিকটিম আব্দুল্লাহ হাসানকে অনুসরন করতে থাকে।
নিহত আব্দুল্লাহ হাসান তখন মোহাম্মদ নগর বাজারে ছিল। সন্ধ্যার পর হত্যাকারী মোঃ এরশাদ ভিকটিম আব্দুল্লাহ হাসানদের বাসার নিচতলায় তার শোয়ার কক্ষ থেকে পরনের জ্যাকেটের ভিতর কোমরে গুজে খাসিয়া দা’ টি নিয়ে মান্নার দোকানে বসে থাকে। পরবর্তীতে সে আব্দুল্লাহ হাসানের পিছু নেয়। ভিকটিম আব্দুল্লাহ হাসানের পরনে ছিল কাপড়ের জুতা, খয়েরী রংয়ের জ্যাকেট আর আর্মি কোয়ালিটির টাইট প্যান্ট। রাত অনুমান সাড়ে ৯০ ঘটিকায় কারেন্ট (বিদ্যুৎ) চলে গেলে আব্দুল্লাহ হাসানের বন্ধু জাবের, তারেক, জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে ভিকটিম বিদায় নেয়। আব্দুল্লাহ হাসান বাড়ীতে যাওয়ার সময় আসামী মোঃ এরশাদ মান্নার দোকনে বসা ছিল। অতঃপর আসামী মোঃ এরশাদ মান্নার দোকান হতে বের হয়ে মোহাম্মদ নগর বাজারের ত্রি-মূখী রাস্তায় এসে দাড়ায়। ভিকটিম আব্দুল্লাহ হাসান বাড়ীর দিকে যেতে থাকলে আসামী মোঃ এরশাদ আব্দুল্লাহ হাসানকে বলে, ভাতিজা তোমার সাথে আমার জরুরী কিছু কথা আছে। চলো, আমরা একটু সামনে যাই। তখন ভিকটিম আব্দল্লাহ হাসান আসামী মোঃ এরশাদ এর সাথে যায়। কথা বলতে বলতে আসামী মোঃ এরশাদ এর ব্যবহৃত স্যামসাং জে’থ্রী মডেলের মোবাইলের আলোতে তারা দুইজন আরব আলীর টিলায় উঠে বসে। তখন আসামী মোঃ এরশাদ ভিকটিম আব্দল্লাহ হাসানকে জিজ্ঞেস করে তুমি কবে সিলেটে যাইবা? তখন সে বলে ২০/০১/২০১৮ ইং তারিখ শনিবার যাব। আসামী মোঃ এরশাদ বলে যে, ভাতিজা তোমার কি মনে আছে সিলেটে যাওয়ার সময় তুমি আমাকে চড় থাপ্পড় মেরেছিলে? ভিকটিম আব্দল্লাহ হাসান বলে, চাচা তখন আমার মাথা ঠিক ছিল না। আসামী মোঃ এরশাদ তখন রাগান্বিত হয়ে বলে যে, আমি তোমাদের ড্রাইভার বলে কি পচে গেছি ? ভিকটিম আব্দল্লাহ হাসান ভয় পেয়ে টিলা হতে চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাড়ালে আসামী মোঃ এরশাদ তাকে পিছন দিক থেকে থাবা মেরে ধরে তাকে চড় থাপ্পড় মারতে থাকে। ভিকটিম আসামী মোঃ এরশাদের সাথে ধস্তাধস্তি করতে থাকলে আসামী মোঃ এরশাদ তার নিজের কাছে থাকা দা বের করে তার হাতে, মাথায় ও ঘাড়ের দুই পাশে এলোপাথাড়ী ৪/৫ টি কোপ মারে। কোপের তোড়ে সে টিলার ঢালুতে জাপানি লতায় পেছিয়ে নিছে পড়ে গুঙ্গাইতে থাকে। তার গুঙ্গানুর শব্দ বন্ধ হলে আসামী মোঃ এরশাদ সেখান থেকে চলে এসে পুনরায় মান্নার দোকানে বসে। কিছুক্ষন পর বাসায় আসার পথে ভাড়াটিয়া করিমের সাথে আসামী মোঃ এরশাদের দেখা হয়। এবং উভয়ে একসাথে বাড়িতে আসে।বাড়িতে এসে দরজায় নক করলে করিমের স্ত্রী বাড়ির দরজা খুলে দেয়।
আসামী মোঃ এরশাদ তখন পরনের জ্যাকেট ও ফুল প্যান্ট খুলে লুঙ্গি সুইটার পড়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। উক্ত দিন আসামী মোঃ এরশাদ রাতে খাবার খেতে ভিকটিম আব্দল্লাহ হাসানদের বাসায় ২য় তলায় যায় নাই। রাত অনুমান ১০.৩০ ঘটিকার সময় ভিকটিম আব্দল্লাহ হাসানের মা তাকে মোবাইলে ফোন দিলে সে ঘুমে থাকায় ফোন রিসিভ করে নাই। পরে রাত ১১.০০ ঘটিকার সময় ভিকটিম আব্দল্লাহ হাসানের বড় বোন হাসি এসে তাকে ডেকে তুলে বলে যে আব্দুল্লাহ হাসান এখনও বাসায় ফিরে নাই। তখন আসামী মোঃ এরশাদ শোয়ার কক্ষ হতে বের হয়ে জহির উদ্দিন ও তার ছেলে রানা এবং ভিকটিমের চাচাতো ভাই জাহাঙ্গীরদেরকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় খুঁজাখুজি করে।
গত ২৭/০৪/২০১৮ খ্রিঃ তারিখ সে চাকুরী ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় চলে যায়। অতঃপর সে দাড়ি রেখে নিজের চেহারার পরিবর্তন করে। ঘটনায় ব্যবহৃত গ্রেফতারকৃত আসামী মোঃ এরশাদ এর মোবাইল ফোন ও পরনের জ্যাকেট জব্দ করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন