ভূজবল জামে মসজিদের খতিব মাওলানা এনামুল হক নোমান-এর বিদায়ে দৃষ্টান্ত করলেন মুসল্লিরা
রাজনগর প্রতিনিধি॥ মসজিদের ইমাম নিয়োগ, মসজিদ কমিটি বা নেতৃত্ব নিয়ে চারিদিকে যখন বিরোধ এবং হানাহানির খবর, তখন ইমামকে নিয়ে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন রাজনগর উপজেলার দক্ষিণ ভূজবল (বছিরমহল) গ্রামের মুসল্লিরা। মসজিদ কমিটি, এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, আলেম-উলামাসহ সর্বস্তরের মুসল্লিদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বিরল সম্মানের সাথে বিদায় নিলেন ক্বারী মাওলানা এনামুল হক নোমান। মসজদি কমিটি এবং গ্রামের মানুষেরা ইমামকে বিদায় দিতে না চাইলেও ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণে তিনি বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু বিদায় বেদনার হলেও এলাকাবাসী তা বহু কষ্টে মেনে নেন এবং তাঁর সম্মানে গত শুক্রবার বাদ জুমআ দক্ষিণ ভূজবল জামে মসজিদে আয়োজন করেন এক ‘বিদায়ী সংবর্ধনার’। বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রায় এক যুগের ইমাম ও খতিব মাওলানা এনামুল হক নোমান-কে অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায়ী ক্রেস্ট দেওয়া হয়।
এ সময় মসজিদ কমিটির দায়িত্বশীলসহ, এলাকার বিশিষ্ট মুরব্বি এবং প্রবীণ আলেমরা বক্তব্যে ইমামের নানা স্মৃতিচারণ করে কাঁদলেন। বিদায়ী অনুষ্ঠানে মুসল্লিদের উপস্থিতিতে মসজিদ ছিল ভরপুর। কিশোর, আলেম, ছাত্র-শিক্ষকসহ গ্রামের সর্বস্তরের মানুষ উপস্থিত ছিলেন। বিদায় বেলায় গ্রামের মানুষ ভালোবেসে ইমামের হাতে নগদ অর্থ উপহারসহ বিভিন্ন ব্যক্তি এবং সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে উনাকে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন। এছাড়াও অনেক মুসল্লিরা নানা উপহার সামগ্রী ইমামের হাতে তুলে দেন। এসময় প্রিয় ইমামকে জড়িয়ে গ্রামবাসিরা দোয়া চাইলেন, কাঁদলেন এবং বিদায়ী ইমামও কাঁদলেন। মসজিদ কমিটির দায়িত্বশীলরা বলেন- ইমাম মাওলানা নোমান একজন সাদা মনের মানুষ। একই কর্মস্থলে এত বছর তিনি ইমামতি করছেন অথচ কারো সঙ্গে তার মনোমালিন্য হয়নি। এজন্য চাকরি বদল করারও দরকার হয়নি। তিনি স্বেচ্ছায় ইমামতি ও খতিবের প ছাড়তে চাইলেও গ্রামবাসী তাকে এতদিন ছাড়েননি। ইমাম সাব আমাদের সবার সঙ্গে মিশে ছিলেন। গ্রামবাসী তার পরামর্শ নিয়ে কাজকর্ম করতেন। তিনি ছিলেন আমাদের অভিভাবকের মতো। তাই তাকে বিদায় বেলায় এভাবে সম্মানিত করার চেষ্টা করেছি। এলাকাবাসী সুত্রে জানা যায়-ক্বারী মাওলানা এনামুল হক নোমান ২০০৪ সাল থেকে এই গ্রামের মসজিদে ইমামতি ও খতিবের দায়িত্ব পালন শুরু করেন। পাশাপাশি এলাকার একটি মাদরাসায় শিক্ষকতার পেশায় যোগ দেন। তিনি যখন মসজিদে দায়িত্ব নেন তখন মসজিদটি অনুন্নত ছিল। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে মসজিদটির ব্যাপক উন্নতি ঘটতে থাকে। প্রতি জুমআবার বয়ানের মাধ্যমে তিনি ইসলামের বিভিন্ন বিষয় এবং সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে ওয়াজ করে মুসল্লিদের বুঝাতেন। তিনি হকের পক্ষে বলিষ্ট ছিলেন। কুফর, শিরকসহ নানা অসামাজিক কার্যকলাপ প্রতিরোধে তাঁর সাহসি ও দরদী প্রচেষ্টা ছিল বেশ প্রশংসনীয়। এলাকার যুবকদের একত্রিত করে তিনি গঠন করেছিলেন সামাজিক ও সেবামূলক সংগঠন দক্ষিণ ভূজবল যুব কল্যাণ ফাউন্ডেশন। রাজনগরের প্রাচীনতম মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক হওয়ার সুবাদে এলাকার বহু ছাত্র-ছাত্রীকে তাঁর কাছে পড়ালেখা করে আজ দেশের বিভিন্ন মাদরাসা, মসজিদ, স্কুলসহ নানা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। একটি মসজিদের ইমাম হয়েও তিনি বহু গরিব ছাত্র ছাত্রীসহ বিভিন্ন মানুষের পাশে সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছেন। তাঁর বিনয়সহ এসব নানা উদ্যোগ এলাকার মানুষের মন জয় করে নেন। এই দেড় যুগের মধ্যে তিনি গ্রামবাসীদের আত্মার সঙ্গে মিশে গেছেন। বিদায়ী ইমাম মাওলানা এনামুল হক নোমান বলেন-দীর্ঘদিন রাজনগর উপজেলার বছিরমহল মাদরাসায় শিক্ষকতার পাশাপাশি দক্ষিণ ভূজবল জামে মসজিদে ইমাম ও খতিবের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলাম। দিনে দিনে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যাগুলো বাড়ছে। অনেকবার বিদায় চেয়েছি, কেউ বিদায় দিতে সম্মত হননি। তাই গত ৩ জুন শুক্রবার এলাকার সর্বস্থরের মানুষের অনুরোধ রক্ষা না করেই বিদায় নেই। তবে রাজনগরের জামিউল উলূম বছিরমহল মাদরাসায় দারস তাদরিসে আছি, থাকবো। এলাকাবাসী বিদায়-মুহূর্তে আমার প্রতি যে সম্মান, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে বহুকাল লিপিবদ্ধ থাকবে, ইনশাআল্লাহ। আমার জানামতে মৌলভীবাজার জেলায় এটাই প্রথম ইতিহা যে, একজন মসজিদের ইমামকে বিদায়কালে বড় এমাউন্টের অর্থ প্রদানসহ বিভিন্ন উপঢৌকন দিয়ে এতো সম্মান মর্যাদার বহিঃপ্রকাশ ঘিিটয়েছেন। আমি মনে করি এ সম্মান শুধু আমাকে দেওয়া হয়নি, বরং গোটা ইমাম সমাজকে দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত অর্থেই দক্ষিণ ভূজবলের মানুষ আলেমপ্রিয় ও দ্বীন-দরদী। এলাকার মুরব্বিয়ান, যুবসমাজে ও মা-বোনসহ সর্বস্তরের মানুষের আন্তরিক ভালোবাসার স্মৃতি আজীন আমার স্মরণ থাকবে। আশা করি দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় চলার পথের ভুলত্রুটিগুলো সবাই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। মাওলানা এনামুল হক নোমান সিলেটের জামিয়া ক্বাসিমুল হজরত শাহজালাল রহ. দরগাহ মাদরাসা থেকে ২০০৪ সালে তাকমিল ফিল হাদিস (মাস্টার্স) কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। তাঁর বাড়ি শ্রীমঙ্গল পৌর শহরতলীর মুসলিমবাগ (সুনগইড়) আবাসিক এলাকায়। তিনি বেফাকের কেন্দ্রীয় পরীক্ষার পরীক্ষক, আঞ্জুমানে তালিমুল কুরআন বাংলাদেশ এর কেন্দ্রীয় পরীক্ষকের দায়িত্ব পালনসহ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গণশিক্ষা প্রকল্পের প্রাক প্রাথমিকের শিক্ষকও ছিলেন। তিনি এক পুত্র ও এক কন্যার জনক।
ইমামের বিদায়ের খবর শুনে ফেসবুকে মাওলানা লুৎফুর রহমান জাকারিয়া লিখেন-গ্রামবাসির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায়ী সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ‘স্মরণকালের বিরল দৃষ্টান্ত, আমরা গর্বিত’। বিরল সম্মানের সাথে উনার এই বিদায় বহুকাল ধরে স্মরণীয় হয়ে থাকবে ইনশাআল্লাহ। মাওলানা খালেদ বিন শাওক্বী লিখেন-আপনার প্রতি এলাকাবাসীর অগাধ নজীরবিহীন ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হলাম। আল্লাহ তাআ’লা আপনার সম্মান আরও বৃদ্ধি করুন। সিলেটের রেঙ্গা মাদরাসার মুহাদ্দিস ও লেখক মাওলানা আহমদ কবির খলীল লিখেন- এনাম ভাই সত্যিই জনপ্রিয় হওয়ার মতো ব্যক্তি। অত্যন্ত বিনয়ী ও আন্তরিক এই আলেমে দীনের মর্যাদা এবং হায়াতে আল্লাহ তালা বারাকাত দান করুন। মৌলভীবাজারের নুরুল কুরআন মাদরাসার ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা জিয়া উদ্দিন ইউসুফ মন্তব্য করেন-আপনার প্রতি এলাকার মানুষের অগাধ ভালোবাসা সত্যি ঈর্ষণীয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আপনার সম্মান আরও বৃদ্ধি করুন। বরুণা মাদরাসার উস্তাদুল হাদিস মাওলানা হিলাল আহমদ মন্তব্যে লিখেন-এই রকম সম্মানিত ব্যক্তিকে আল্লাহ আজীবন সুস্থতার সাথে নেক হায়াত দান করুন। শ্রীমঙ্গল দেওয়ানী জামে মসজিদেও ইমাম ও খতিব লিখেন-আমি উনার ছাত্র জমানার লেখাপড়ার সাথী হিসেবে উনাকে অত্যন্ত নম্রভদ্র ও মেধাবী হেিসবে দেখেছি। ইকরামুল মুসলিমীন মৌলভীবাজার এর সভাপতি মাওলানা এহসান জাকারিয়া মন্তব্যে লিখেন-এনাম ভাই অসাধারণ এক ভালো মানুষ। বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশনের মৌলভীবাজার জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান লিখেন-এখন তো অনেক এলাকায় মসজিদের ইমাম নিয়োগ নিয়েও এখন মানুষ বিরোধে জড়াচ্ছেন। সেখানে একজন ইমামকে এভাবে বিদায় দেয়া একটি ঐতিহাসিক বিদায় বলে মনে করি। সারা দেশের মধ্যে এটা অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট আহমদ রিগেন লিখেন-বিরল সম্মানে ভূষিত হয়েছেন শ্রদ্ধেয় এনাম ভাই। আলেম-উলামারা এখনো সর্বস্তরের মানুষের কাছে কতটা সম্মানীয় আজকের বিদায়ী সংবর্ধনার মাধ্যমে তা আবারো দেখতে পেলাম। এলাকাবাসীকে আন্তরিক মোবারকবাদ। কবি হাসান মাহমুদ লিখেন-এনাম ভাইয়ের বিনয় অতুলনীয়। আল্লাহ তায়ালা প্রিয় ভাইকে আফিয়াতের সাথে নেক হায়াত দান করুন। লেখক মাওলানা মুস্তাকিম মুনতাজ তালুকদার লিখেন- এনাম ভাইয়ের তুলনা হয় না। তিনি অতুলনীয়। আল্লাহ নেক হায়াত দান করুন। মাওলানা হোসাইন আহমদ লিখেছেন-আমাদের মসজিদ থেকে বিদায় নিলেন আমার প্রাণপ্রিয়য় উস্তাদে মুহতারাম মাওলানা এনামুল হক নোমান হাফি.। হুজুর প্রায় দেড় যুগ কাটিয়েছেন আমাদের মহল্লায়। আমার জীবনের পড়ালেখার ইবতেদা হয়েছিল হযরতের নিকটেই। কি বলবো আর কি লিখবো ভাষা হারিয়ে ফেলেছি হযরতের আকস্মিক বিদায়ী খবর শুনে। খুবই কষ্ট হচ্ছে যা বলা বাহুল্য। আল্লাহ পাক হুজুরের ইলমে-আমলে আরো বারাকাহ দান করুন। মুফতি রুহুল আলম মন্তব্যে লিখেন-গুনীর কদর গুনীজনরা করতে জানে।শেখ ফুয়াদ আলম লিখেন-আহ! প্রিয় উস্তাদে মুহতারাম এনামুল হক নোমান শ্রীমঙ্গলী হুজুর চলে যাওয়ার কথা শুনে খুব কষ্ট লাগলো। আসলে হুজুর সম্পর্কে লিখে শেষ করার মতো নয় এলাকার প্রত্যেকটা মানুষ হুজুরের মাধ্যমে কোন না কোনভাবে ইলম আমল পরামর্শে উপকৃত হয়েছেন। এমন বিদায় মেনে নেওয়ার মত নয়। এমন ইমামের বিদায়ে এলাকাবাসী হারালো এক অমুল্য সম্পদ। ইমাম সাহেব অনেক মিলবে কিন্তু এমন ইমাম মিলানো অনেক কষ্টের ব্যাপার। আহমদ সালমান লিখেছেন-প্রাণপ্রিয় উস্তাদ, এভাবে আপনি হঠাৎ করে চলে যাবেন এটা কখনো ভাবি নাই, আপনি আসলেই অনেক ভালো মনের মানুষ। আমার মতো অনেক ছেলের আদর্শ। আমার নানাবাড়ি এলাকার মানুষের ভাগ্য যে আপনার মতো একজন হুজুর পেয়েছিলেন। আমি যতটুকু জানি আপনার বেতনও অনেক অল্প ছিল, তাও আপনি এলাকার মায়ায় এলাকার স্বার্থে নিজের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে অনেক বছর এই মসজিদের খেদমত করেছেন। এলাকার অনেক ছেলেকে আপনি সঠিক রাস্তা দেখেয়েছেন অনেক বেনামাজিকে নামাজি বানিয়েছেন। আল্লাহ যেন আপনার এই খেদমতকে কবুল করেন। আর হুজুর অনেক বছর আমিও নানার বাড়িতে ছিলাম, আপনার সাথে খাওয়া-দাওয়া, ওঠাবসা চলাফেরা অনেক কিছুই করছি, মাঝেমধ্যে বিয়াদবীও করছি, দয়া করে আপনার সন্তান ভেবে মাফ করে দিয়েন। মীর নগর একটি মসজিদ ও নুরানীর মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা আকমল হোসেন বলেন-বিদায়ী ইমাম তারও ওস্তাদ। তার মতো বহু ছেলে মেয়ে ইমাম সাহেবের কাছে পড়েছেন।
মন্তব্য করুন