শ্রীমঙ্গলে সনদ জালিয়াতি করে ১৮ বছর ধরে নিকাহ রেজিস্ট্রারর দায়িত্ব পালনের অভিযোগ কাজী সাইফুর রহমানের বিরুদ্ধে
এহসান বিন মুজাহির : শ্রীমঙ্গলে সরকার কর্তৃক নিয়োগ পেয়ে জাল সনদে ১৮ বছর ধরে নিকাহ্ ও তালাক রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে শ্রীমঙ্গল পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের নিকাহ্ ও তালাক রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ সাইফুর রহমানের বিরুদ্ধে।
মৌলভীবাজার জেলা রেজিস্ট্রার অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ সালের ৩০ মার্চ আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিচার শাখা-৭ থেকে মোহাম্মদ সাইফুর রহমানকে শ্রীমঙ্গল পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের বিবাহ নিবন্ধন ও তালাক রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। যার স্মারক নং বিচার-৭/২, এন-১/২০০২ (অংশ) ২১৪।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, শ্রীমঙ্গল পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের কাজী সাইফুর রহমান ২০০২ সালে শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালাপুর ইউনিয়নের সিরাজনগর গাউছিয়া জালালিয়া আলিম মাদরাসা থেকে বাংলাদেশ মাদরাসার শিক্ষা বোর্ডের অধীনে আলিম পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অনুত্তীর্ণ হন।
কাজী সাইফুরের আলিম পরীক্ষার রোল নং-১৬১৭৪৭, রেজিস্ট্রেশন নং-৭৪১৯১২। মাদরাসায় সংরক্ষিত বোর্ডের টেবুলেশন শিট ও অন্যান্য কাগজপত্রাদি পর্যালোচনা দেখা যায়, ২০০২ সালের আলীম পরীক্ষায় তিনি অকৃতকার্য হওয়ার পর ২০০৩ ও ২০০৪ সালে তিনি পরীক্ষায় আর অংশগ্রহণ করেননি।
সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের ৮নং ধারা অনুযায়ী নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্স পাইবার যোগ্য হইবেন না যদি না তিনি সরকার কর্তৃক স্বীকৃত কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা মাদরাসা বোর্ড কর্তৃক নিবন্ধিত কোন মাদরাসা হইতে আলিম সার্টিফিকেটধারী না হন।
একই প্রজ্ঞাপনের ১১ নম্বর ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে (১) এই বিধিমালার অধীন প্রদানকৃত লাইসেন্স অসদাচরণের জন্য অথবা আইনের ধারা ১১ তে বর্ণিত যে কোন কারনে বাতিল বা স্থগিত করা যাইবে। ব্যাখ্যা ‘অসদাচরণ’ বলিতে আইন বা বিধিমালার যে কোন বিধান লংঘন, একাধিক এলাকার নিকাহ রেজিস্ট্রার হওয়া বা যে কোন ধরণের তথ্যের মিথ্যা বর্ণনা নৈতিক ঙ্খলনকে বুঝাইবে।
এদিকে এ বিষয়টি দীর্ঘদিন থেকে কাজী সমিতিসহ স্থানীয় অনেকে জানলেও নানা কারণে মুখ খুলেননি কেউই। স্থানীয়রা ক্ষোভ নিয়ে বলেন, জাল সনদে কিভাবে সরকার কর্তৃক নিয়োগ পেয়ে এতো বছর ধরে কাজীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে অন্ততপক্ষে ওই কাজী ৪০ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এ বিষয়টি তদন্ত করে জাল সনদের অপরাধে কাজীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান তারা।
ব্যাপারে সিরাজনগর গাউছিয়া জালালিয়া আলিম মাদরাসার অফিস সহকারী লুৎফুর রহমান বলেন, সাইফুর রহমান সিরাজনগর মাদরাসা থেকে ২০০০ সালে দাখিল পাশ করেছেন এবং ২০০২ সালে আলিম পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। আমি ২০০২ সালের পরীক্ষায় টেবুুলেশন সিট দেখে এ তথ্য নিশ্চিত করলাম। এরপর ২০০৩ বা ২০০৪ সালে আর পরীক্ষা দেননি।
সিরাজনগর মাদরাসার অধ্যক্ষ মুফতি শেখ শিব্বির আহমদ বলেন, সাইফুর রহমান দাখিলে পাশ করলেও আলিম পরীক্ষায় ফেইল করেছেন। পরীক্ষার টেবুলেশন সিটে যে তথ্য রয়েছে সেটিই সঠিক। তিনি যদি আলিমের পাশ সনদ দেখিয়ে কোনো চাকরি করেন সেটা জাল সনদে হবে, আর সেটা প্রতারণা। এর দায়ভার তিনি নিজে নেবেন।
অভিযুক্ত কাজী মোহাম্মদ সাইফুর রহমান মুঠোফোনে বলেন, “আমি ২০০০ সালে সিরাজনগর মাদরাসা থেকে দাখিল এবং ২০০২ সালে আলিম পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছি”। আপনার পরীক্ষার টেবুলেশন সিট ও পরীক্ষার ফলাফলে আপনি ফেল করেছেন বলে প্রমাণিত এ প্রশ্নের জবাবে “তিনি প্রথমে কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে বলেন, আমি বিকেলে আপনার সাথে সরাসরি দেখা করবো”। দেখা করার দরকার নেই আপনি প্রশ্নের উত্তর দেন বললে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
জাল সনদে কাজীর দায়িত্ব পালন বিষয়ে জানতে চাইলে কাজী সমিতির শ্রীমঙ্গল উপজেলা সেক্রেটারি কাজী মাওলানা শিহাব উদ্দিন বলেন, ‘আমি ২০০৩ সালে কাজী হিসেবে নিয়োগ পাই। তখন সমিতির কোনো পদে ছিলাম না। তবে আমি যতটুকু জানি এ বিষয়ে ২০০৬/২০০৭ সালে মৌলভীবাজার জেলা কাজী সমিতির পক্ষ থেকে আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবরে একটি লিখিত অভিযোগ প্রেরণ করা হয়েছিল।
কাজী সমিতির উপজেলা সভাপতি কাজী মাওলানা নাসির উদ্দিন বলেন, ‘জাল সার্টিফিকেট দিয়ে কাজী সাইফুুর রহমান নিয়োগ পেয়েছেন এটা আমি কল্পনাও করিনি। এখন সমিতি কর্তৃক কোনো পদক্ষেপ নেবেন কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি সাইফুর রহমানের সাথে আগে আলাপ করে দেখি, এরপর পদক্ষেপের বিষয়।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রীমঙ্গল উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার শংকর শংকর কুমার ধর বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। তাই এ বিষয়ে আমি কিছুই বলবো না। এসব ডিআর অফিস জানে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) বলেন, ‘আপনার মাধ্যমে বিষয়টি এখন জানলাম। এটি নিয়ে নিউজ হলে তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠাবো।’
মৌলভীবাজার জেলা রেজিস্ট্রার এসএম সোহেল রানা মিলন বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে সনদ জালিয়াতি করে কোনো কাজী নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্স নিয়ে থাকলে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানানো হবে।
মন্তব্য করুন