মধ্য ভারতে মুসলিম শাসনঃ দিল্লি সালতানাত : সাম্প্রদায়ীক সম্প্রিতি সমাজ সভ্যতা ও সংস্কৃতি

June 4, 2017,

মুজিবুর রহমান মুজিব এডভোকেট॥ প্রাচীন ভারত বর্ষকে বিশ^বিখ্যাত ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ভিনসেন্ট স্মীথ (Vincent Smith) যথার্থভাবেই পৃথিবীর নৃ-তাত্বিক যাদুশালা বলে মূল্যবান অভিমত দিয়ে ছিলেন। বিশাল ভারতের ভূ-বৈচিত্র, মাটির উপরে-নিচে বিপুল পরিমান ধন সম্পদ, অপরূপ প্রাকৃতিক নিসর্গ এবং ভারত বাসির মায়ায় বিমুগ্ধ হয়ে এদেশে যুগে যুগে এসেছেন আরব-অনারব-পীর আউলিয়া-সাধু সন্যাসী-আর্য্য-অনার্য্য-মুঘল-পাঠান-জাতি-উপজাতি। এসেছেন ইংরেজ ফরাসী, ওলন্দাজ বনিকের দল। এদের আগমনে প্রাচীন ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে। এরা রাজ্য শাসন-সমাজ বিকশিত ও সমাজ উন্নয়ন করেছেন। দিল্লিকে কেন্দ্র করেই ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে। দিল্লি ছিল ভারতের প্রান-ভারতের রাজধানী। ভারতের দিল- দিল্লি পৃথিবীর মধ্যেই একটি অন্যতম প্রাচীন নগরী। তুঘলক ও মুঘল আমলে সাময়িকভাবে ভারতীয় রাজধানী পরিবর্তন হলেও দিল্লির ইমেজ, মর্য্যাদা ও ভাবমূর্তি, প্রাচীন ঐতিহ্য কোন কালেই ম্লান হয়নি।
ভারতীয় শাসক সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজপুত একটি শক্তিশালী এবং অভিজাত জাতি। প্রায় সাড়ে পাঁচ শত বৎসর রাজপুত রাজাগন চুটিয়ে উত্তর ভারত শাসন করেছেন। দিল্লির সর্বশেষ রাজপুত রাজা পৃথ্বিরাজ চৌহানকে গজনির সুলতান সাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘোরি ১১৯২ সালে তরাইনের ২য় যুদ্ধে হারিয়ে মহান আল্লাহর অপার মেহেরবানী এবং পীর আওলিয়ার দোয়ায় দিল্লিতে প্রথমবারের মত মুসলমানদের বিজয় নিশান উড়ান। রাজপুত রাজত্যের অবসানের সাথে সাথে দিল্লিতে শুরু হয় মুসলিম শাসন। শুভ সূচনা হয় ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির। ঘোরির এক লক্ষ বিশ হাজার সেনাবাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন তার একান্ত অনুগত ও বিশ^স্থ সেনাপতি তুর্কি বীর কুতুব উদ্দিন আইবেক। আইবেক ছিলেন ক্রীতদাস এবং মামলুক। তাঁরা দাস বংশোদ্ভূত পেশাদার সৈনিক। মামলুকগন ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত হয়ে নবম শতাব্দীতে একটি সামরিক শক্তি হিসাবে আত্ব প্রকাশ করেন। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে মহাশক্তিশালী দিল্লির শাসক পৃথ্বিরাজ চৌহানের তিন লক্ষ সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে আইবেকের অসীম সাহস, রনকৌশল ও রননৈপুন্য কাজে লেগেছিল। ১২০৬ সালে অপুত্রক মোহাম্মদ ঘোরির মৃত্যু হলে তাঁর বিশাল স¤্রাজ্য বিভক্ত হয়ে যায়। কুতুব উদ্দিন আইবেক দিল্লির সুলতান হিসাবে শাসন ভার গ্রহন করেন। নিঃ সন্তান ঘোরির কোন পুত্র সন্তান এবং ঘোষিত উত্তর সূরী না থাকায় দিল্লির শাসন ক্ষমতায় উপসেনাপতি কুতুব উদ্দিন আইবেকের একচ্ছ-ত্র উত্থান ঘটে। শাসন ক্ষমতায় অধিষ্টিত হয়ে আইবেক কঠোর হস্তে যাবতীয় বিদ্রোহ দমন করতঃ দিল্লিতে দাস বংশের শাসন পাকা পোক্ত করেন। আইবেক মুলতানের শাসক নাসিরউদ্দিন কাবাছা এবং গজনীর সুলতান তাজউদ্দিন ইয়ালদুজের বিদ্রোহ দমন করেন। বিচক্ষন কুতুব উদ্দিন আইবেক তার ক্ষমতা সু-সংহত ও উত্তর ভারতে নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্টার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহন করেন। দিল্লিতে তার প্রশাসনিক ক্ষমতা অক্ষুন্ন ও বহাল রেখে আইবেক লাহোরে রাজধানী স্থানান্তর করেন। তার শাসনামলে বিশ^স্থ সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন বিন বখতিয়ার খিলজি দ্বাদশ শতাব্দীতে বাংলা বিজয় করেন। আইবেক যেমনি ছিলেন বীর যোদ্ধা তেমনি ছিলেন একজন আদর্শ শাসক। আইবেক দিল্লিতে কুয়াতুল ইসলাম মসজিদ এবং কুতুব মিনার নির্ম্মান করেন। দিল্লির অনতি দূরে দ্বাদশ শতাব্দীর অনুপম মুসলিম স্থাপত্য কুতুব মিনার এখনও কালের স্বাক্ষী হয়ে মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে। সুউচ্চ কুতুব মিনার লালটালির অপূর্ব স্থাপনা- একটি পর্য্যবেক্ষন টাওয়ার বলা যেতে পারে। কারন সেকালে উন্নত যোগাযোগ এবং তথ্য প্রযুক্তি ছিলনা। সু-উচ্চ কুতুব মিনারের চুড়ায় উঠে দূরবর্তী স্থানে শত্রুর আনা গুনা পর্য্যবেক্ষন করা যেত। দিল্লি বিজয়ী বীর মোঃ ঘোরির সহ যোদ্ধা আইবেক রাজ্য শাসনে ঘোরির নীতি অনুসরন করতেন। রাজপুত রাজাগনকে যুদ্ধে পরাজিত করে দেশ দখল করলেও রাজ্য শাসনে তাঁরা ছিলেন উদার, সহনশীল ও অসাম্প্রদায়ীক। রাজপুত ও হিন্দু প্রজা সাধারনকে তারা সকল নাগরিক সুযোগ সুবিধা দিয়েছেনে। হিন্দু ধর্মাবলম্বি ও ভারতীয় দেব দেবীকে ধ্বংস কিংবা অসম্মান করা হ্য়নি। বরং মোঃ ঘোরি তার মুদ্রায় দেবী লক্ষীর প্রতিকৃতি অব্যাহত রেখেছিলেন। আইবেক পারজিত রাজপুত রাজাগনকে আজমীর ও গোয়ালিওর শাসনের সুযোগ দিয়ে উদার মনেরই পরিচয় দিয়েছিলেন। দিল্লির মুসলিম শাসনের সূচনাকারীদের উদারও সহনশীল মনোভাবের প্রকৃষ্ট উদাহরন হিমু দ্য হিন্দু হিরো অব মেডিয়াভ্যাল ইন্ডিয়া, দ্য হিন্দুজ ভিজ অ্যা ভিজ দ্য আফগান এন্ড দি মোগল গ্রন্থের ৮৯ পৃষ্টায় এইভাবে

ÒMost of the Turks who had established the Sultanate of  Delhi were, hodoubt neophytes but they were singularly free from all religious biogotry or fanaticsm for example Shabuddin Ghore confirmed the figures of the goddes laksmi on his coins. Qutub Uddin Aibek allowed the Rajput Princes to rule over delhi and ajmir and gwalior ever after the conquest of those regions”

দিল্লীতে দাসরাজ বংশের প্রতিষ্টাতা কুতুব উদ্দিন আইবেক ১২১০ সালে লাহোরে পলো খেলার সময় ঘোরার পিঠ থেকেই পড়ে মৃত্যু বরন করেন। সেখানেই তিনি সমাহিত। রাজপুত উত্তর দিল্লী ধারাবাহিক ভাবে ১. দাসবংশ, ২. খিলজি বংশ, ৩. তুঘলক বংশ, ৪. সৈয়দ বংশ, এবং ৫. লোদীরাজ বংশ,- এই পাঁচ রাজ বংশ সগৌরবে তিনশ বিশ বৎসর দিল্লী শাসন করেন। এই পাঁচ বংশের শাসন ভারতের ইতিহাসে দিল্লী সালতানাত নামে খ্যাত। আইবেক প্রতিষ্টিত দাস বংশের শাসকদের মধ্যে সুলতানা রাজিয়া, সামসুদ্দিন ইলতুত মিশ, মইজ উদ্দিন বাহরাম শাহ্, নাসিরউদ্দিন মাহমুদ, গিয়াস উদ্দিন বলবনের নাম সবিশেষ উল্লেখ যোগ্য। দিল্লী ও ভারত শাসনের ইতিহাসে সেই মধ্যযুগের একমাত্র মহিলা মুসলিশ শাসক এর নাম জালালাত উদ্দিন রাজিয়া। গোড়া মুসলিমদের বিরোধিতা উপেক্ষা করে সুলতানা রাজিয়া ১২৩৬ থেকে ৪০ সাল পর্য্যন্ত সগৌরবে দিল্লী শাসন করেন। সেই যুগেও সুলতানা রাজিয়ার উদার নীতি ভারতের ইতিহাসে ঐতিহাসিক অধ্যায়। তিনি হিন্দু মুসলিম সকল নর নারী প্রজা সাধারনকে এক চোখে দেখতেন। রাজিয়া ছিলেন ধর্মানুরাগী, জ্ঞানি বিদ্যোতশাহী। তার শাসনামলে ব্যপক শিক্ষা প্রতিষ্টান এবং পাঠাগার স্থাপিত হয়। গন গ্রন্থাগার সমূহে পবিত্র আল কোরআন ও ধর্ম দর্শন সংক্রান্ত পুস্তক সংরক্ষিত থাকত। খিলজিদের উত্থানে দাস বংশের শাসনের অবসান ঘটে। দিল্লী সালতানাতের দ্বিতীয় রাজ বংশ তুর্কি আফগান খিলজি গন। এই বংশের প্রতিষ্টাতা সুলতান জালালুদ্দিন মালিক ফিরোজ খিলজি হলেও এই বংশের আলাউদ্দিন খিলজি শ্রেষ্ট শাসক। খিলজিগন তুর্কি-আফগান। আফগানিস্থানের একটি গ্রামের নামে এই বংশের নামকরন। এই বংশের শ্রেষ্ট শাসক ও বীর যোদ্ধা সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি ক্রমাগত মোঙ্গঁল আক্রমন থেকে ভারতকে রক্ষা করেছিলেন। তিন লক্ষ সুশিক্ষিত সেনাবাহিনীর অধিনায়ক আলাউদ্দিন খিলজি কঠোর হস্তে যাবতীয় রাজপুত বিদ্রোহ দমন করতঃ রাজ্য সীমাবর্ধিত করেন। সমর নায়ক আলাউদ্দিন খিলজি ছিলেন একজন আদর্শ শাসক, শিক্ষা ও সংস্কৃতির উদার পৃষ্টপোষক। তাঁর আমলেই ভারতীয় মুসলিম ঘরানার সঙ্গীঁত ও সংস্কৃতির সূচনা। তার সভা কবি আমীর খসরু ভারতীয় ও ফরাসী সঙ্গীঁতের সমন্বয়ে ভারতীয় সঙ্গীঁত জগতে বিপ্লব ঘটান। দিল্লি সালতানাতের তৃতীয় রাজ বংশের নাম তুঘলক বংশ। তুঘলকগন তুর্কি বংশীয় মুসলমান হলেও তারা আফগান মুসলমানদের সঙ্গেঁ জোট গঠন করে গাজি মালিকের নেতৃত্বে তুঘলক বংশের শাসন প্রতিষ্টা করেন। ১৩২১ সালে গাজি মালিক গিয়াস উদ্দিন তুঘলক উপাধি ধারন করে দিল্লীর সিংহাসন আরোহন করে দিল্লীর উপকন্ঠে তুঘলকবাদ প্রতিষ্টা করেন। এই বংশের আলাড়ন সৃষ্টি কারি শাসক মোহাম্মদ আদিল বিন তুঘলক ১৩২৫ থেকে ৫১ সাল পর্যন্ত দিল্লী শাসন করে রাজধানী দিল্লী থেকে দৌলতাবাদ অতঃপর পূনঃ দৌলতাবাদ থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত করে ইতিহাসবিদদের বিপুল সমালোচনার সম্মুখীন হয়ে ভারতের ইতিহাসে পাগল তুঘলক হিসাবে কুখ্যাতি অর্জন করেন। কোন যোগ্য উত্তরসূরী না থাকায় তুঘলক বংশের শাসনাবসান হয়। সর্ব্বোপরি ১৩৯৮ সালের ১৫ই ডিসেম্বর তৈমুর লং ভারত আক্রমণ করতঃ দিল্লী সালতানাতের বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করলে এই বংশের ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়।
দিল্লী সালতানাতের চতুর্থ রাজ বংশ সৈয়দ বংশ। ১৪১৪ থেকে ৪১ সাল মোট ৩৭ বৎসর চারজন সৈয়দজাদা দিল্লী শাসন করেন। সৈয়দ বংশের প্রতিষ্টাতা খিজির খাঁন। এই বংশ নিজেদেরকে মহানবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (দঃ) এর বংশের বলে দাবী করতেন। তাদের সময় দিল্লীর রাজ ভাষা ছিল ফারসি। মহাবীর তৈমুর লং এর আক্রমনে যখন দিল্লী লুন্ঠিত ও বিদ্ধস্থ তখন দেশব্যাপী বিরাজমান বিশৃঙ্খলার মাঝে শাসনভার গ্রহন করে এই সৈয়দ বংশ দিল্লীতে শান্তি ফিরিয়ে আনেন। ইয়াহিয়া বিন আহমদ সিরহিন্দি রচিত-তারিখি মুবারকশাহ তে সৈয়দ বংশর বিবরন পাওয়া যায়। তিনি তার এই বিখ্যাত গ্রন্থে খিজির খানকে মহানবী (দঃ) এর বংশের বলে উল্লেখ করেছেন। দিল্লী সালতানাতে সৈয়দ বংশের শেষ শাসক আলাউদ্দিন আলম শাহ। রাজ সিংহাসন প্রাপ্তি, দখল ও অধিকারে যেখানে যোগ্যতা, উত্তরাধিকার, তরবারি, সৈন্য বাহিনী, যুদ্ধ বিগ্রহের প্রয়োজন হয় সেখানে সৈয়দ বংশীয় এই শেষ শাসক স্বেচ্ছায় দিল্লীর সিংহাসন বাহলুল খান লোদীর অনুকুলে ত্যাগ করে বাদাউন গমন করেন। দিল্লী সালতানাতের শেষ ও পঞ্চম রাজ বংশ লোদী রাজ বংশ। লোদীরা ছিলেন পুশতুভাষী খান পদবী ধারী আফগান। ১৪৫১ সালে বাহলুল খান লোদী এই রাজ বংশ প্রতিষ্টা করেন। এই বংশের শেষ শাসক ইব্রাহিম লোদী। ১৫২৬ খৃষ্টাব্দে পানি পথের প্রথম যুদ্ধে চেঙ্গীঁস তৈমুরের অধঃস্থন বংশধর জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবরের কাছে পরাজিত ও নিহত হলে দিল্লীতে লোদী বংশ ও দিল্লী সালতানাতের অবসান হয়। আফগান গনবিভক্ত থাকায় দিল্লীর সুলতান ইব্রাহিম খান লোদী ভারতীয় আফগানদের সাহায্য সহযোগীতা পাননি। ফলতঃ রাজ্য রক্ষায় মহাবীর বাবরের সঙ্গেঁ বীর দর্পে লড়াই করে স্বদেশ ও স্বাধীনতার জন্য প্রানদেন ইব্রাহিম খান লোদী। বাবরের বিজয়ে ভারতে মুঘলশাহীর শুভ সূচনা। দিল্লী সালতানাতের অবসান।
মধ্য যুগের  দিল্লী সালতানাত শুধুমাত্র দিল্লী নয় ভারতের ইতিহাসের স্বর্ন যুগও বলা যেতে পারে। শিক্ষা, জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শনের সেই অনগ্রসর যুগেও দিল্লী সালতানাতের মহান সুলতান গনের রাজ্য পরিচালনা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতি, প্রজাহিতৈষী কার্য্যক্রম, ব্যাতিক্রমী শাসকদের প্রজাসাধারনের নিকট কোন দায়বদ্ধতা ছিলনা তবুও দায়িত্ব বোধ থেকেই দিল্লী সুলতানগন প্রজাহিতৈষী কার্যক্রম করেছেন। সিংহাসন ও শাসন ক্ষমতা নিয়ে শাসক সম্প্রদায়ের মধ্যে মত পার্থক্য মনমালিন্য এমনকি যুদ্ধ বিগ্রহ হলেও তা শাসক সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল প্রজা সাধারনের উপর তার কোন বিরুপ প্রতিক্রিয়া কিংবা প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি। অথছ দুঃখ ও দূর্ভাগ্যজনকভাবে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে মানব জাতি শিক্ষাও জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করে ও কুশিক্ষা, সাম্প্রদায়ীকতা, জঙ্গীবাদ, মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে।
ক্রয়োদশ শতাব্দীর দিল্লী সুলতানগন জন্মগত ভাবে ভারতীয় ছিলেন না, কিন্তু রাজ্য শাসন, প্রজা পালনে তারা ছিলেন আদি ও অকৃত্তিম ভারতীয়। দিল্লী ও ভারতীয় জনগোষ্টীকে শিক্ষা ও জ্ঞানে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করার জন্য দিল্লীর সুলতানগন শিক্ষা, ভাষা ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে বহুবিধ কার্য্যক্রম করেছিলেন। সর্বভারতীয় সাংস্কৃতিক রেঁনেসায় দিল্লী সালতানাতের ঐতিহাসিক অবদান ইতিহাসের গৌরবোজ্জল অধ্যায়। এই আমলেই সংস্কৃত, প্রাকৃত এবং ফারসি ভাষার সমাহারে আন্ত সংমিশ্রনে উর্দূ ভাষার জন্ম। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সুলেখক সাহাদাত হোসেন খান তার সুবিশাল গবেষনা গ্রন্থ -মুঘল স¤্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়- এ বলেন “ হিন্দু মুসলিম সাংস্কৃতিক মিশ্রন, স্থাপত্য, সঙ্গীঁত, সাহিত্য, ধর্ম ও পোষাকে স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে। ” দিল্লীর সুলতানদের আমলেই সর্ব প্রথম মুসলিম যাদুঘর প্রতিষ্টিত হয়। ১২৩১ সালে সুলতান সামশুদ্দিন ইলতুত মিশ দিল্লীতে সুলতান ঘারি প্রতিষ্টা করেন- যা ভারতের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম যাদুঘর হিসাবে খ্যাত। রাজ্য পরিচালনায় জনগনের অংশ গ্রহন তথা মতামত এর প্রয়োজনে সুলতানী আমলে অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব মূলক সংস্থা- চিহাল গানি- ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। চিহাল গানি রাজ্য পরিচালনায় গুরুত্ব পূর্ণভূমিকা পালন করেছিলেন- যা আধুনিক জমানায় মন্ত্রী সভার মাননীয় সদস্য- উপদেষ্টা বৃন্দ করে থাকেন।
ক্রয়োদশ শতাব্দীর দিল্লীর শাসক গন সালতানাত অব দিল্লীর শাসক ও জনগন সে যুগেও ছিলেন উদার ও অসাম্প্রদায়িক- তাদের অবদান ভারতের ইতিহাসের গৌরবোজ্জল অধ্যায়।
প্রাচীন নগরী দিল্লী লাল কোট, মেহেরুলি, শহর-ই-নও-বা তুঘলকাবাদ যে নামেই ডাকা হোক না কেন দিল্লী- দিল্লীই। হাজার বছরের গৌরবময় ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে দাড়িয়ে আছে প্রাচীন নগরি দিল্লী। আধুনিক ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লী হলেও গুল্ড দিল্লী তার গুরুত্ব ও প্রাচীনত্ব হারায়নি। উপমহাদেশের প্রবীন সাংবাদিক শক্তিমান সুলেখক সুখয়ান্ত সিং তার বিখ্যাত গ্রন্থ -দিল্লী- তে সেই সব কথা ও কাহিনী লিখেছেন। দিল্লীর সুলতান গন আজ আর নেই। এত বৎসর বেঁচে থাকার কথা নয়। কিন্তু দিল্লীতে আছে অনেক পীর আউলিয়ার মাজার। আজমীরে চীর শয়ানে শায়িত আছেন সুলতানুল হিন্দ গরীবে নেওয়াজ খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রঃ আঃ)। তিনি ৯৫ বৎসর বয়সে মহান মৃত্যোকে আলীঙ্গন করেন। তার দরগাহে বারো মাস দৈনিক হাজার হাজার এবং বার্ষিক ওরশে লক্ষ লক্ষ আশেকান হাজির হয়ে জিয়ারত ও জিগির আজগার করেন। দিল্লীতে আরো আছে হযরত নিযাম উদ্দিন আউলিয়া, কুতুব উদ্দিন বখতিয়া খাকি প্রমুখ পীরে কামেলের মাজার। আছে চাঁদনী চকের বিখ্যাত বাজার ভারতের তাবত জিনিষ এই বাজারে পাওয়া যায়। দিল্লীর লাড্ডু, বিশ^খ্যাত দিল্লীর লাড্ডু খাওয়া নিয়ে মুখরোচক গল্প আছে- দিল্লীকা লাড্ডু যবই খাতা হ্যায়। পূরাতন দিল্লীর লাল কেল্লা ও মুঘল ইতিহাস ঐতিহ্যের নিরব স্বাক্ষী হয়ে টিকে আছে।
মধ্যযুগের উচ্চ মন মানসিকতার অধিকারি দিল্লী সালতানাতের উজ্জল স্মৃতির প্রতি সুগভীর শদ্ধাঞ্জলি। তাঁদের রুহের মাগফিরাত কামনা করি। খাজা গরীবে নওয়াজ এর মাজার শরীফ জিয়ারতের মহান সুযোগ দিয়েছিলেন আমাদের মহান মালিক সর্ব¦ শক্তিমান আল্লাহ তায়ালা। তাঁর পাক দরগায় হাজার সালাম।
লেখক ঃ সিনিয়র এডভোকেট হাইকোর্ট। মুক্তিযোদ্ধা। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব। সেক্রেটারি জেলা জামে মসজিদ, মৌলভীবাজার।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com