মরমি কবি হাসন রাজা : শততম ওফাত বার্ষিকীর শ্রদ্ধাঞ্জলী, স্মরণ, ধর্ম-কর্ম ও জীবন দর্শন
মুজিবুর রহমান মুজিব॥ বিগত ছয়ই ডিসেম্বর বিশশ’বাইশ সাল মরমি কবি হাসন রাজার মৃত্যুর শতবর্ষ পূর্ণ হল। তিনি ১৯২২ সালের ৬ই ডিসেম্বর তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমাধীন লক্ষনশ্রী পরগনায়তেঘরিয়া গ্রামে নিজ জমিদার বাড়ীতে পৈত্রিক-পারিবারিক বাসভবনে মায়াময় এই মাটির পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে মহান মৃত্যুকে আলিঙ্গঁন করেন-মৃত্যোর স্বাদ গ্রহন করেন। তাঁর ও আমাদের মহান স্রষ্টাও প্রতিপালক দু-জাহানের খালিক-মালিক সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ তায়ালার শাহীদরবারে হাজিরা দেন।
মৃত্যোকালে এই লোক প্রিয় লোক কবির বয়স হয়েছিল মাত্র ৬৭ বৎসর ১১ মাস ১৫ দিন। বৃহত্তর সিলেটের বিশিষ্ট ভূ-স্বামী, বিখ্যাত জমিদার দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরীর ঔরসে এবং স্নেহময়ী জননী বেগম হুরমত জাহান বিবির গর্ভে ১৮৫৪ সালের ২১ শে ডিসেম্বর মানব শিশু দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরীর জন্ম। পিতৃ-মাতৃকুলের দিক দিয়ে জন্ম সুত্রেই অত্যন্ত অভিজাত-সম্ভ্রান্ত-বিত্তবান-খান্দানি পরিবারের কৃতি সন্তান হলেও বাল্য কৌশোর কাল থেকেই কিশোর হাসন রাজা সংসার বিরাগি ভাবুক মানব প্রেমিক এবং নির্লোভ নিরহংকারী আদম সন্তান ছিলেন।
বাল্য কৈশোর কাল থেকে বালক হাসন রাজা দুনিয়া দারি, জমিদারি, চাওয়া-পাওয়া লোভ-লালসা পরিহার করে ডাক সাইেটে জমিদার পুত্র মহা পরাক্রমশালী জমিদার দেওয়ানহাসন রাজা চৌধুরী না হয়ে পারিবারিক ঐতিহ্যও জন্ম সুত্রে প্রাপ্ত নামের প্রথম ও পিছনের পদবী “দেওয়ান” এবং “চৌধুরী” পরিহার করে শুধু মাত্র হাসন রাজা-মরমি কবি হাসন রাজা হিসাবে খ্যাতি ও স্বীকৃতি লাভ করেন। মহান মালিকের মর্জিতে সুনামগঞ্জের পরিবেশ ও প্রকৃতি হাওর-বাওর, বৃহৎ টাঙ্গুঁয়ার সুনীল জলরাশি-বিশাল আফালের উথাল পাতাল ঢেউ, দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ,অপরূপ প্রাকৃতিক নিসর্গ, মানব প্রেম এবং সর্ব্বোপরি আল্লাহ ও রাসুল প্রেমে ফানা ফিল্লা হয়ে দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী জাদরেল জামিদার না হয়ে- হয়ে যান ভাবুক প্রেমিক সহজ সরল সাদা মনের মানুষ-মহৎ মানুষ-মহান মানুষ মরমি কবি হাসন রাজা।
স্বভাব কবি, জমিদার নন্দন হাসন রাজা আল্লাহর প্রতি অগাধ আনুগত্য প্রকাশ করেন গেয়ে উঠেন “হাসন রাজায় বলেও আল্লাহ ঠেকাইলায় ভবের ও জালে-বেভুলে মজাইলায় গো মোরে এই ভবের ও খেলে”। হাজার সঙ্গীতের স্রষ্টা মরমি কবি হাসন রাজার খোদা ভক্তি ও ভিরুতা বিষয়ক জনপ্রিয় গানের সংখ্যা অনেক। হাসন রাজার ইসলাম ধর্ম বিষয়ক সঙ্গীতের মধ্যে জনপ্রিয় গানটি হল “লোকে বলে ও বলেরে ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার, কি ঘর বানাইমু আমি শুন্যের ও মাজার-, এই ভাবিয়া হাসন রাজার ঘর দুয়ার নাবান্ধে কোথায় নিয়া রাখব আল্লায় তার লাগিয়া কান্দে”।
এই মরমি কবির ধর্ম সঙ্গীঁত এর মধ্যে-“আমি যাইমু গো যাইমু আল্লাহর ও সঙ্গেঁ হাসন রাজা আল্লাহ বিনে অন্য নাহি মাঙ্গেঁ-”, “বাউলা কেবানাইলরে হাসন রাজারে- বানাইল বানাইল বাউলা তাঁর নাম হয় যে মউলা- দেখিয়া তার রুপের ছটক হাসন রাজা হইল আউলা”, “মাটির ও পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়ারে কান্দে হাসন রাজার মন ময়নারে, হাসন রাজায় কয় আমি কিছু নয়রে আমি কিছু নয়, অন্তরে বাহিরে দেখি শুধু দয়াময়” ইত্যাদি সবিশেষ উল্লেখ যোগ্য।
বৃটিশ ভারতের শেষে ভাগে তৎকালীন পূর্ব বঙ্গেঁর সিমান্ত বর্ত্তী জনপদ সুনামগঞ্জের এক পল্লী গ্রামে হাসনরাজার জন্ম। পিতৃ-মাতৃ কুলের দিক দিয়ে অভিজাত ও বিত্তবান পরিবারের সন্তান হলেও এখনকার মত তখন মফস্বল পর্যায়ে শিক্ষাও জ্ঞান বিজ্ঞানের ব্যাপক চর্চা ও প্রচলন ছিল না। কোন প্রাতিষ্টানিক উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষাও সনদ ছাড়া হাসন রাজা পৃথিবীর পাঠ শালা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উচ্চ মার্গীয় জীবন দর্শনের চর্চা করেছেন, তাঁর সঙ্গীঁত চর্চাও জীবন দর্শন এখনও এই আধুনিক শিক্ষিত সমাজে চিন্তা ভাবনার সতুন দিগন্ত উম্মোচন করে। বাংলা সাহিত্যের কাল জয়ী প্রতিভা বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাসন রাজার গান ও জীবন দর্শনের ভূয়শী প্রশংসা করে বলেছিলেন পূর্ববঙ্গীঁয় এই গ্রামীন কবির ভাষা দূর্বল হলেও ভাবও জীবন দর্শন উচ্চ মার্গীয়।
মরমি কবি হাসন রাজার মৃত্যো শত বার্ষিকী উপলক্ষে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন এবং হাসন রাজার সুযোগ্যউত্তর সূরীগন কবির কবর জিয়ারত ও স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করেন। দৈনিক সিলেটের ডাকের সুনামগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি এই প্রসঙ্গেঁ একটি প্রাসঙ্গিঁক ও চমৎকার প্রতিবেদ প্রকাশ করেন। সুনামগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি যথাযথ লিখেন “মরমি সঙ্গীঁতের মহাজন দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী জীবন ও জগতের নিগুর তত্ত্বকে আঞ্চলিক শব্দের সহজিয়া ভাষায় প্রকাশ করে অমর হয়ে আছেন। আভিজাত্যের পোষাকের সঙ্গেঁ পৈত্রিক নাম দেওয়ান হাসনরাজা চৌধুরী বদলে দিয়ে কেবল হাসনরাজা নামেই তিনি সঙ্গীঁতে মহাজন হয়ে রয়েছেন।
জমিদারি বাদ দিয়ে বৈরাগ্যের বেশে এনাম নিয়েই সঙ্গীঁত সাধনা করেছেন আমৃত্যো, তার রচিত গানের সংখ্যা প্রায় হাজার এর অধিক”। মরমি কবি হাসন রাজা প্রসঙ্গেঁ দৈনিক সিলেটের ডাকের সুনামগঞ্জ জেলা প্রতিনিধির এই প্রতিবেদনটি খুবই প্রাসাঙ্গিঁক এবং তথ্য ও তত্ব বহুল। মরমি কবি হাসন রাজার রক্তও সংস্কৃতির গৌরবোজ্জল উত্তরাধিকারি গন কবির বাড়িতে হাসন রাজা মিউজিয়াম স্থাপন করে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। হাসন রাজা পরিষদের সভাপতি ও গবেষক কবির প্র পেীত্র সামারিন দেওয়ান, সাধারণ সম্পাদক ও প্র পৌত্র দেওয়ান তাসাদ্দুক রাজা হাসন রাজার জীবন দর্শন তাঁর কাব্য ভাবনা- সঙ্গীঁত সাধনা নিয়ে গবেষনা করছেন।
গত সাতই ডিসেম্বর বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো বারো পৃষ্টার স্মরণ এ-“তাহলে এটা হাসন রাজার ছবি নয়” শিরোনামে হাসন রাজার দুটি ছবি সহ আরেকটি তথ্যবহুল প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় প্রতিবেদক মকফুল হোসেনের নামে। বৃহত্তর সিলেটের আদি বাসিন্দা চিত্র নায়ক হেলাল খান প্রয়োজিত অভিনীত, গুনীও সৃজনশীল পরিচালক চাষি নজরুল ইসলাম পরিচালিত হাসন রাজা ছায়াছবিতে মরমি কবি হাসন রাজার কর্ম্ম ও জীবন দর্শন উপস্থাপিত হয়েছে।
হাসন রাজা ছায়া ছবিটির প্রয়োজক এবং নাম ভূমিকায় অভিনয়কারি হেলাল খান দৈনিক প্রথম আলোকে জানান প্রয়োজক ও মুখ্য অভিনেতা হিসাবে তিনি এবং তাঁর টিম একাধিক দিন পরিদর্শন-জন জিজ্ঞাসাবাদে সরেজমিনে যান হাসন রাজার সুনামগঞ্জে। আকর্ষনীয় গৌঁফও পাগড়ি পরিহিত হাসন রাজার ছবিটি স্থানীয় ভাবে আঁকিয়ে দিয়ে অংকিত বলে জানান, চিত্র নায়ক প্রয়োজক হেলাল খাঁন। গবেষক সামারিন দেওয়ান প্রথম আলোকে জানান কল্পনাও অনুমানে অংকিত ছবিটি হাসন রাজার নয়। প্রথম আলোতে প্রকাশিত দ্বিতীয় ছবিটি মরমি কবি হাসন রাজার প্রথম ও এক মাত্র আলোক চিত্র। কোলকাতায় আসা যাওয়া ছিল হাসন রাজার।
১৯১৪ সালে কোলকাতার একটি বিখ্যাত ষ্টুডিওতে ছবিটি উঠিয়ে ছিলেন হাসন রাজা। হাসন রাজার উত্তর পূরুষ গবেষক সামারিন দেওয়ান প্রথম আলোকে জানান- “ সেবারই শেষ বারের মত কলকাতায় গিয়েছিলেন তিনি। ছবিটি তুলে বেশ কয়েকটি কপি এনে বাড়িতে গানের আসরের সঙ্গী, প্রতিবেশি ও নিজের বংশধরের কাছে বিলি করেছিলেন। বংশপরম্পরায় দাদা থেকে বাবা, বাবা থেকে নিজের হাতে ছবিটি পেয়েছেন- ছবিটি সংরক্ষণ করা না গেলে হাসন রাজার চেহারা স্মৃতি বিলীন হয়ে যেত”।
দৈনিক প্রথম আলোতে মকফুল হোসেন পরিবেশিত তথ্য মতে, ২০১৮ সালে ছবিটি সংরক্ষনের জন্য বাংলাদেশ কপি-রাইট অফিসে মেধাস্বত্ব পেতে আবেদন করেন হাসন রাজার উত্তরাধিকারীগন। যাছাই বাছাই শেষে সেই ছবির মেধাস্বত্ব সনদ তাঁদেরকে দেওয়া হয়েছে বলে জানান গবেষক সামারিন দেওয়ান। ঢাকার মাওলা ব্রাদাস থেকে প্রকাশিত গবেষক সামারিন দেওয়ানের হাসন রাজা জীবন ও কর্ম গ্রহ্নে এই মূল ছবিটি ব্যবহৃত হয়েছে। ২০০৬ সালে হাসান রাজার স্মৃতি ধন্য সুনামগঞ্জে সুরমার তীরে হাসন রাজা যাদুঘর প্রতিষ্ঠার পর ২০০৮ সাল থেকে ছবিটি দর্শনার্থীদের জন্য প্রদর্শিত হচ্ছে।
হাসন রাজা যাদুঘরটি, সুনামবাহী সুনামগঞ্জের আমার পরম শ্রদ্ধেয় গুরুজন কবিও গবেষক লে. কর্নেল সৈয়দ আলী আহমদ (অবঃ) সহ পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছে আমার। এই যাদু ঘরের কাছেই চীর শয়ানে শায়িত আছেন দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী, কবিতা, সঙ্গীঁত ও দর্শনের ভূবনের প্রিয়ও পরিচিত নাম মরমি কবি হাসন রাজা।
ষাটের দশকের শুরুতে হাসন রাজার সুনামগঞ্জে বড় হয়েছি বেড়ে উঠেছি। সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় হাসন রাজার প্রৌত্র সহজ সরল ভালো মুনাষ ভালো ছাত্র সুদর্শন দেওয়ান শফিকুছ ছাবেরীনের সহপাঠিও বিশিষ্ট বন্ধু ছিলাম। সেই সুবাদে দেওয়ান ছাবেরীন এর অগ্রজদ্বয় সাবেক সাংসদ দেওয়ান সামশুল আবেদীন এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান দেওয়ান জয়নুল জাকেরিন আমাকে অনুজের মত ¯েœহ মমতা করেন।
ছামারিন দেওয়ান এবং সুনামগঞ্জ পৌরসভার জনপ্রিয় মরহুম পৌরপতি মুমিনুল মউজদীন বন্ধুবর দেওয়ান ছাবেরীন এর অনুজ হিসাবে তারাও আমাকে অগ্রজের মত সম্মান করেন। এমনিতেই মরমি কবি হাসন রাজার গৌরবোজ্জল উত্তরাধিকারি গন এর ভদ্রতা, ন্রমতা, বিনয়, শিষ্টাচার ও সৌজন্য বোধ স্মরনী ও শিক্ষনিও। আমার মুরব্বি, গুণীও গুরুজন কবি ও গবেষক লেঃ কর্নেল সেয়দ আলী আহমদ (অবঃ) ঐতিহ্যবাহী সৈয়দপুরের প্রখ্যাত পীর বংশীয় সৈয়দ জাদা। হাসন রাজার ভুবনে ছামারিন দেওয়ান সাহেব আন্তরিক ভাবে স্বাগতও উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন।
আমরা হাসন রাজা মিউজিয়াম ঘুরে ঘুরে দেখলাম। মরমি কবি হাসন রাজার কর্ম ও জীবন দর্শন সংক্রান্ত আমার রচনা সম্বলিত একাধিক গ্রহ্ণ যাদুঘর পাঠাগারে উপহার দিলাম। আমি উপহার পাই একটি মূল্যবান আলোক চিত্র। প্রথম আলোতে প্রকাশিত হাসন রাজার মূল আলোক চিত্র। শিল্পীর তুলিতে কল্পনায় হাতে আঁকা ছবি নয় ১৯১৪ সালে কোলকাতায় ষ্টুডিওতে তোলা হাসন রাজার মূল ছবি। উজ্জ্বল ফর্সা চেহারা, উন্নত নাসিকা, আকর্ষনীয় পূরুশালি বিশাল গোফঁ মাথায় পাগড়ি এবং পরিধানে জমকালো ঐতিহ্য বাহী আলোয়ান। দুনিয়াদারি জমিদারি শান শওকত ছাড়লেও আহার বিহার পোষাক সচেতন ছিলেন মরমিয়া হাসন রাজা।
ছবিটি আমি নিয়ে এসে আমার রসুলপুর হাউসস্থ মমতাজ মেম্যোরিয়াল লাইব্রেরী ও চেম্বার পাঠাগারে সংরক্ষিত রাখি। এখন ও হাসন রাজার এই দূর্লভ ছবিটি আমার সংরক্ষনে আছে, বেলাশেষে আমি এখন জীবন সায়াহ্ণে তাই সব আইন বই গুলি জেলা আইনজীবি সমিতি এবং মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাস ঐতিহ্য সাহিত্য সংস্কৃতি সংক্রান্ত গ্রহ্ণরাজি মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব এবং মৌলভীবাজার পৌর সভার প্রবীণাঙ্গান পাঠাগারের দান করে দিয়েছি। ১৯৬৪ সালে সুনমগঞ্জ সরকারি জুবিলি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে আমি কৃতিত্বের সাথে এস,এস,সি পাশ করে পিতা মাতার ইচ্ছায় উচ্চ শিক্ষার জন্য এম,সি কলেজে ভর্তি হই।
সুনামগঞ্জ থেকে স্ব-শরীরে চলে এলেও যোগাযোগ ছিল সব সময়। আমার দুই বাল্য সখা অধুনা সুনামগঞ্জের দুই প্রবীণতম আইন জীবী ও কলম সৈনিক আবু আলী সাজ্জাদ হোসেন এডভোকেটএবং স্বপন কুমার দেব এডভোকেট দয়া বিতরনে এখন ও এই অধমের খুজ খবর করেন জীবন ও জগৎ প্রসঙ্গেঁ বিভিন্ন প্রাসাঙ্গিঁক পরামর্শ দেন।আমার পরম শ্রদ্ধেয় দাদা মৌলভী মোঃ আনোয়ার বৃটিশ ভারতের শেষ ভাগে সরকারি চাকরির সুবাদে সুনামগঞ্জ বসতি স্থাপন করেন। সুনামগঞ্জের মাটিও মানুষের মায়ায় তিনি পদোন্নতিও বদলির চেষ্টা না করে এখান থেকেই অবসর গ্রহন করে আশির দশকে পরিনত বয়সেই পর লোক গমন করত। এখানেই সমাহিত হন।
তাঁর সুসন্তানগনের মধ্যে এক মাত্র কন্যা বেগম ছালেহা ছত্তার সুপুত্র সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সম্পাদক এডভোকেট রুহুল তুহীনের সঙ্গেঁ পিতার শহরে বসবাস করছেন। আর সব কবর বাসি। হাসন রাজার সুনাম গঞ্জের সঙ্গেঁ আমাদের জেলা বাসির আত্বীক আত্বীয়তার সু-সম্পর্ক আছে। মৌলভীবাজার দুই এর মাননীয় সংসদ সদস্য, কেন্দ্রীয় ছাত্র লীগের সাবেক সভাপতি এবং ডাকসুর সাবেক ভি.পি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ হাসন রাজা পরিবারেরসুযোগ্য জামাতা। হাসান রাজার পুত্র কবি মুমিনুল মউজদীন আমাদের মৌলভীবাজারি দামান্দ।
জেলাধীন সমশের নগরের আব্দুল হান্নান চৌধুরীসাহেবের কন্যা তাহেরা চৌধুরীর সঙ্গে কবি মউজদীনের শুভ বিবাহ হয়। আফসোস দূর্ভাগ্য জনক ভাবে একটি মারাত্মক সড়ক দূর্ঘটনায় মর্মান্তিক ভাবে উভয়েই মৃত্যো বরন করেন। তাহেরা চৌধুরীবিখ্যাত কন্ঠ শিল্পি সেলিম চৌধুরী ভগ্নি।মরমি কবি হাসন রাজার ইন্তিকালের পরও তাঁর উত্তর পুরুষগনের মধ্যে মানব প্রেম মরমি ভাব ধারাও কাব্য চর্চা অব্যাহত ছিল। আছে।
হাসন রাজার তৃতীয় পুত্র ১৮৮৯ সালে জন্ম গ্রহন কারি দেওয়ান একলিমুর রাজা চৌধুরী কবি, গীতিকার ও ঔপন্যাসিক ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের দুই কালজয়ী প্রতিভা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলাম এর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। কাব্য বিষারদ ও খান বাহাদুর খেতাব প্রাপ্ত একলিমুর রাজার গানের গ্রহ্ণ-প্রানের কথা গানে প্রকাশিত হয় ১৩৫৬ বঙ্গাঁব্দে। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় গানের সংকলন গীতি মেখলা। মরমি কবি হাসন রাজার নাতি রাজনীতি বিদ দেওয়ান তৈমুর রাজা চৌধুরী একজন কবি ছিলেন। দেওয়ান সমশের রাজা সম্পদিত হাসন রাজার তিন পুরুষ গ্রহ্ণে তাঁর ৪১টি গান স্থান পেয়েছে।
হাসন রাজার উত্তরসুরী দেওয়ান মোহাম্মদ তাছাওয়ার রাজা একজন পরিশ্রমী ও মেধাবী লেখক গবেষক। অধ্যাপক নন্দলাল শর্মা তাঁর সিলেটের সাহিত্যাঙ্গঁন গ্রহ্ণে দেওয়ান মোহাম্মদ তাছাওয়ার রাজা প্রসঙ্গে বলেন, “হাসন রাজা সমগ্র”-হাসন রাজার সমগ্র রচনা সম্পাদন করা তাঁর মূল্যবান স্বারশ্বত কর্ম”। মরমি কবি হাসন রাজার “পহ্ণি” দেওয়ান সমশের রাজা একজন শক্তিমান লেখক গবেষক। ১৯৭৮ সালে তিনি হাসন রাজা তৎপুত্র দেওয়ান একলিমুর রাজা, তৎপুত্র দেওয়ান তৈমুর রাজার গান কর্ম্ম জীবন নিয়ে বের করেন মূল্যবান গ্রহ্ণ “হাসন রাজার তিন পুরুষ”। গ্রহ্ণ গুলি দারুন পাঠক প্রিয়তা পায়।
একালে এসে সবাইকে বাজিমাত করেন হাসন রাজার প্র প্রৌত্র কবি মুমিনুল মউজদীন। মরমি কবি হাসন রাজার কর্ম ও জীবন দর্শনের অনুসারি মউজদীন একজন জীবন ঘনিষ্ট আধুনিক কবি, জলও জোৎস্না প্রেমিক ছিলেন। মনবতাবাদী গনমুখী রাজনীতিবিদ মউজদীন সাম্প্রতিক কালে সুনামগঞ্জ পৌরসভার ইতিহাসে সবচাইতে জনপ্রিয় পৌরপতি ছিলেন। মরমি কবি হাসন রাজার প্রিয় সুনামগঞ্জ শহরকে তিনি যানযট, সন্ত্রাস, মাদক মুক্ত করে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর বিখ্যাত কবিতা এ শহর ছেড়ে আমি পালাব কোথায়। মউজদীন মরমি কবি হাসন রাজার মত নামের প্রথম ও শেষ পদবী দেওয়ান ও চৌধুরী পরিত্যাগ করে শুধু কবি ও মানুষ মউজদীন হিসাবে পরিচিত হতে চেয়েছিলেন-হয়েছিলেনও।
তিনি তাঁর স্বজন ও মিত্রদের কাছে দেওয়ান সাহেব, চৌধুরী সাহেব, রাজা সাহেব এর পরিবর্তে মউজদীন ভাই হিসাবে পরিচিতঅভিহিত হতেন। আফসোস আমাদের মৌলভীবাজার এর এই যোগ্য জামাতা ঢাকা থেকে বাড়ি আসার পথে একটি সড়ক দূর্ঘটনায় সস্ত্রীক নির্মম ভাবে নিহত হন। তাঁর স্বজনগণ সুনামগঞ্জ ষ্টেডিয়ামে যে বিশাল শোক সভার আয়োজন করেছিলেন তা ছিল সমগ্র বৃহত্তর সিলেটের মধ্যে বৃহত্তম শোক সভা। ঢাকা থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইনবিদ ডক্টর কামাল হোসেন. সুপ্রীমকোট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক বিশিষ্ট আইন জীবী এ.এম আমিন উদ্দিন, বর্তমানে বাংলাদেশের বিজ্ঞ এটর্নি জেনারেল সহ গন্য মান্য নেতৃবৃন্দ এসে তাঁর মানবিক গুনাবলির ভূয়শী প্রশংসা করতো।
রুহের মাগফিরাত কামনা করেছিলেন। খুশ নসীব আমার সেই শোকসভার আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে গিয়েছিলাম, মঞ্চে আসন গ্রহনও দু কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। বিগত দীর্ঘ মেয়াদী কেয়ার টেকার সরকার আমলে সেদিন সমগ্র সুনামগঞ্জ শহর ছিল লোকে লোকারন্য। সমগ্র শহরে শোকের ছায়া। কালোব্যেনার কালোবেজ কালোকাপড়ে ঢাকা সমগ্র সুনাম গঞ্জ শহর।ঝুলছে কালোবেনার এ শহর ছেড়ে আমি পালাব কোথায়, গানের শহর প্রানের শহর হাসন রাজার প্রিয় শহর সুনামগঞ্জ সেদিন ছিল নির্বাক। নিস্তব্দ। সীমাহীন বেদনা এক বুক কান্না।
১৯৫০ সালে ইষ্ট বেঙ্গঁল ইষ্টেট একিউজিশন এন্ড টেনেন্সি এ্যাক্ট সাধারন্যে “প্রজাস্বত্ব আইন” নামক আইনে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়ে ভূমিতে কৃষক রায়ত প্রজার অধিকার সংরক্ষিত হয়। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর জমিদার হাসন রাজার উত্তর পুরুষ গন কালে কালে জনগনের কাতারে থেকেছেন নেতৃত্ব দিয়েছেন। মন্ত্রী, সাংসদ, জনপ্রতিনিধি একাত্তোরে মহান স্বাধীনতার সংঘটক হয়েছেন। সংগঠক সুলেখক স্বপন কুমার দেব এর গ্রহ্ণ স্বাধীনতার গল্প এবং অন্যান্য গল্পঃ গ্রহ্ণের তথ্য মতে হাসন রাজার অধঃ স্থন বংশধর দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরী সত্তোর সালের সাধারন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসাবে সুনামগঞ্জ সদরের এম,এন,এ নির্বাচিত হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্দের শুরুতেই তিনি মহকুমা সংগ্রাম কমিটির সভাপতির দায়িত্ব ভার গ্রহন করেন। মুক্তিযুদ্বের সময় তিনি পাঁচ নম্বর সেক্টারে সংঘটকের দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযোদ্ধাও শরনার্থী গনকে প্রয়োজনীয় সাহায্য, সহযোগীতা ও সহায়তা প্রদান করেন। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “খায়েস করে বলেছিলেন মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভূবনেমানবের মাঝে আমি বাচিবারে চাই”- কবি গুরুর এই বেঁচে থাকারআকাংখা শারিরীক ছিল না, ছিল কাব্যিক- কারন সাধারন মানুষ অনন্তকাল বেঁচে থাকতে পারেন না। তাই কবি ও দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যত্র বলেছেন- “মরনরে তূহুঁমম শ্যাম সমান”। শারীরিক ভাবে মৃত্যোবরন করার পর ও কাব্যিক-কার্য্যকি ভাবে বেঁচে আছেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর, আমাদের সহ তিনটি দেশের জাতীয় সঙ্গীঁত কবি গুরু রচিত।
তিনি মরেও অমর হয়ে আছেন।লক্ষনশ্রী-রাম- পাশার বিখ্যাত ভূস্বামীজনদরদি জমিদার দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী ১৯২২ সালের ৬ই ডিসেম্বর মায়াময় মাটির পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চীর তরে চলেযান না ফেরার দেশে সাড়ে তিন হাতজমিনে বালিশ বিছানা ব্যতিত মাটির বিছানা শ্যামল মাটির কোমল বিছানাই তাঁর শেষ ঠিকানা। জীবদ্দশায় তাই তিনি যথার্থই আর্তনাদ করেছেন হৃদয়ের রক্তক্ষরন ঘটিয়েছেন “মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়ারে, কাঁন্দে হাসন রাজার মনময়নায় রে-” বলে। দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরীর দুনিয়াবি জীবন ছিল প্রায় পৌনে আটষট্রি বৎসর মাত্র। তাঁর “বরযকি” জীবন গত ছয়ই ডিসেম্বর শত বর্ষ পূর্ন হল।
দেওয়ান হাসন রাজার উত্তর পুরুষদের জমিদারি না থাকলেও মরমি কবি হাসন রাজার সংস্কৃতিও সঙ্গীঁতের ভূবনে জমিদারি নয় বাদশাহীর ভিত দিন দিন মজবুত হচ্ছে। উপমহাদেশীয় বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী মেহেদী হাসানকে বলা হয় “শাহেন শাহ এ গজল”।ধর্ম চিন্তা, ধর্মানুরাগ ও মরমি সঙ্গীঁতের ক্ষেত্রে আমাদের হাসন রাজাকে মরমি সম্রাট বলা যেতে পারে। ধর্ম-কর্ম, ধর্মানুরুগ, সুকুমার শিল্পের চর্চাও বিকাশ মানুষের মানবিক গুনাবলির বিকাশ ঘটায়।
বানিজ্যায়ন দূবৃত্তায়ন, খাই-খাই, চাই-চাই, পাপিয়া সংস্কৃতি ও কাউয়া কালচারে জোয়ারে স্বাভাবিক জনজীবন বিব্রত, বিরক্ত, বিপর্য্যস্ত, করামত উল্লাহদের আধুনিক সংস্করন“ক্রেমেট ত্র্যালী” এবং দাগ খতিয়ান চৌহদ্দা বিহীন এফিডেভিট চৌধুরী, বউয়া চৌধুরী, ছইয়া চৌধুরী, মিউটেশন চৌধুরী তথা অদ্য চৌধুরীদের আস্ফালন উপদ্রবে জনজীবন যখন বিপর্যস্থ, বিরক্ত তখন মরমি কবি হাসন রাজার দর্শন স্মরন অনুসরন করা যেতে পারে।
শিক্ষা নেয়া যেতে পারে। মরমি কবি হাসন রাজার স্মৃতি বিজড়িত সুনাম বাহী সুনামগঞ্জের নবাগত জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী সাহেব যোগদান করে মরমি কবি হাসন রাজার মৃত্যোশত বার্ষিকী উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তা এবং হাসন রাজার উত্তর পুরুষদেরকে নিয়ে কবির কবর জিয়ারত করতঃ তাঁর রুহের মাগফিরাত এবং স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন।
জেলা প্রশাসক জনাব চৌধুরী এ ব্যাপারে ধন্যবাদ পাবার হকদার। রাষ্ট্রীয় মর্য্যাদায় মরমি কবি হাসন রাজার জন্ম মৃত্যো বার্ষিকী এবং হাসন উৎসব মেলা করলে মরমি কবি হাসন রাজার রুহ শান্তি পাবে, হাসন রাজার অনুসারিগণ কৃতজ্ঞ থাকবেন। খুশী হবেন।
ইতি পূর্বে যারা মরমি কবি হাসন রাজার গান পরম মমতায় ধারন করে সযতেœ পরিবেশন করেছেন তাঁদেরকে বিশেষত দেওয়ান মহসিন রাজা চৌধুরী, উজির মিয়া, সেলিম চৌধুরী, সুবীর নন্দী, আকরামুল ইসলাম, হিমাংশু বিশ্বাস প্রমুখ কে অভিনন্দন জানাই, কৃতজ্ঞতার সঙ্গেঁ স্মরণ করি। মরমি কবি হাসন রাজার শততম ওফাত বার্ষিকীতে তাঁর উজ্জল স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলী, মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করি, মহান মালিক তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন- এই মোনাজাত সহ আমীন, ছুম্মা আমীন।
লেখক : মুজিবুর রহমান মুজিব, ষাটের দশকের শুরুতে সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র, সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সিনিয়র এডভোকেট হাই কোর্ট, সাবেক সভাপতি মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব।
মন্তব্য করুন