মহানবীর (সা.) জীবনাদর্শে শান্তিময় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব

October 9, 2022,

এহসান বিন মুজাহির॥ সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর  পবিত্র জন্ম ও মৃত্যুর দিবস আজ ১২ রবিউল আওয়াল। আজকের এ দিনটি উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য যেমন ভীষণ আনন্দের, তেমনিভাবে বিরহ শোকেরও! বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর শুভাগমন ও ইন্তেকাল মানবেতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা। এরচেয়ে অত্যধিক আনন্দদায়ক, শ্রেষ্ঠত্ব ও অবিস্মরণীয় কোনো ঘটনা বিশ্বের মানচিত্রে দ্বিতীয়বার ঘটেনি। মহানবী (সা.) পৃথিবীতে এসেছিলেন শান্তি, মুক্তি ও কল্যাণের বার্তা নিয়ে এবং রেখে গিয়েছেন সর্বোত্তম আদর্শ। সাইয়েদুল মুরসালিন হজরত মুহাম্মদ সা. সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ। বিশ্বনবীর জীবনাদর্শ  মানবজাতির জন্য একটি কালজয়ী জীবনচরিত্র। মহানবী (সা.) যখন এ ধরায় শুভাগমন করেন সেই যুগ ছিল আইয়ামে জাহেলিয়াতের। সে সময়ে গোটা জাতির ওপর অন্যায়-অত্যাচার, অবিচার, অস্থিরতা, নৈরাজ্য, স্থবিরতা জেঁকে বসেছিল। আরব দেশে বিরাজ করছিল অসংখ্য সঙ্কট ও সমস্যা। যুদ্ধ-সংঘাত, রক্তপাত ছিল তখন নিত্যদিনের ঘটনা। সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়, মিথ্যা, অসত্য, কুসংস্কার, কুপ্রথা, বিভ্রান্তি, নারী জাতির অবমাননা, শোষণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন, ধর্মের নামে অধর্ম প্রভৃতি এমন কোনো দিক ছিল না যেখানে অবক্ষয় ও সঙ্কট ভয়াবহ রূপ ধারণ করেনি। এমনই এক পরিবেশের মধ্যে তিনি কল্যাণ ও মুক্তির বার্তা নিয়ে আগমন করেছিলেন।

তাঁর আগমনের বদৌলতে জাহেলিয়াত, শিরক, পৌত্তলিকতা ও বর্বরতার ঘোর অমানিশায় নিমজ্জিত দুনিয়ায় হেদায়েতের নূর উদ্ভাসিত হয়। জাহিল ও পথভ্রান্ত জাতি হেদায়েতের পরশ পেয়ে জান্নাতের সন্ধান পায়। নবীর আগমনে মানবজাতি দ্বীনের রাস্তার সন্ধান লাভ করে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনে রয়েছে মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। পুত্র দেখতে পাবে তার মাঝে মাতৃ-পিতৃভক্ত আদর্শ পুত্রের সর্বোত্তম চরিত্র। পিতা দেখতে পাবে তার মধ্যে ক্ষমতাশীল কর্তব্যপরায়ণ আদর্শ পিতার চরিত্র। স্বামী দেখতে পাবে তাঁর মধ্যে স্ত্রী-অনুরাগী আদর্শ স্বামীর চরিত্র। ব্যবসায়ী দেখতে পাবে তার মধ্যে সত্যবাদী আদর্শ ব্যবসায়ীর চরিত্র। যোদ্ধারা দেখতে পাবে তার মধ্যে আদর্শ যোদ্ধার চরিত্র। সেনাপতিরা দেখতে পাবে তার মধ্যে রণকৌশল, স্থির মস্তিষ্ক ও বীর সেনাপতির চরিত্র। জনসেবকরা দেখতে পাবে তার মধ্যে আদর্শ জনসেবকের চরিত্র। বিচারকরা দেখতে পাবে তার মধ্যে ন্যায়-নিরপেক্ষ বিচারকের চরিত্র। মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মহামানব  বিশ^নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুপম আদর্শ বিদ্যমান। এমন নবীর আগমনের মাস এবং বিশ্বনবীর সিরাত আলোচনা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ এবং সওয়াবের কাজ। নবীর জীবনচরিত আলোচনার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ ঈমানী চেতনাকে আরও শাণিত, উদ্বেলিত করতে অপরিসীম ভূমিকা রাখে। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার প্রদত্ত দ্বীন ইসলামের পূর্ণতা বিধান করেছেন। বিশ্বনবী (সা.) তার ২৩ বছরের সাধনায়  নির্মাণ করেছিলেন জুলুম, শোষণ ও অবিচারমুক্ত একটি খেলাফতি রাষ্ট্রব্যবস্থা। তার খেলাফতি রাষ্ট্র ব্যবস্থা গোটা মানবজাতির জন্য উজ্জল দৃষ্টান্ত। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনাদর্শ গ্রহণ ব্যতীত ইহ ও পরকালে মুক্তি অর্জন সম্ভবপর নয়। ১২ রবিউল আওয়ালে নবীজির জন্ম হয়েছিল এ নিয়ে ঐতিহাসিকগণ একমত নন। জন্ম তারিখ নিয়ে তাদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন ৯ রবিউল আওয়াল, আবার কারও মতে ১২ রবিউল আওয়াল। পক্ষান্তরে ১২ রবিউল  আওয়াল যে নবীর ইন্তেকাল হয়েছিল, এ নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। তার মিলাদ (জন্ম) ১২ রবিউল আওয়াল সবার কাছে যেমন ছিল আনন্দের, তেমনি ওফাতুন্নবী (নবীর ইন্তেকাল) ১২ রবিউল ছিল  বিরহ শোকের। মিলাদুন্নবী অর্থ হলো নবীর জন্ম। সিরাতুন্নবী অর্থ হলো নবীর জীবনী। জন্ম পালন করার বিষয় নয়; বরং আলোচনার বিষয়। সিরাতুন্নবী (৬৩ বছরের জীবনী) উম্মতের জন্য অনুসরণীয়-অনুকরণীয়। মহান আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘যদি তোমরা রাসুলকে অনুসরণ কর, তবেই তোমরা সত্যপথের সন্ধান পাবে’। (সুরা নূর: ৫৪)। মহান আল্লাহপাক এরশাদ করেন।

তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা আল আহজাব : ২১)। রাসূল (সা.) এর চরিত্র সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা আরও এরশাদ করেন,‘আপনি অবশ্যই উত্তম চরিত্রের অধিকারী’। (সূরা কালাম : ৪০)। অন্য আয়াতে এরশাদ করেন, হে নবী আপনি বলুন, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো তবে আমাকে অনুসরণ করো, তাতে আল্লাহও তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপ মাফ করবেন’। (সুরা নূর : ৫৪)। যারা নবীর (সা.) বিরোধিতা করবে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, যারা নবী (সা.)-এর আদর্শের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক, বিপর্যয় তাদের স্পর্শ করবে, যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদের গ্রাস করবে। (সূরা নূর : ৬৩)। মহান আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, যে কেউ আল্লাহর আনুগত্য করে এবং রাসুলের অনুসরণ করে, সে অবশ্যই মহাসাফল্য লাভ করবে’। (সুরা আহজাব : ৭১) নবীজি বলেন,‘আমার উম্মতের সকল  লোকই জান্নাতি হবে, অস্বীকারকারী ব্যতিত। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল (সা.) অস্বীকারকারী কে? উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, যে আমার অনুসরণ করবে সে বেহেশতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার নাফরমানি করবে সে অস্বীকারকারী’। (বুখারি : ৩১৮৭২)। প্রিয় নবীজীকে আমরা প্রাণের চেয়ে ভালোবাসি। সুন্নতে নববীর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের মাধ্যমে নবীজীর ভালোবাসা প্রমাণ করতে হবে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রিয় নবীজীর আদর্শের প্রতিফলন ঘটাতে না পারলে অনুষ্ঠান নির্ভর মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপনের মাধ্যমে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রে কল্যাণ বয়ে আনবে না। সময় এসেছে চিন্তার পরিধিকে প্রসারিত করে আনুষ্ঠানিকতার বাহুল্যতাকে প্রাধান্য না দিয়ে মৌলিকত্বের দিকে বেশি বেশি ফোকাস করা। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রিয় নবীজীর জীবনাদর্শ বাস্তবায়ন করা। মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন আনুষ্ঠানিকতায় ভরপুর না করে আমাদের প্রিয়নবীর (সা.) পূর্ণাঙ্গ জীবন দর্শন নিজেদের জীবনে কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় এবং সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পরিম-লে তা কীভাবে বিস্তৃত করা যায় সেই বিষয়ে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া অতীব জরুরি। আগামী প্রজন্ম মহানবীর জীবনাদর্শকে ঠিকভাবে অনুসরণ করতে পারলে মাদক, দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত একটি শান্তিময় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। মনে রাখতে হবে যে, মহানবীর (সা.) অনুসরণ ব্যতিত ইহকালে কল্যাণ ও পরকালে মুক্তি পাওয়া নিতান্তই দুরূহ ব্যাপার। বিশ্বনবীকে (সা.) অনুসরণের মাঝেই সকল প্রকার কল্যাণ ও সাফল্য নিহিত রয়েছে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও প্রিন্সিপাল, শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুল, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার।

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com