মহানবীর (সা.) জীবনার্দশ : মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম আদর্শ
এহসান বিন মুজাহির॥ ১২ রবিউল আওয়াল পবিত্র মিলাদুন্নবী (সা.) দিবস। বিশ্বনবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর শুভাগমন ও ইন্তেকাল মানবেতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা। এরচেয়ে অত্যধিক আনন্দদায়ক, শ্রেষ্ঠত্ব ও অবিস্মরণীয় কোনো ঘটনা বিশ্বের মানচিত্রে দ্বিতীয়বার ঘটেনি। মহানবী (সা,) যখন এ ধরায় শুভাগমন করেন সেই যুগ ছিল আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগ। সে সময়ে গোটা জাতির ওপর অন্যায়-অত্যাচার, অবিচার, অস্থিরতা, নৈরাজ্য, স্থবিরতা জেঁকে বসেছিল। আরব দেশে বিরাজ করছিল অসংখ্য সঙ্কট ও সমস্যা। যুদ্ধ-সঙ্ঘাত, রক্তপাত ছিল তখন নিত্যদিনের ঘটনা। সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়, মিথ্যা, অসত্য, কুসংস্কার, কুপ্রথা, বিভ্রান্তি, নারী জাতির অবমাননা, শোষণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন, ধর্মের নামে অধর্ম প্রভৃতি এমন কোনো দিক ছিল না যেখানে অবক্ষয় ও সঙ্কট ভয়াবহ রূপ ধারণ করেনি। এমনই এক পরিবেশের মধ্যে শান্তি, মুক্তি ও কল্যাণের বার্তা নিয়ে তিনি আগমন করেছিলেন। তাঁর আগমনের বদৌলতে জাহেলিয়াত, শিরক, পৌত্তলিকতা ও বর্বরতার ঘোর অমানিশায় নিমজ্জিত দুনিয়ায় হিদায়াতের নূর উদ্ভাসিত হয়। জাহিল ও পথভ্রান্ত জাতি হিদায়াতের পরশ পেয়ে জান্নাতের সন্ধান পায়। নবীর আগমনে মানবজাতি দ্বীনের রাস্তর সন্ধান লাভ করে।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনে রয়েছে মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। পুত্র দেখতে পাবে তাঁর মাঝে মাতৃ-পিতৃভক্ত আদর্শ পুত্রের সর্বোত্তম চরিত্র। পিতা দেখতে পাবে তার মধ্যে ক্ষমতাশীল কর্তব্যপরায়ণ আদর্শ পিতার চরিত্র। স্বামী দেখতে পাবে তার মধ্যে স্ত্রী-অনুরাগী আদর্শ স্বামীর চরিত্র। ব্যবসায়ী দেখতে পাবে তার মধ্যে সত্যবাদী আদর্শ ব্যবসায়ীর চরিত্র। যোদ্ধারা দেখতে পাবে তার মধ্যে আদর্শ যোদ্ধার চরিত্র। সেনাপতিরা দেখতে পাবে তার মধ্যে রণকৌশল, স্থির মস্তিষ্ক ও বীর সেনাপতির চরিত্র। জনসেবকেরা দেখতে পাবে তার মধ্যে আদর্শ জনসেবকের চরিত্র। বিচারকেরা দেখতে পাবে তার মধ্যে ন্যায়-নিরপেক্ষ বিচারকের চরিত্র। মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মহামানব বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) এর অনুপম আদর্শ বিদ্যমান। এমন নবীর আগমনের মাস এবং বিশ্বনবীর সিরাত আলোচনা নিঃসন্দেহ গুরুত্বপূর্ণে এবং সওয়াবের কাজ। নবীর জীবনচরিত আলোচনার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ ঈমানীচেতনাকে আরো শাণিত, উদ্বেলিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সা.) এর মাধ্যমেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর প্রদত্ত দ্বীন ইসলামের পূর্ণতা বিধান করেছেন। বিশ্বনবী (সা.) তাঁর ২৩ বছরের সাধনায় নির্মাণ করেছিলেন জুলুম, শোষণ ও অবিচারমুক্ত একটি খেলাফতি রাষ্ট্র ব্যবস্থা। তার খেলাফতি রাষ্ট্র ব্যবস্থা গোটা মানবজাতির জন্য আদর্শ হয়ে আছে। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনাদর্শ গ্রহণ ব্যতীত ইহ ও পরকালে মুক্তি অর্জন সম্ভবপর নয়।
১২ রবিউল আওয়ালে নবীজীর জন্ম হয়েছিল এ নিয়ে ঐতিহাসিকগণ একমত নন। জন্ম তারিখ নিয়ে তাদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন ৯ রবিউল আওয়াল, আবার কারো মতে ১২ রবিউল আওয়াল। পক্ষান্তরে ১২ রবিউল আওয়াল যে নবীর ইন্তেকাল হয়েছিল, এ নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। তাঁর মিলাদ (জন্ম) ১২ রবিউল আওয়াল সবার কাছে যেমন ছিল আনন্দের, তেমনি ওফাতুন্নবী (নবীর ইন্তেকাল) ১২ রবিউল ছিল বিরহ শোকের। মিলাদুন্নবী অর্থ হলো নবীর জন্ম। সিরাতুন্নবী অর্থ হলো নবীর জীবনী। জন্ম পালন করার বিষয় নয়; বরং আলোচনার বিষয়। সিরাতুন্নবী (৬৩ বছরের জীবনী) উম্মতের জন্য অনুসরণীয়-অনুকরণীয়। মহান আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘যদি তোমরা রাসূলকে অনুসরণ কর, তবেই তোমরা সত্যপথের সন্ধান পাবে’। (সূরা নূর: ৫৪)।
মহান আল্লাহপাক এরশাদ করেন, তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সূরা আল আহজাব : ২১)এ রাসূল (সা.) এর চরিত্র সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা আরো এরশাদ করেন, ‘আপনি অবশ্যই উত্তম চরিত্রের অধিকারী’। (সূরা কালাম : ৪০)। অন্য আয়াতে এরশাদ করেন, হে নবী আপনি বলুন, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস তবে আমাকে অনুসরণ করো, তাতে আল্লাহও তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপ মাফ করবেন’। (সূরা নূর : ৫৪)। যারা নবীর (সা.) বিরোধিতা করবে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, যারা নবী (সা.) এর আদর্শের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদের স্পর্শ করবে, যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদের গ্রাস করবে। (সূরা নূর : ৬৩)।
মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, যে কেউ আল্লাহর আনুগত্য করে এবং রাসূলের অনুসরণ করে, সে অবশ্যই মহাসাফল্য লাভ করবে’। (সূরা আহজাব : ৭১) সনবীজী বলেন, ‘আমার উম্মতের সকল লোকই জান্নাতী হবে, অস্বীকারকারী ব্যতিত। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) অস্বীকারকারী কে? উত্তরে রাসূল (সা.) বললেন, যে আমার অনুসরণ করবে সে বেহেশতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার নাফরমানী করবে সে অস্বীকারকারী’। (বুখারি : ৩১৮৭২)। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কে অনুসরণের অর্থ হলো; তাঁর আদর্শ গ্রহণ করা, ব্যক্তিগত ও ধর্মীয় জীবন থেকে নিয়ে সর্বক্ষেত্রে রাসূলের আদর্শ মেনে চলা। রাসূলের (সা.) অনুসরণ ব্যতিত ইহ-পরকালে নাজাত পাওয়া নিতান্তই দূরূহ ব্যাপার। রাসূল্লাহ (সা.) এর অনুসরণের মাঝেই সকল প্রকার সাফল্য নিহিত রয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও শিক্ষক।
মন্তব্য করুন