মহান বিজয় দিবস : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
এহসান বিন মুজাহির॥ ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। এ দিনটি বাঙালি জাতির বিশাল অর্জন ও গৌরবের। উনিশশ’ একাত্তর সালের ষোল ডিসেম্বর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দিনটি ছিলো বৃহস্পতিবার। পৌষের সেই পড়ন্ত বিকেলে তৎকালীন ঢাকার রেসকোর্স ময়দান বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিকেল সাড়ে ৪টায় পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক জোন-বি এবং ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর নেতৃত্বে ৯১ হাজার ৫৪৯ পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে। মেজর জেনারেল জ্যাকবের তৈরি করা আত্মসমর্পণের দলিলে বিকালে স্বাক্ষর করেন জেনারেল নিয়াজী ও লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। মুজিবনগর সরকারের পক্ষে এ সময় উপস্থিত ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। আর এ আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান ঘটে। জন্ম নেয় একটি নতুন স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ। এদিনের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার জন্য সমগ্র জাতি পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য শক্তি ও সাহস যোগায়। দু’হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে শাসন-শোষণ, গণহত্যা, নারীদের ইজ্জতহানি বাংলার মানুষকে বিষিয়ে তোলে এবং মুক্তির সংগ্রামকে বেগবান করে, মুক্তিকামী বাঙালির মরণপণ যুদ্ধই একমাত্র মুক্তির পথ। অবশেষে নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হয় অবসান।
গৌরবদীপ্ত ও দুর্বিনীত সাহসী জাতি হিসেবে আমাদের কাছে ষোল ডিসেম্বর গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। বছরের একটি মাত্র দিন হলেও জাতির মনে এক ভিন্নতর ভঙ্গি ও অনুভূতি শব্দায়মান হয়ে ওঠে। আলোকোজ্জ্বল এ দিনটি আমাদের সামগ্রিক জীবন ও ইতিহাসে এবং তার সত্তা ও স্বরূপকে পরিব্যক্ত ও পরিধৃত করে বিরাজ করছে বিস্ময়কর অভিভবে। যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতা, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা কতটুকু মূল্যায়ন করছি? মুক্তিযোদ্ধারা দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবেসেছিলেন। তাই নিজের জন্মভূমির জন্য জীবন উৎসর্গ করতেও পিছপা হননি। মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই বিভিন্ন সময় হতাশার সুরে বলেন, তাদের দেখার কেউ নেই। যারা জীবন বাজি রেখে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছেন এবং সূর্যসন্তান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন, তারা আজ বড় অসহায়। ১৯৭১ সালের মহান মুত্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষ জীবন উৎসর্গ করেছে। কিন্তু এখনো এই ত্রিশ লাখ শহীদের স্মৃতিকে সংরক্ষণ করা হয়নি। আজ প্রকৃত অনেক মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়েও চাহিদা মোতাবেক পাচ্ছেন না সরকারের সুযোগ-সুবিধা। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন, এমন অনেকে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে আসছেন। সন্তানদের চাকরির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটার সুবিধাও পাচ্ছেন তারা। এমনও অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যারা এখনও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো মর্যাদা পাননি। এছাড়া দেশের অনেক আলেম মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন, যাদের আজও রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না। আবার অনেকেই মুক্তিযোদ্ধার নাম ভাঙিয়ে নকল সার্টিফিকেট বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সব সুবিধা ভোগে তৎপর।
বিজয়ের ৪৯ বছর পরও যদি নতুন নতুন মুক্তিযোদ্ধা বাড়তেই থাকে, তাহলে বেঁচে থাকা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মানসম্মান ও কবরে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা নয় কি? পরিস্থিতি যদি এমন হয়, তাহলে অগণিত দেশপ্রেমিক শহীদের বিনিময়ে অর্জিত মহান বিজয়ের সফলতা ও সার্থকতা কোথায়? বিগত ও বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে এরই মধ্যে অনেক কিছু করেছে, তা অসত্য নয়। কিন্তু একটি মহল এ ব্যাপারে অনেক নেতিবাচক কর্মকা–ইতোমধ্যে ঘটিয়ে ফায়দা নিয়েছে, যা খুব দুঃখজনক। এমনটি তো কোনোভোবেই হতে পারে না। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়নে আরও দূরদর্শী উদ্যোগ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা জরুরি। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা আর না বাড়িয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা তৈরি করে তাঁদের যথাযথ মূল্যায়ন করা অতি জরুরি।
ব্যক্তিগত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বিষয় থাকে। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির আশায় মানুষ আমরণ অকাতরে নিরলসভাবে কাজ করে যায়। যার ফল বিলম্বে হলেও মানুষ ভোগ করতে পারে। আমাদের পরে স্বাধীন হওয়া অনেক দেশ আমাদের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। উন্নতি করেছে কাঙ্খিত মাত্রায়। তাই এ পর্যায়ে এসে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব কষা খুবই প্রাসঙ্গিক বিষয়। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানে উৎকর্ষতা, উন্নয়ন, শান্তি, সামাজিক নিরাপত্তা, সুশাসন, মানবিক মূল্যবোধ এবং জীবন যাত্রার মান উন্নয়ননের সূচকে বিজয়ের ৪৯ টি বছরে আমাদের অর্জনকে আজ মূল্যায়নের সময় এসেছে। কারণ ৪৯টি বছর কিন্তু কম সময় নয়। আর এই ৪৯টি বছরে আমাদের অর্জনকে যদি আজ নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন করি তাহলে দেখা যাবে আমাদের অর্জন খুব বেশি প্রত্যাশিত নয়!
বিজয়ের আজ ৪৯ বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বনির্ভর হতে পারেনি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মালেশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড আজ শিল্প উন্নয়ন বিশ্বের উদাহরণ। অথচ বাংলাদেশ পরনির্ভরশীল।
দেশে এখনো দারিদ্র্য তেমন কমেনি, মাথাপিছু ততটা আয় বাড়েনি। গরিবের মাথা গোঁজাবার ঘর নেই। নৈতিক শিক্ষা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি খেয়ে ফেলছে আমাদের বিবেক। বিজয়ের চার দশক পেরিয়ে গেল; এখনো আমরা সোনার বাংলা গড়তে পারিনি। গরিবদের ভাগ্যে উন্নতি হয়নি। দুঃখী, হতদরিদ্র মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে পারিনি। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে পারিনি। বেকারত্বের সংখ্য ক্রমাগত বেড়েই চলছে। রাজনৈতিক রেষারেষির বিষাক্ত ছোবলে দেশের জনগণ উৎকন্ঠিত। তবে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা ও যোগাযোগ আবকাঠামোতে ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। আগের তুলনায় মানুষের কর্মসংস্থানও অনেকটা বেড়ছে। এসব কিছুই প্রাপ্তির প্রাথমিক খতিয়ান। দুর্নীতি, জুলুম-শোষণমুক্ত ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা নিয়ে বিজয় অর্জিত হলেও সে প্রত্যাশা পূরণ আজও আমাদের হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উজ্জীবিত করতে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট হলে অচিরেই আমাদের এ চেষ্টা সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারবে ইনশাআল্লাহ। বিজয়ের হাসিতে উদ্ভাসিত হোক সকলের মুখ, বাংলাদেশের মহান বিজয়ের মাসে এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও শিক্ষক।
মন্তব্য করুন