মহিমান্বিত ঈদুল ফিতর: একটি তাত্ত্বিক আলোচনা

May 24, 2020,

মুফতি ফাহিম আল হাসান বর্ণভী॥ আনন্দের আবরণে ঢাকা একটি ইবাদাহ পবিত্র ঈদুল ফিতর। মাস জুড়ে সিয়াম সাধনার পর শাওয়ালের একফালি চাঁদের হাসির বাঁকে মহাপ্রাপ্তির আনন্দের বার্তা নিয়ে উপস্থিত হয় এই আনন্দঘন মুহুর্ত। আনন্দঘেরা ইবাদতে মহিমান্বিত করে প্রতিটি মুমীন হৃদয়।
ঈদ [عيد]আরবী শব্দ। এটি ‘আওদ’[عود] শব্দমূল থেকে উদ্ভূত। এর আভিধানিক অর্থ হল ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা, বার বার আসা।
মুসলমানদের জীবনে চান্দ্র বৎসরের নির্দিষ্ট তারিখে প্রতি বছরই দুটি উৎসবের দিন ফিরে আসে। তাই দিন দুটিকে ঈদ বলা হয়। ফিতর শব্দের অর্থ হলো ভেঙ্গে ফেলা, বিদীর্ণ করা। মুসলমানরা রমজানের চাঁদ দেখার সাথে সাথে রোজা রাখা আরম্ভ করে এবং শাওয়ালের চাঁদ দেখার সাথে সাথে রোজা ভেঙ্গে দেয় তথা রোজা রাখা ছেড়ে দেয়। সে কারণে এটিকে ঈদুল ফিতর তথা রোজা ভাঙ্গার আনন্দ বলা হয়।
আবার কারো কারো মতে ‘ফিতর’ শব্দ ফিতরা থেকে এসেছে। এই দিনে ধনী ব্যক্তিরা গরীবদেরকে ফিতরা দিয়ে তাদেরকে ঈদের আনন্দে শরীক করেন বলে এই দিনকে ‘ঈদুল ফিতর’ বলে।
আবার কারো কারো মতে, দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর রোজাদারগণ ঈদগাহে নামাজের জন্য এলে আল্লাহ তায়ালা পুরস্কার স্বরূপ রোজাদারগণকে একবাক্যে ক্ষমা ঘোষণা করেন। এই প্রাপ্তিটা তাদের জন্য মহানন্দের। বিশাল একটি প্রাপ্তি। যদ্দরুণ এই দিনটিকে ইয়াওমুল জাযা [প্রতিদান দিবস]ও বলা হয়। রোযাদারগণ রমযান পরবর্তী সিয়াম সাধনার এই প্রাপ্তির মহানন্দে মেতে উঠেন বলেই তাকে ঈদুল ফিতর বলা হয়।
ঈদুল ফিতরের সূচনা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিজরত করার পরবর্তী বছর অর্থাৎ হিজরী দ্বিতীয় বর্ষে রামাদ্বানে সিয়াম পালন করা ফরয হয়। [আল লু-লু ইল মাকনূন ফী সীরাতিন নাবিয়্যলি মা-মুন, ১/৩২২]
রাসূল (স.) হিজরত করে দেখতে পান মদিনাবাসী বছরে দুটি উৎসব পালন করছে। উৎসব দুটিতে তারা খেলা-ধুলাসহ তাদের প্রাচীন ঐতিহ্য লালন করছে। উৎসব দুটির একটির নাম নাইরোজ এবং অপরটির নাম মেহেরজান। নবী (স.) মুসলমানদের জন্য এদুটির পরিবর্তে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা নামক দুুটি পবিত্র উৎসব প্রবর্তন করেন। হযরত আনাস (রা.) বলেন, মদিনায় নবী (স.) হিজরত করে আসার পর দেখলেন, মদীনাবাসী দুদিন খুব আনন্দ উৎসব করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, এ দুদিনে তোমরা কী কর? তারা বললেন, আমরা জাহিলিয়্যাতের যুগে এদুটো দিন খেলাধুলা, আমোদফুর্তি করতাম। নবী (স.) বললেন, আল্লাহতায়ালা তোমাদের এ দুটো দিনের পরিবর্তে অন্য দুটি দিন প্রদান করেছেন। তার একটি হলো ঈদুল আযহারর দিন ও অপরটি হলো ঈদুল ফিতরের দিন [সনানু আবী দাউদ, হাদীছ নম্বর-১১৩৬, নাসাঈ, হাদিস নং ১৫৫৬]।
ঈদের নামাযে বিধান:
ঈদের নামাজের গুরুত্বের ব্যাপারে ইসলামী চিন্তাবিদগণ বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করেছেন। হানাফী মাযহাব অনুসারে ঈদের নামাজ ওয়াজিব , মালিকি ও শাফেয়ী মাযহাব অনুসারে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ এবং হাম্ববলী মাযহাব অনুসারে ঈদের নামাজ ফরজ। কোনো কোনো ইসলামী পণ্ডিতের মতে ঈদের নামাজ ফরজে আইন এবং কোনো কোনো ইসলামী পণ্ডিতের মতে ঈদের নামাজ ফরজে কেফায়া।
দ্বিতীয় হিজরীতে ঈদের নামায ওয়াজিব হয়। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, ঈদের নামায পড়ার বিধান নাযিল হওয়ার পর থেকে রাসূল (স.) মৃত্যু পর্যন্ত কোন বছরই কোন ঈদের নামায পড়া বাদ দেননি। তেমনি খুলাফায়ে রাশিদীনের কেউ তা বাদ দেননি। এর দ্বারা ঈদের নামায ওয়াজিব হওয়া প্রমাণিত হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে বর্জন করলে গুনাহাগার হবেঈদের নামাযের তারিখ:
রমজান শেষে ১ শাওয়াল ঈদুল ফিতরের নামায পড়া ওয়াজিব। তবে যুক্তিসঙ্গত ওজর থাকলে পরের দিন পড়া যাবে। অবশ্য ঈদুল আযহার নামায ওজর থাকলে পরবর্তী দুদিন পর্যন্ত পড়া জায়েয।
ঈদের নামাযের সময়:
সূর্য আনুমানিক তিন গজ পরিমাণ উপরে উঠার পর অর্থাৎ সূর্যোদয়ের ২৩/২৪ মিনিট পর থেকে দ্বি-প্রহরের পূর্ব পর্যন্ত ঈদের নামাযের ওয়াক্ত। সূর্য তিন গজ পরিমাণ উপরে উঠা পর্যন্ত সময়টুকুকে তার উদয়কাল বলে গণ্য করা হয়। এ সময়ে কোন নামায পড়া জায়েয নেই। ঈদুল আযহার নামায অপেক্ষাকৃত আগে এবং ঈদুল ফিতরের নামায কিছু বিলম্বে আদায় করা উত্তম। যেহেতু ঈদুল আযহার নামাযের শেষে কুরবানী দিতে হয়। সেজন্য ঈদুল আযহার নামায যথাশীঘ্রই আদায় করা উত্তম। [সম্পাদনা পরিষদ, ফাতওয়া ও মাসাইল, তৃতীয় খন্ড, ২য় সংস্করণ (ঢাকাঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৪১৫ হি./২০০৪ খ্রি.), পৃ. ৩৯৭]।
ঈদের নামাযের স্থান:
হযরত আবু সাঈদ আল খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (স.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন ঈদগাহে যেতেন এবং সকলকে সাথে নিয়ে ঈদের নামায পড়তেন।
নবী (স.) মসজিদে নববীতে ঈদের নামায না পড়ে সকলকে নিয়ে ঈদগাহে চলে যেতেন এবং সেখানে নামায আদায় করতেন। তাই আলিমদের মত হলো, ঈদগাহে নামায পড়া উত্তম। অবশ্য মসজিদে পড়ে নিলেও ঈদের নামায আদায় হয়ে যাবে, তবে বিনা ওজরে মসজিদে ঈদের নামায না পড়া ভাল। (প্রাগুক্ত)।
বৃষ্টির কারণে মসজিদে ঈদের নামায পড়া জায়েয আছে। হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার ঈদের দিনে বৃষ্টি হল, তখন রাসুল (স.) তাদেরকে নিয়ে মসজিদে ঈদের নামায পড়লেন। (আবু দাউদ, হাদীস নং-১১৬২)। এতে বুঝা যায়, বৃষ্টি বা অন্য কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকলে ঈদের নামায মসজিদে পড়া জায়েয।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ঈদের নামাযের বিধান ও প্রক্রিয়া:
বিরাজমান কোভিড১৯ করোনা ভাইরাসের প্রকোপে ধরাশায়ী আজ পুরো বিশ্ব। যার দরুণ ব্যাহত হচ্ছে দৈনন্দিন জীবনের সকল স্বাভাবিক কাযকর্ম। তাই বর্তমান পরিস্থিতির প্রতি লক্ষ্য রেখে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় কেবল মসজিদ ঈদের সালাত আদায় করার অনুমতি প্রদান করেছে। বিধায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে মসজিদে ঈদের সালাত আদায় করতে পারেন। বহির্বিশ্বের যেখানে ঈদের সালাত আদায় করার অনুমতি নেই সেখানে নিজেদের ঘরে পরিবারের সবাইকে নিয়ে সালাত আদায় করতে পারেন। সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদের ফতোয়া এটা। দারুল উলূম দেওবন্দও এই ফাতওয়া দিয়েছেন।
হযরত আনাস রাঃ একদা ঈদের সালাতের জামাত না পেয়ে নিজের ঘরে পরিবারের সদস্য ও গোলামদের নিয়ে জামাতে ঈদের সালাত আদায় করেছেন। তবে তিনি খুতবা দেননি।[আসারুস সুনান পৃ. ২২৭। বুখারীর সনদে বর্ণিত হাদীস নং ৯৭৬] তাই ঘরে ঈদের সালাত আদায় করলে খুতবা দেবেন না।

আর যদি একাকী থাকেন তবে ঈদের সালাত আদায় না করার পক্ষে স্কুল অব হানাফী থটের মত। ইবনে তাইমিয়া র. ও ইবনে উসাইমিন র. এ মত গ্রহণ করেছেন [শারহু মুমতী ৫/১৫৬]। ঈদের সালাত ছুটে গেলে ইবনে মাসউদ রাঃ এর বর্ণনা সূত্রে কিছু ফুক্বাহায়ে কেরাম চার রাকাত নফল সালাত আদায় করার কথাও বলেছেন।
মূল কথা হচ্ছে এগুলো কিয়াসী মাসআলা। এতে স্কলারদের মতভিন্নতা থাকতে পারে। এক্ষেত্রে করণীয় হল ঈদের সালাত সুযোগ থাকলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘরের বাহিরে জামাতের সাথে আদায় করবেন। না হলে ঘরে জামায়াতের সাথে আদায় করবেন। সেটা সম্ভব না হলে চার রাকাত নফল সালাত পড়তে পারেন। ওযরের কারণে কিছুই না পারলে আশাকরি আল্লাহ তায়ালা এরজন্য পাকড়াও করবেন না।
ঈদের দিনের ফযিলত:
ফিতরের দিন সকালে সকল ফিরিশতা রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে যান এবং মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন, হে মুসলিমগণ! তোমরা দয়ালু প্রতিপালকের দিকে এগিয়ে আস। উত্তম প্রতিদান ও বিশাল সাওয়াব প্রাপ্তির জন্য এগিয়ে আস। তোমাদের রাত্রিবেলার নামাযের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তোমরা সে নির্দেশ মেনে নামায পড়েছ। তোমাদেরকে দিনগুলোতে রোজা রাখতে বলা হয়েছিল, তোমরা সে নির্দেশও পালন করেছ, এক মাস রোজা রেখেছ। গরীব দুঃখীরদের পানাহারের মাধ্যমে নিজ প্রতিপালককে তোমরা পানাহার করিয়েছ। এখন নামায পড়ার মাধ্যমে সেগুলোর প্রতিদান ও পুরস্কার গ্রহণ কর। ঈদের নামায পড়ার পর ফিরিশতাদের মাঝে একজন ঘোষণা দেন, শোন, নামায আদায়কারীরা! তোমাদেরকে মহান রাব্বুল আলামীন মাফ করে দিয়েছেন, সকল গুনাহ থেকে মুক্ত অবস্থায় নিজ নিজ আবাসে ফিরে যাও। আর শোন! এ দিনটি হচ্ছে পুরস্কার প্রদানের দিন। আকাশে এ দিনের নামকরণ করা হয়েছে ‘পুরস্কারের দিন’। (আল মুজামুল কাবীর লিত তাবারানী, হাদীস নম্বর-৬১৭ ও ৬১৮)।
ঈদের দিন রোজাদারকে ক্ষমা ঘোষণা:
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা ঈদের দিন ফেরেশতাদের মাঝে রোজাদারদের নিয়ে গর্ব করে বলেন, ‘হে ফেরেশতারা আমার কর্তব্যপরায়ণ প্রেমিক বান্দার বিনিময় কী হতে পারে?’
ফেরেশতারা বলেন, হে প্রভু পুণ্যরূপে পুরস্কার দান করাই তো তার প্রতিদান। আল্লাহ বলেন, আমার বান্দারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব (রোজা) পালন করেছে। অতএব দোয়া করতে করতে ঈদগাহে গমন করেছে। আমার মর্যাদা, সম্মান, দয়া ও বড়ত্বের কসম আমি তাদের দোয়া কবুল করব এবং তাদেরকে মাফ করে দেব। (বায়হাকি : ৩/৩৪৩)।
ঈদের রাতের ফযীলত:
যে সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ দেখা যায় সে রাতকে ঈদের রাত বলা হয়। এ রাতের অনেক গুরুত্ব ও ফযীলতের কথা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। কয়েকটি হাদীস নিম্নে তুলে ধরা হলো।

১। হযরত আবু উমামা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী (স.) বলেন, যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে আল্লাহর নিকট সাওয়াব প্রাপ্তির নিয়তে ইবাদত করবে তার হৃদয় সেদিনও জীবিত থাকবে যেদিন সকল হৃদয়ের মৃত্যু ঘটবে। (ইবন মাজাহ, হাদীস নম্বর ১৭৮২, আল মুজামুল আওসাত, হাদীস নম্বর-১৫৯)।
২। হযরত উবাদাতা ইবন সামিত (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহার রাতকে (ইবাদতের মাধ্যমে) জীবিত রাখবে তার দিল ঐ দিন মরবে না যেদিন অন্যদের দিল মরে যাবে। (আত তারগীব ওয়াত তারহীব, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৯৮, হাদীস নম্বর-১৬৫৭)।
৩। হযরত মু‘আয ইবন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেন, যে ব্যক্তি পাঁচটি রাত (ইবাদতের মাধ্যমে) জাগ্রত থাকবে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। (এক). যিলহাজ্জ মাসের ৮ তারিখ রাত, (দুই). যিলহাজ্জ মাসের ৯ তারিখ রাত, (তিন). ঈদুল আযহার রাত, (চার). ঈদুল ফিতরের রাত এবং (পাঁচ). ১৫ শাবানের রাত। (আত তারগীব ওয়াত তারহীব, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৯৮, হাদীছ নম্বর-১৬৫৬)।
ঈদের দিনের সুন্নতসমূহ:
১.অন্যদিনের তুলনায় সকালে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া। (বায়হাকী, হাদীস নং-৬১২৬)
২.মিসওয়াক করা। (তাবয়ীনুল হাকায়েক-১/৫৩৮)
৩.গোসল করা। হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) দুই ঈদের দিন গোসল করতেন। (মুসনাদে বাযযার, হাদিস: ৩৮৮০)
ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত যে, তিনি ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন। (মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হাদিস: ৬০৯)
৪.শরীয়তসম্মত সাজসজ্জা করা।(বুখারী, হাদীস নং-৯৪৮)
৫.সামর্থ অনুপাতে উত্তম পোশাক পরিধান করা। ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত যে তিনি দু ঈদের দিনে সুন্দরতম পোশাক পরিধান করতেন। ( বায়হাকী : ১৯০১)
৬.সুগন্ধি ব্যবহার করা।(মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস নং-৭৫৬০)
৭.ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাবার আগে মিষ্টিজাতীয় যেমন খেজুর ইত্যাদি খাওয়া। তবে ঈদুল আযহাতে কিছু না খেয়ে ঈদের নামাযের পর নিজের কুরবানীর গোশত আহার করা উত্তম।বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) ঈদুল ফিতরের দিনে না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদুল আজহার দিনে ঈদের নামাজের পূর্বে খেতেন না। সালাত থেকে ফিরে এসে কুরবানীর গোশত খেতেন। (আহমদ : ১৪২২) আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন কয়েকটি খেজুর না খেয়ে বের হতেন না, আর খেজুর খেতেন বে-জোড় সংখ্যায়। (বুখারী : ৯০০)
৮.সকাল সকাল ঈদগাহে যাওয়া। (আবু দাউদ, হাদীস নং-১১৫৭)
৯.ঈদুল ফিতরে ঈদগাতে যাওয়ার পূর্বে সদকায়ে ফিতর আদায় করা। ইবনু উমর (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সা.)লোকদেরকে ঈদের নামাজের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বেই সাদকাতুল ফিৎর আদায় করার নির্দেশ দেন।(বুখারী, হাদীস নং-১৪২১)
১০.পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া। আলী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : সুন্নত হল ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া। (তিরমিযী : ১৮৭ )
১১.ঈদের নামায ঈদগাহে আদায় করা, বিনা অপরাগতায় মসজিদে আদায় না করা। (বুখারী, হাদীস নং-৯৫৬, আবু দাউদ, হাদীস নং-১১৫৮)
১২.যে রাস্তায় ঈদগাতে যাবে, সম্ভব হলে ফিরার সময় অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরা। (বুখারী, হাদীস নং-৯৮৬)
১৩.ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাবার সময় আস্তে আস্তে এই তাকবীর পড়তে থাকাঃ
اللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَاللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ وَلِلَّهِ الْحَمْدُ
তবে ঈদুল আযহায় যাবার সময় পথে এ তাকবীর আওয়াজ করে পড়তে থাকবে। (মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস নং-১১০৫)
“ঈদ মোবারাক” বলা হয়, এর শরয়ী বিধান
ঈদের দিন আনন্দ প্রকাশ করা, দান সদকা করা ও মোবারাকবাদ জানানো মুস্তাহাব। তবে মোবারাকবাদ জানানোর জন্য “ঈদ মোবারাক” শব্দ নির্ধারন করা, একই শব্দ সবসময় ব্যাবহার করা, বা “ঈদ মোবারাক” শব্দটি দিয়েই মোবারাকবাদ জানাতে হবে এমন মনে করা ঠিক নয়। তা মাকরুহ হবে, কেউ কেউ বিদাআত বলেছেন। তাই সতর্ক থাকা উচিত ৷
ﺗﻘﺒﻞ ﺍﻟﻠﻪ ﻣﻨﺎ ﻭﻣﻨﻜﻢ، ﻋﻴﺪﻛﻢ ﻣﺒﺎﺭﻙ, عيد سعيد
উচ্চারন: তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম, ঈদুকুম মোবারাক, ঈদুন সাঈদুন ৷
এ ধরনের শব্দ দিয়ে মোবারাকবাদ জানানো যাবে ৷
মোবারাকবাদের স্বপক্ষে সাহেবে হুলিয়া সহিহ সনদে অনেক আসারে সাহাবা এনেছেন। যার দ্বারা বুঝা যায় তা সাহাবাগন থেকে প্রমানিত ৷ তাই তা মুস্তাহাব ৷–ফতহুল বারী২/৪৪৬;রদ্দুল মুহতার, ১/৭৭৭, ফতওয়ায়ে রহিমিয়া ১/২৮১৷
فعن جُبَيْرِ بْنِ نُفَيْرٍ قَالَ : كَانَ أَصْحَابُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا اِلْتَقَوْا يَوْمَ الْعِيدِ يَقُولُ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ : تَقَبَّلَ اللَّهُ مِنَّا وَمِنْك . قال الحافظ : إسناده حسن .
وقَالَ الإمام أَحْمَدُ رحمه الله : وَلا بَأْسَ أَنْ يَقُولَ الرَّجُل لِلرَّجُلِ يَوْمَ الْعِيدِ : تَقَبَّلَ اللَّهُ مِنَّا وَمِنْك . نقله ابن قدامة في “المغني” .
وسئل شيخ الإسلام ابن تيمية في “الفتاوى الكبرى” (২/২২৮) : هَلْ التَّهْنِئَةُ فِي الْعِيدِ وَمَا يَجْرِي عَلَى أَلْسِنَةِ النَّاسِ : ” عِيدُك مُبَارَكٌ ” وَمَا أَشْبَهَهُ , هَلْ لَهُ أَصْلٌ فِي الشَّرِيعَةِ , أَمْ لا ؟ وَإِذَا كَانَ لَهُ أَصْلٌ فِي الشَّرِيعَةِ , فَمَا الَّذِي يُقَالُ ؟ফতহুল বারী২/৪৪৬;রদ্দুল মুহতার, ১/৭৭৭, ফতওয়ায়ে রহিমিয়া ১/২৮১
ফতওয়ায়ে রহিমিয়া ১/২৮১৷
ঈদের দিনে কিছু করণীয় :
ক) নিজ পরিবার-পরিজনের সাথে সময় অতিবাহিত করা এবং উত্তম উপদেশ দেয়া। যা পারিবারিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করে।
খ) আত্মীয়-স্বজন, মাতা-পিতার সাথে দেখা করা ও খোঁজ-খবর নেয়া।
গ) পাড়া প্রতিবেশী, গরীব-অসহায় নির্বিশেষে সকলের সাথে মিশা, তাদের খোঁজ খবর নেয়া ও কুশল বিনিময় করা।
ঘ) সম্ভব হলে পরস্পরকে দাওয়াত দেয়া এবং আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা।
ঙ) ঝগড়া, বিবাদ, কলহ, হিংসা, বিদ্বেষ ভুলে সবার সাথে মোলাকাত আলিঙ্গন ও একাকার হয়ে যাওয়া।
চ) জীবন মানে সময়ের যোগফল। অর্থহীন কাজে সময় ব্যয় করা ও টিভির অনুষ্ঠান দেখার নামে মূল্যবান জীবন শেষ করা থেকে বিরত থাকা ও বিরত রাখা। বিশেষ করে নিজেকে ও নিজের পরিবার পরিজনকে।
ঈদের দিনের বর্জনীয় দিকসমূহ
১. জামাতের সাথে ফরজ সালাত আদায়ে অলসতা করা ২. ঈদের দিন সিয়াম পালন করা ৩. বিজাতীয় আচরণ প্রদর্শন করা ৪. নারী-পুরুষ একে অপরের বেশ ধারণ করা ৫. নারীদের খোলামেলা অবস্থায় রাস্তাঘাটে বের হওয়া ৬. গান-বাজনা করা, অশ্লীল সিনেমা ও নাটক দেখা ৭. অযথা কাজে সময় ব্যয় করা ৮. অপচয় ও অপব্যয় করা ৯. আতশবাজি করা ১০. ঈদের সালাত আদায় না করে কেবল আনন্দ-ফূর্তি করা ইত্যাদি।
পরিশেষে বলতে চাই, ঈদের দিনের শরীয়তসম্মত করণীয়গুলো পালন ও বর্জনীয়গুলো পরিত্যাগ করার মাধ্যমে নিজেকে একজন খাটি মুমীন হিসেবে আবিষ্কার করি। আল্লাহর নৈকট্যলাভে সচষ্ট হই। আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবুল করুন। আমিন।
ﺗﻘﺒﻞ ﺍﻟﻠﻪ ﻣﻨﺎ ﻭﻣﻨﻜﻢ، ﻋﻴﺪﻛﻢ ﻣﺒﺎﺭﻙ, عيد سعيد
صلى الله تعالى على خير خلقه محمد و على اله و صحبه اجمعين.
লেখক: প্রাবন্ধিক

সংবাদটি শেয়ার করতে নিচের “আপনার প্রিয় শেয়ার বাটনটিতে ক্লিক করুন”

মন্তব্য করুন

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com