মহিমান্বিত রজনী শবে বরাত
এহসান বিন মুজাহির॥ মহিমান্বিত একটি রজনী হলো পবিত্র শবে বরাত। বিশুদ্ধ হাদিসে এর প্রমাণ বিদ্যমান। রাসুলুল্লাহ (সা.) এই রাতকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ (শাবান মাসের ১৫তম রাত) বলে উল্লেখ করেছেন।
হযরত আসিম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবি বকর তার পিতার সনদে দাদা হযরত আবুবকর (রা.) থেকে বর্ণনা করেন রাসুল (সা.) এরশাদ করেন-‘আল্লাহ তায়ালা শাবানের ১৫তম রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং সকল পাপীকে (যারা ক্ষমা প্রার্থনা করে) ক্ষমা করে দেন। তবে ‘মুশরিক’ (আল্লাহর সাথে সমকক্ষ সাব্যস্তকারী) ও ‘মুশহিন’ (হিংসুক) ব্যতিত। (-বায়হাকি ফি শুয়াবিল ঈমান)
হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.), আবু সালাম আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা), আবু মুসা আশআরী (রা.) আবু হুরায়রা (রা.), আবুবকর (রা.), আউফ ইবনে মালিক (রা.) ও হজরত আয়েশা (রা.) সকলেই এ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। হাদিস বিশারদগণ ঐ হাদিসের রাবীদেরকে ছেক্বাহ তথা বিশ্বস্ত বলেছেন। মূল কথা হাদিসটি ‘সহীহ’। (সহি ইবনে হিব্বান, আত তারগীব ওয়াত তারহীব ২ খ, পৃ. ১১৮, মাজমাউল ফাওয়ায়ীদ খ- ৮, পৃষ্ঠা ৬৫, মুসনাদে বাযযার খ- , পৃষ্ঠা ৬৭)
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন একদা হযরত রাসুল (সা.) আমাকে বলেন-হে আয়েশা! তুমি কী জান, ‘লাইলাতুন নিছফি মিন শা’বান’ বা শবে বরাতে কি সংঘটিত হয়? তদুত্তরে আমি বললাম, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুলই ভালো জানেন। তখন আমি রাসুলের কাছে জানতে চাইলাম এ রাতে কি কি সংঘটিত হয়? তখন রাসুল (সা.) বললেন মহান আল্লাহপাক এ রাতে আগামী এক বছরে কতজন সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, কতজন লোক মৃত্যুবরণ করবে তা লিপিবদ্ধ করেন। আর এ রাতে বান্দার (এক বছরের) আমলসমূহ মহান আল্লাহ তা’য়ালার নিকট পেশ করা হয় এবং এই রাতেই বান্দার (এক বছরের) রিযিকের ফায়সালা হয়’। (বাইহাকি, ইবনে মাজাহ ও মিশকাত শরীফ)
হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা). এরশাদ করেন- ‘যখন অর্ধশাবানের রাত তথা শবে বরাত উপস্থিত সমুপস্থিত হবে তখন তোমরা ঐ রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত-বন্দেগী করবে এবং দিনের বেলায় রোজা রাখবে। কেননা ১৫তম রাতে আল্লাহ তা’য়ালা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। সন্ধ্যা থেকে নিয়ে সূর্যাস্তপূর্ব পর্যন্ত ঘোষাণা করতে থাকেন কেউ আছো কি ক্ষমা প্রার্থনাকারী? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব, জীবিকার সন্ধানী কেউ আছ কী? আমি তাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে জীবিকা দান করবো। কেউ কী বিপদগ্রস্ত আছো? আমি তাকে বিপদমুক্ত করবো। এভাবে আল্লাহ তায়ালা ঊষাকাল পর্যন্ত বান্দার চাহিদা পূরণ করার জন্য আহবান করতে থাকেন। (মিশকাত শরীফ, ইবনে মাজাহ)
হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, একদা আমি রাসুলের (সা.) সাথে কোনো এক রাতে রাত যাপন করছিলাম। এক সময় উনাকে বিছানায় না পেয়ে আমি মনে ধারণা করলাম যে, তিনি হয়ত অন্য কোনো উম্মুল মু’মিনীনের হুজরা শরীফে তাশরীফ নিয়েছেন। আমি তালাশ করতে লাগলাম, কিন্তু কোনো বিবির ঘরেই যাননি! অতঃপর হুজুরকে জান্নাতুল বাক্বীতে পেলাম। দেখলাম সেখানে তিনি উম্মতের জন্য মহান আল্লাহপাকের দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। এ অবস্থা দেখে আমি স্বীয় হুজরা শরীফে ফিরে এলাম। কিছুক্ষণ পর তিনিও ফিরে এলেন এবং বললেন, তুমি কী মনে করেছো আমি তোমার সাথে খিয়ানত করেছি? আমি বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)! আমি ধারণা করেছিলাম যে, আপনি হয়তো অন্য কোনো উম্মুল মু’মিনীনের হুজরা শরীফে তাশরীফ নিয়েছেন। অতঃপর হুযুর পাক (সা.) বললেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাপাক শা’বানের ১৫ তারিখের রাতে পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন। অতপর তিনি ‘বনী কালবের’ মেষের গায়ে যত পশম রয়েছে তার চেয়ে বেশি সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে থাকেন’। (বুখারিও তিরমিজ)
শবে বরাত রজনীতে করণীয়: সারারাত জাগ্রত থেকে ইবাদত-বন্দেগী করতো পরদিন অর্থাৎ ১৫তম দিনে নফল রোজা রাখার চেষ্টা করা। তবে বাধ্যতামূলক নয়। এই রোজা মুস্তাহাব। নিজের যাবতীয় গোনাহের জন্য তাওবাহ করে রাব্বুল আলামিনের দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করা। নিজের মনের নেক আশা-আকাঙ্খা পূরণের জন্য ও মৃতদের মাগফিরাতের জন্য বেশি বেশি করে দোয়া করা। নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আযকার, দোয়া-দুরূদ, তাওবাহ-ইসতিগফার, দান-সদকা, উমরি ক্বাযা নামাজ, কবর জিয়ারতসহ ইত্যাদি নফল আমলের মাধ্যমে রাতগুজার করা। তবে মাকবারে তথা কবরে যাওয়া জরুরি নয়। কবর জিয়ারতকে রুসম বা রেওয়াজ পরিণত করা যাবে না। কারণ রাসুল (সা.) চুপিসারে একাকী জান্নাতুল বাকিতে কবর জিয়ারত করেছেন। আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)- কে নিদ্রা থেকে জাগ্রত করেননি এবং পরবর্তীতেও কবর জিয়ারত করার কথা বলেননি। তবে দলবদ্ধ ছাড়া একাকীভাবে কবর জিয়ারতে কোনো বাধা নেই। আনুষ্ঠানিকতা ও জামাত ছাড়া একাকীভাবে সামর্থানুযায়ী নফল ইবাদত-বন্দেগী করা। মসজিদে গিয়ে সমবেতভাবে ইবাদতের জরুরত নেই। যে সকল ইবাদত নামাজ জামাতে ও সমবেতভাবে আদায় করার প্রচলন রাসুল থেকে প্রমাণিত রয়েছে তা জামাতে আদায় করা। বাকীগুলো একাকীভাবে করা। আল্লাহ তা’য়ালা নফল ইবাদতকে একাকিত্বে আদায় করাই বেশি ভালোবাসেন। ইখলাছের সাথে স্বল্প আমল ঐকান্তিতাহীন অধিক আমল থেকে উত্তম।
বর্জণীয়: শবে বরাতের আলাদ কোনো নামাজ নেই। নির্দিষ্ট সূরা দিয়ে নির্দিষ্ট রাকাত পড়ার রেওয়াজ ইসলামে নেই। শবে বরাত উপলক্ষে হালওয়া রুটি, তাবারুকের আয়োজন, রাতে মসজিদে অতিরিক্ত আলোকসজ্জ্বা করা, মরিচলাইট, তারাবাতি, আধুনিক নয়ানাভিরাম বর্ণিল বাতির ঝাড়ে দিগদিগন্ত পল্লাবিত করা, আগরবাতি, মোমবাতি, গোলাপজল পটকা, আতশবাজি, রাস্তা-হাটবাজারে যুবকদের আড্ডা, অশুচি প্রতোযোগিতা এসকল কাজ নিন্দনীয়। এসকল কাজের কোনো ভিত্তি শরীয়তে নেই। এগুলো অবশ্যই বর্জনীয়। এসকল কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিকতার পিছনে পড়ে শবেবরাতের মূল উদ্দেশ্য ব্যহত হয়ে যায়। এসকল গর্হিত কুসংস্কার থেকে বিরত থাকতে হবে। এহসান বিন মুজাহির : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
মন্তব্য করুন