মাতৃভাষা খোদার সেরা দান
এহসান বিন মুজাহির॥ বাঙালি জাতির গৌরবের মাস ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের ৮ ফালগুন বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ স্লোগাান নিয়ে রাজপথে লড়েছিলেন। মাতৃভাষাকে বাংলা করণের দাবিতে বায়ান্নের একুশে এ সবুজের গালিচা রক্তে-রঙিন হয়েছিল। রাষ্ট্রভাষাকে বাঙলা করার জন্য দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী লড়াই করতে হয়েছে দামাল ছেলেদের। রাজপথে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে আব্দুস সালাম, রফিক, বরকত, আব্দুল জব্বার, শফিউর রহমান ও রফিক উদ্দিনসহ আরও অজানা অনেক তরুণ প্রাণ বিসর্জন করে শহীদের তালিকায় তাদের শামিল করেন। ৫২’ সালের ৮ ফালগুন তথা ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য রক্ত ঝরা জলন্ত একটি সাক্ষী। ’৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কোর ৩১তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে একুশ ফেব্রুয়ারিকে ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১৮৮ টি দেশে প্রতি বছর যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয় ২১ ফেব্রুয়ারি। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। মাতৃভাষা আমাদের অহঙ্কার। বাঙলা ভাষার জন্য বাঙালী মায়ের সন্তানেরা বুকের টাটকা রক্তের বিনিময়ে লাল হরফে সর্ব প্রথম লিখেছিল বাঙলা বর্ণমালা। তাদের প্রাণের মুল্য আমরা কতটুকু শোধ করতে পেরেছি? ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কী ভুলিতে পারি’। বিখ্যাত কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা এই গানটি ঠাঁই পেয়েছে বাংলা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে-‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি? ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু গড়া এ আমি কি ভুলিতে পারি! এ গানটি গেয়ে আমরা দেশ প্রেমিক শহীদদের স্মৃতিচারণ করি। এ গান পরিবেশন, খালি পায়ে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন, ভোরে শহীদ মিনারে গমন একর্মসূচির মাধ্যমে আমরা যেসব কর্মকান্ড করি এসবের মাধ্যমে কবরে থাকা ভাষা শহীদের আত্মা কতটুকু প্রশান্তি পাবে? ভাষা শহীদদের প্রাণের মূল্য আমরা কতটুকু শোধ করতে পেরেছি? শিক্ষা ও মর্যাদার ক্ষেত্রে বাংলাদেশেই বাংলার পরিবর্তে ইংরেজিকে দ্বিগুণ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা, ¯ু‹ল-কলেজ সর্বত্রই ইংরেজির ছড়াছড়ি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মাতৃভাষা বাংলার পরিবর্তে ইংরেজিকেই প্রাধান্য দেয়ার প্রবণতাবেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলা ভাষা আজ দেশের উচ্চশিক্ষিতদের ভাষা নয়! বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও বক্তব্যের দ্বারা মাতৃভাষার গুরুত্ব বোঝানোর প্রবণতাও খুব লক্ষণীয়! কিন্তু কাজকর্মে বাংলা ভাষাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। এমনকি ছোট শিশুদেরও বাংলা ভাষা না শিখিয়ে শুরুতই ইংরেজি ভাষা (মাম্মি, ডেড, আঙ্কেল, আন্টি) ইত্যাদি শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। বাঙালি নিজেদের সার্থক হিসেবে পরিচয় দিতেও লজ্জাবোধ করেন। অথচ কত বাঙালি বাংলার জন্য প্রাণ দিতেও দ্বিধাবোধ করেননি। অনেকেই মাতৃভাষা বাংলার জন্য শহীদ হয়েছেন। শুধু ভাষা দিবস এলেই আমরা ভাষার গান, ভাষার পক্ষে আলোচনা, শহীদ মিনারে নীরবতা, পুষ্পস্তবকসহ রকমারি আয়োজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি দিবসটিকে। আফসোস! ভাষার মাসেও কেঁদে ওঠে ভাষা শহীদের আত্মা! শুধু একুশের আনুষ্ঠানিকতা সেরেই কি আমাদের দায়িত্ব শেষ? তা না হলে বছরজুড়ে বাংলা ভাষার প্রতি এতো অবহেলা কেন? এসব কি বাংলা ভাষার প্রতি চরম অবজ্ঞা নয়? বাংলা ভাষা মায়ের ভাষা। মাতৃভাষা খোদার সেরা দান। এ ভাষা আমাদের গৌরবের। বাংলা ভাষাকে সর্বক্ষেত্রেই গুরুত্ব দিতে হবে। এ ব্যাপরে বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিক পর্যটক ইবনে খালেদুন বলেন-‘প্রত্যেক শিক্ষাই তার মাতৃভাষায় হওয়া চাই, কেননা অপরিচিত ভাষার মাধ্যমেই শিক্ষা দান ও অর্জন অসম্পূর্ণ শিক্ষারই নামান্তর’। বাংলা সাহিত্যের দিকপাল আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) বলেন, ‘মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা করা জাতি হত্যারই নামান্তর’। বাংলা ভাষা সম্পর্কে আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ:) বলেন-‘বাংলাদেশের শতকরা ৯৫% মানুষ মুসলমান। এ দেশের ভাষাও বাংলা অতএব ওলামায়ে কেরামগণ বাংলা সম্পর্কে বিশাল জ্ঞান অর্জন করতে হবে’। আসুন আমরা সকলেই নবচেতনায় আত্মনিয়োগ করি। সর্বক্ষেত্রে বাংলাকে মুল্যায়ন করি। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় এগিয়ে আসি।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও প্রিন্সিপাল, শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুল, মৌলভীবাজার
মন্তব্য করুন