মাথাভারী নয়, জনবান্ধব করাই মূল চ্যালেঞ্জ
ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ : বিদায়ি সরকারের সময়ও মাথাভারী প্রশাসন নিয়ে নানা মহলে উদ্বেগ দেখা গিয়েছিল। ২২ সেপ্টেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে জনপ্রশাসনে অনুমোদিত সংখ্যার চেয়ে প্রায় দেড় গুণ বেশি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে জ্যেষ্ঠ সচিব ও সচিব করা হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্মসচিব পদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা দুই গুণ ছাড়িয়ে গেছে। এর ফলে অতিরিক্ত কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বাবদ একদিকে প্রশাসনিক ব্যয় হুহু করে বেড়েছে; অন্যদিকে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি দেওয়ায় পদবঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। ৮ আগস্ট অন্তর্র্বতী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা সামনে আসতে শুরু করেন। পদোন্নতি-পদায়নের দাবিতে অনেকে বিক্ষোভ করেছেন, এমনকি বিষয়টি কেন্দ্র করে সচিবালয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে হাতাহাতির মতো ঘটনাও ঘটেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিদায়ি সরকারের রাজনৈতিক বিবেচনায় গড়ে তোলা মাথাভারী প্রশাসন আরও ভারী হতে চলেছে কি না?
নিয়ম অনুযায়ী কোনো কর্মকর্তা অবসরে গেলে বা পদ শূন্য হলে স্বাভাবিকভাবেই নিচের পদের যোগ্য কাউকে পদোন্নতি দিতে হয়। প্রশাসনের এ পিরামিড আকৃতিকে কল্পনা করেই মূলত ব্যবস্থাপনা করতে হয়। কিন্তু বিগত কোনো সরকারই তা আমলে না নেওয়ায় পিরামিড এখন গেছে উল্টে। অন্তর্র্বতী সরকার দায়িত্বে আসার পর প্রশাসনের উপসচিব থেকে সচিব পর্যায়ে প্রায় পাঁচশ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এমন গণপদোন্নতিতে অনেকাংশেই ভেঙে পড়েছে প্রশাসনের পিরামিড। প্রশাসনের সাংগঠনিক কাঠামো বোঝাতে যে পিরামিড চিত্রায়িত হয়, তাতে নিচ থেকে ওপরের দিকে কর্মকর্তার সংখ্যা কমতে থাকে। কিন্তু দেশের প্রশাসনে এখন উল্টো চিত্র বিরাজ করছে। নিম্নস্তরে কর্মকর্তার চরম সংকট থাকলেও পিরামিডের উচ্চ-মধ্যম পর্যায়ে কর্মকর্তার সংখ্যা অনুমোদিত পদের দু-তিন গুণ বেশি। পদ ফাঁকা না থাকলেও অপরিকল্পিতভাবে পদোন্নতি দেওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বাস্তবতার নিরিখে অন্তর্র্বতী সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি তা না করা যায় তাহলে সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ দেখা দিতে পারে।
প্রশাসনে পিরামিডের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য নিচের দিকের পদগুলো পূরণ করতে হয়। এজন্য একাধিক বিসিএস পরীক্ষা হয়েছে। অসংখ্য শিক্ষিত বেকার রয়েছে দেশে। তাদের কর্মসংস্থানের অভাব এখন একটি বড় সংকট। এ শিক্ষিত বেকারদের প্রশাসনের শূন্যপদে বসিয়ে প্রশাসনকে স্থিতিশীল করার পাশাপাশি বেকারত্ব দূর করার সুযোগ রয়েছে। অতীতে প্রশাসনে দলীয়ভাবে চিহ্নিত করে অনেক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিবের মতো পদে তারা যেতে পারেননি। যখন সরকারের প্রভাবে দলীয়করণ বেশি হয়ে যায় তখন প্রশাসনে কোনো পেশাদারিত্ব থাকে না। একটি রাজনৈতিক দলের এ দলীয়করণের কারণে প্রশাসনে অনেকেই চাকরি পাননি। অন্তর্র্বতী সরকার আসার পর তারা মিটিং করেছেন, নানা দাবি উত্থাপন করেছেন।
অন্তর্র্বতী সরকার ক্ষমতায় বসার পর আগের অনেক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের পাশাপাশি বেশ কয়েকজন সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডিও করা হয়েছে কিছু কর্মকর্তাকে। এতে সচিবের সংখ্যা কিছুটা কমে এখন ৭৪-এ নেমে এসেছে। অন্যদিকে জনপ্রশাসনে অতিরিক্ত সচিবের অনুমোদিত পদের সংখ্যা ২১২ রাখা হলেও এখন কাজ করছেন দ্বিগুণের বেশি কর্মকর্তা। সরকারি কর্মচারী ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির (জিইএমএস) হিসাবে, বর্তমানে কর্মরত অতিরিক্ত সচিবের সংখ্যা প্রায় ৫৪৬। একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে যুগ্মসচিব পদটির ক্ষেত্রেও। সরকার অনুমোদিত ৫০২টি পদের বিপরীতে প্রশাসনে এখন যুগ্মসচিব হিসেবে কাজ করছেন ১ হাজার ১৪৭ জন।
প্রশাসনে এমন অনেকেই আছেন যারা রাজনৈতিক কিংবা দলীয়করণের কারণে পদোন্নতি পাননি। অনেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন এবং এখনও বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে অনেকে কর্মক্ষেত্রে যোগ দেওয়ার আশায় ঘুরছেন। প্রশাসনে অস্থিতিশীলতার কারণে অন্তর্র্বতী সরকার বাধ্য হয়ে পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনে পদোন্নতি দিতে বাধ্য হয়েছে। প্রশাসনের পিরামিডটা উল্টে যাওয়ার আরেকটি কারণ রয়েছে। নিচের দিকের খালি পদ পূরণ করা দরকার মূলত সরকারি চাকরির পরীক্ষা থেকে বাছাই করা প্রার্থী দিয়ে। এখন পর্যন্ত ৪৪, ৪৫ ও ৪৬ বিসিএসের প্রার্থীরা অপেক্ষারত। পিএসসি এখনও ৪৪তম বিসিএসের নির্বাচিতদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিতে পারেনি। এ বিষয়ে সরকার কোনো সবুজ সংকেত দেয়নি। অন্যদিকে ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার খাতা দেখা শেষ হয়নি। আর ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হলেও লিখিত পরীক্ষার কোনো ঘোষণা আসেনি। বিষয়টি সংকটে পরিণত হচ্ছে যার সমাধান করা জরুরি। শুধু তাই নয়, ৪৪তম বিসিএস পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস কিংবা অনিয়মের সুষ্ঠু তদন্ত এখনও সম্পন্ন হয়নি।
প্রশাসনে মুক্তিযোদ্ধা কোটার ব্যবহার নিয়েও রয়েছে কিছু প্রশ্ন। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কিংবা নাতিনাতনিরা কোটার মাধ্যমে কতটা সুযোগসুবিধা পেয়েছেন তা আমাদের জানা নেই। এ বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। অথচ এ কোটাটিই সরকারি চাকরিতে বড় অংশ ধরে রেখেছিল। বিগত সরকারের আমলে প্রশাসন মাথাভারী হয়েছে আবার নিচের দিকের অনেকে পদোন্নতি পাননি। একজন এসপি প্রায় ১০ বছর ধরেই স্বপদে চাকরি করছেন। তার কোনো পদোন্নতি হয়নি। এ মাথাভারী প্রশাসন অন্তর্র্বতী সরকারের জন্য অবশ্যই একটি বড় সংকট ও সমস্যা। প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ আরেকটি বড় সমস্যা। অন্তর্র্বতী সরকারও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে। যদিও তারা বলেছিল চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বন্ধ করা হবে। কিন্তু দেখতে হবে তারা কাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছেন। এখন যাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে তাদের ২০১৩ সালে নির্বাচনের আগে বিএনপিপন্থি বলে প্রশাসন থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। আবার বিদায়ি সরকার অনেককে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই পদচ্যুত করেছিল।
যুগ্মসচিব বা অ্যাডিশনাল জয়েন্ট সেক্রেটারি হিসেবে যারা চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন তাদের সিনিয়র সচিব হিসেবে এখন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যদি রাজনৈতিক কারণে তাদের হেনস্থার শিকার হতে না হতো তাহলে তারা সুষ্ঠুভাবে অবসরে যেতে পারতেন। প্রথম দিকে সিনিয়র সচিব পদে চার-পাঁচ জন থাকলেও পরে এ পদের সংখ্যা ১৭-১৮ করা হয়। সচিবরা গ্রেড ওয়ান স্কেলের হয়ে থাকেন। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মধ্যে ২৫ শতাংশ শিক্ষক এ গ্রেড পেতে পারতেন। কিন্তু বিদায়ি সরকার সচিবদের অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়ায় শিক্ষকরা বৈষম্যের শিকার হন। পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি এ সমস্যার সমাধান করবেন। সচিবদের সুপার গ্রেডে রেখে এবং শিক্ষকদের গ্রেড-১-এ রেখে অনেকটা পদাবনতই রাখা হলো। এ বৈষম্য দূর করতে না পারা সরকারের একটি বড় ব্যর্থতা।
প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দীর্ঘদিন সরকারের তলপিবাহক করে রাখা হয়েছিল। নিয়োগ, পদোন্নতিও হয়েছে এই আঙ্গিকেই। এখন সংস্কারের উত্তম সময় এসেছে। প্রশাসনকে স্থিতিশীল করারও সুযোগ রয়েছে। অনেক শিক্ষিত বেকার কাজ করতে আগ্রহী। তাদের মেধা ও দক্ষতা কাজে লাগাতে হবে। আমরা দেখেছি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন সরে গেছে। পিএসসিকে আবার নতুন করে সাজানো খুব জরুরি। বিশেষত অতীতের সব অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত করতে হবে। প্রার্থীদের দ্রুত নিয়োগের জন্যও আধুনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের এখন পুরোনো পদ্ধতিতে পড়ে থাকলে চলবে না। বরং পিএসসিকে আরও কার্যকর করতে হবে। তারা যেন পরীক্ষার্থীদের দ্রুত নিয়োগ দিতে পারে এবং প্রশাসনে শূন্যপদগুলো দ্রুত পূরণ হয় সে ব্যবস্থা করতে পারে। এজন্য পিএসসির সংস্কার জরুরি। প্রশাসনেও স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষত প্রশাসনে পূর্বতন অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত করে সংস্কারের কাজটি করতে হবে।
প্রশাসনের স্বাভাবিক কাঠামো ফিরিয়ে আনার কথা ভাবতে হবে। এমনটি করতে না পারলে ক্ষতি হবে সরকারের এবং জনগণও সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত হবে। জনপ্রশাসন জনবান্ধব করাই মূল চ্যালেঞ্জ। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কথা কম হয়নি বটে কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ হয়নি। তা না হওয়ার পেছনে মূল অন্তরায় কী ছিল এ নিয়ে এ নিবন্ধেই বলেছি। কিন্তু এখন পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে জনবান্ধব জনপ্রশাসন গড়তে কাঠামোগত সংস্কারসহ যা কিছু করার তা করতে হবে বৃহৎ জনস্বার্থে, সময় ক্ষেপণ না করে। দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলার জন্য মেধাতালিকা প্রাধান্য দিতে হবে। মেধাতালিকার পাশাপাশি সিনিয়রিটিও বিবেচ্য বিষয়। মেধা ও সিনিয়রিটির সমন্বয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া করা জরুরি। জনপ্রশাসনে যিনি দায়িত্ব পাবেন তিনি রাজনীতিসচেতন হবেন কিন্তু রাজনীতিপরায়ণ হবেন না। রাজনীতিপরায়ণতা রোধ করা গেলে জনপ্রশাসন আরও গতিশীল হবে। রাষ্ট্রের জনগণকে চাহিদার নিরিখে সেবা প্রদানই হবে তাদের একমাত্র লক্ষ্য। একজন ছাত্রজীবনে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতেই পারেন। কিন্তু পরবর্তী জীবনে জনপ্রশাসনে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের উন্নতির স্বার্থে তিনি তার মেধা নিয়োগ করতে পারেন এবং জনগণকে তাদের কাঙ্ক্ষিত সেবা পৌঁছে দিতে পারেন। অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই রাজনীতি ও প্রশাসন সমন্বয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়ন ও জনসেবা নিশ্চিতকরণের দায়িত্ব পালন করে ।
মন্তব্য করুন