মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা
সায়েক আহমদ॥ বর্তমান সময়টা এমন পর্যায়ে চলে এসেছে যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটুকু নিরাপদ তা যথেষ্ট চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনা টেস্টে পজিটিভ রিপোর্ট হওয়ার পরও গণভবনে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন ডাক বিভাগের মহাপরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্র যিনি এসএস ভদ্র নামেই পরিচিত। গত ১৪ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৫তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ স্মারক ডাকটিকিট, ডেটা কার্ড উন্মোচন ও বিশেষ খামের উদ্বোধনী কাজে তিনি গণভবনে গিয়েছিলেন। একটি ছবিতে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেবিলে বসে উদ্বোধনী খাম, স্মারক ডাকটিকিট এবং ডেটা কার্ড উন্মোচন কাজে স্বাক্ষর করছেন আর নীল শার্ট পরা সুধাংশু শেখর ভদ্র পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) করা সুধাংশু শেখর ভদ্রের করোনা পরীক্ষার রিপোর্টে তিনি ওইদিন করোনা পজিটিভ ছিলেন। অথচ নিয়ম অনুযায়ী তখন তার আইসোলেশনে থাকার কথা ছিল। কিন্তু সেটা না করে তিনি গণভবনে গিয়েছিলেন।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) করা সুধাংশু শেখর ভদ্রের করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে জানা যায় তার নমুনা নেয়া হয়েছে ১২ আগস্ট। করোনা টেস্টের রিপোর্ট দেয়া হয়েছে ১৩ আগস্ট। সেখানে স্পষ্টভাবে করোনা পজিটিভ হিসেবেই তার রিপোর্ট লেখা হয়েছে।
সুধাংশু শেখর ভদ্র ১৩ আগস্ট, বৃহস্পতিবার করোনার পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পান বলে জানা গেছে। এর পরদিনই তিনি গণভবনে গিয়েছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়ানোর ছবিতে দেখা যায় সাধারণ একটি সার্জিক্যাল মাস্ক মুখে এবং একটি ক্যাপ মাথায় দিয়ে অন্যদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন এসএস ভদ্র। অন্যদিকে কথা বলার সুবিধার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখের মাস্কটি ছিল নামানো।
এ ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তখন ছিলেন বিরাট ঝুঁকির উপর। কারণ যে কোন মুহূর্তে তিনি করোনায় আক্রান্ত হতে পারতেন। যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করোনায় আক্রান্ত না হয়ে থাকেন, তাহলে ধরে নিতে হবে যে, জাতির উপর হতে একটা বিরাট টেনশন নেমে গেছে। কারণ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দেশবাসী প্রাণভরে ভালবাসেন। তাঁর ক্ষতি হবে এমন কোন কারণ দেশবাসী মেনে নিতে পারে না।
ছবিটা দেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কিছু প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে।
প্রথমত, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে মি. ভদ্র গেলেন ১৪ আগস্ট। করোনা টেস্ট করালেন ১২ আগস্ট। রিপোর্ট পেলেন ১৩ আগস্ট। তাহলে তিনি রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর এ ঝুঁকি নিয়ে কেন গেলেন গণভবনে? তিনি কি জানতেন না তার জন্য দেশের বিরাট একটা ক্ষতি হয়ে যেতে পারত?
সবচেয়ে মজার কথা, প্রধানমন্ত্রীর করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার যখন বিরাট ঝুঁকি দেখা যাচ্ছে, ঠিক ঐ সময়েই এসএস ভদ্রের পাশে দাঁড়িয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। তিনি বলেন, ‘আইইডিসিআরের দেয়া রেজাল্ট শিটে ১৩ তারিখ উল্লেখ থাকলেও আমরা কেউই ১৩ আগস্ট রিপোর্ট পাইনি। আমরা রিপোর্টটি হাতে পেয়েছি ১৪ আগস্ট বিকালে। গণভবনে অনুষ্ঠানটি ছিল ১৪ আগস্ট সকালে।’ ১৩ তারিখ সকালে আইইডিসিআর ল্যাবটি নষ্ট ছিল বলে রেজাল্ট দেরিতে এসেছে বলেও উল্লেখ করেন মন্ত্রী। এ বিষয়ে মন্ত্রী আরও জানান, ‘একটি ল্যাব যে কোনও সময় নষ্ট হতেই পারে। কিন্তু সেটি মেরামতের পরপরই সঠিক রিপোর্ট দেবে- এমন সিদ্ধান্তে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া ঠিক নয়। ভুলও তো হতে পারে। আমি বলছি না যে ভদ্রকে দেয়া আইইডিসিআরের রেজাল্ট ভুল। কিন্তু রিপোর্ট ভুল হওয়ার তো রেকর্ড আছে আইইডিসিআরের। এ জন্যই আমি তাকে আবারও অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানে টেস্ট করাতে বলেছি।’
অথচ আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা জানিয়েছেন কোভিড সিচুয়েশনে আইইডিসিআরের ল্যাব কখনও বন্ধ বা নষ্ট ছিল না। যদি আইইডিসিআরের পরিচালকের বক্তব্য সঠিক থাকে তাহলে মন্ত্রীর বক্তব্য অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। তিনিও একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী হয়ে করোনা রিপোর্ট হাতে না পেয়ে কীভাবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলেন? আইইডিসিআরের তথ্য হতে জানা যায়, করোনা রিপোর্ট এসেছে ১৩ আগস্ট। তাহলে একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী হয়ে তিনি কেন ১৩ আগস্ট রিপোর্টটি সংগ্রহ করলেন না। মনে করা হল, হয়ত কোন কারণবশত তিনি রিপোর্ট হাতে পাননি, তাহলে করোনা রিপোর্ট না পেয়ে তিনিই বা কীভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করার মত দুঃসাহস দেখালেন। ১৪ আগস্ট মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করার কথা, এটা তো আর তাৎক্ষণিক প্রোগ্রাম নয়- অবশ্যই কয়েকদিন আগেই প্রোগ্রামটি চূড়ান্ত করা হয়েছিল। তাহলে কেন তিনি ১২ আগস্ট করোনা টেস্ট করাতে গেলেন। কেন আরো কয়েকদিন আগে করোনা টেস্ট করাতে গেলেন না? যদি একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী হয়েও তিনি এমন কাণ্ড করতে পারেন, তাহলে অন্যরা কী করবে? আবার তিনি এসএস ভদ্রের পক্ষে সাফাই গাচ্ছেন, এটাও তো মন্ত্রী হিসেবে বিস্ময়কর ব্যাপার! এর আগে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন কামরান যুক্তরাজ্য হতে দেশে এসে সরাসরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। অথচ এর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এ থেকেই বুঝা যায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, বিস্ময়কর ব্যাপার এখানেই শেষ নয়। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এসএস ভদ্রের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে আরো বলেছেন, ‘আমিসহ ডিজি একই সঙ্গে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে করোনা টেস্টের জন্য নমুনা জমা দেই। ১৪ তারিখ বিকালে আমরা সেই নমুনার রেজাল্ট হাতে পাই। তাতে আমি নেগেটিভ এবং ডিজি পজিটিভ হন। ডাক বিভাগের ডিজির কোনও উপসর্গও ছিল না। তিনি যদি কোনও অনুমানও করতেন যে করোনা পজিটিভ হতে পারেন, তাহলে ভদ্র নিজেই ওই অনুষ্ঠানে যাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখতেন বলে আমি বিশ্বাস করি। ডিজি দিনরাত মিলিয়ে করোনাকালে অফিস করেছেন, নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্বশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। তার ওপর আমার আস্থা রয়েছে। এটি আমার মন্ত্রী হিসেবে তার সম্পর্কে অভিমত।’
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী এসএস ভদ্রের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে নিজেরই দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে তিনি কেন করোনা রিপোর্ট না পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলেন। তার করোনা রিপোর্ট নেগেটিভের পরিবর্তে যদি পজিটিভ আসতো তাহলে তিনিও কি দায় থেকে অব্যাহতি পেতেন? আবার তিনি নিজেই বলছেন ১৪ তারিখ বিকালে নমুনার রেজাল্ট হাতে পেয়েছেন। অথচ তিনি ঐদিন সকালেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করার মত অবিবেচকের কাজ করেছেন। তিনি আরোও বলেছেন ডাক বিভাগের ডিজির কোনও উপসর্গও ছিল না। তাহলে প্রশ্ন হল, উপসর্গ না থাকা সত্ত্বেও কেন ডাক বিভাগের ডিজি এবং তিনি নিজে করোনা টেস্ট করাতে গেলেন। কেন আরো কয়েকদিন আগে করোনা টেস্ট করালেন না?
তৃতীয়ত, মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার আরো বলেন, ‘ভদ্রের করোনার কোনো উপসর্গও ছিল না। তিনি দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে নেগেটিভ রিপোর্ট পেয়েই ওই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। আসলে আমাদের আইইডিসিআরের কাছে পরীক্ষার জন্য যাওয়া উচিত হয়নি। সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানের মেয়ের রিপোর্ট নিয়ে কী ঘটনা ঘটেছে, তা আমাদের সবার জানা।’
জানা গেছে, গণভবনে যাওয়ার শর্ত হিসেবে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের সঙ্গে সুধাংশু শেখর ভদ্র গত ১৩ আগস্ট তিন প্রতিষ্ঠানে করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দেন। এর মধ্যে ডিএনএ ও ল্যাবএইড থেকে ওই দিনই তাঁদের নেগেটিভ রিপোর্ট আসে। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে তাঁরা ১৪ আগস্ট সকালে গণভবনে যাওয়ার অনুমতি পান। কিন্তু ১৪ আগস্ট বিকেলে আইইডিসিআর থেকে রিপোর্ট আসে সুধাংশু শেখর ভদ্র করোনা পজিটিভ। এরপর কেন করোনা পজিটিভ থাকা অবস্থায় তিনি গণভবনে গিয়েছিলেন, কারণ দর্শাতে বলা হয় তাঁকে। অফিস করতেও বারণ করা হয়। নির্দেশ দেওয়া হয়, আবারও পরীক্ষা করানোর। সেই নির্দেশ অনুসারে গত ১৬ জুন আবার পপুলারে নমুনা দেন। গত ১৯ আগস্ট বিকেলে রিপোর্ট আসে তিনি নেগেটিভ, করোনা আক্রান্ত নন।
আইইডিসিআরের রিপোর্ট যদি পজিটিভ হয় এবং অন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট যদি নেগেটিভ হয় তাহলে কোনটা ধরা উচিত? এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং করোনা বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘অবশ্যই আইইডিসিআরের রিপোর্ট গ্রহণযোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য। একটা নমুনার যদি একাধিক পরীক্ষা হয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক রিপোর্ট নেগেটিভ হয়ে কোন একটাতেও যদি পজিটিভ রিপোর্ট হয় তাহলে পজিটিভ রিপোর্টই গ্রহণযোগ্য। সেটা আইইডিসিআর না হলেও, সেটাই ভ্যালিড বলে ধরতে হবে এবং এটাই নিয়ম।’
তাহলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার প্রশ্নে অনেক প্রশ্ন সামনে চলে আসে। আইইডিসিআরের রিপোর্ট যদি গ্রহণযোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য হয় তাহলে মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার কেন বলেন, ‘আইইডিসিআরের কাছে পরীক্ষার জন্য যাওয়া উচিত হয়নি। সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানের মেয়ের রিপোর্ট নিয়ে কী ঘটনা ঘটেছে, তা আমাদের সবার জানা।’
যদি মন্ত্রীর কথা সত্য হয়, তাহলে আইইডিসিআরের মত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে কেন শুদ্ধি অভিযান চালানো হচ্ছে না? তারা যদি সঠিক রিপোর্ট প্রদান করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে জনগণের আস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
চতুর্থত, ডাক বিভাগের মহাপরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্র করোনা পজিটিভ নিয়ে গণভবনে গিয়েছিলেন, নাকি আইইডিসিআরের রিপোর্টটাই ভুল ছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। চতুর্থ টেস্টের রিপোর্টেও তাঁর করোনা নেগেটিভ এসেছে। সর্বশেষ জানা গেছে ২০ আগস্ট থেকে তিনি অফিস করতে পারবেন।
তাহলে সারাংশটা কী দাঁড়ালো? এর মানে হচ্ছে আইইডিসিআরের রিপোর্ট ভুল। যদি আইইডিসিআরের রিপোর্ট ভুল হয়ে থাকে, তাহলে এর শাস্তি কে বহন করবে? যেখানে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সেখানে এসব ভানুমতির খেল কেন হচ্ছে? কেন মন্ত্রী থেকে সরকারি কর্মকর্তা পর্যন্ত দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেবেন? কেন ভুলের দায় কেউ নেবে না? কেন তদন্তসাপেক্ষে দোষী সনাক্তকরণ করা হবে না? আইইডিসিআরের রিপোর্ট ভুল হলে কেন আইইডিসিআরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেন আরো নিñিদ্র হবে না? কে দেবে এসব প্রশ্নের উত্তর?
[সায়েক আহমদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ০১৭১২৯৬২৩৯৩]
মন্তব্য করুন