মানসম্মত শিক্ষা ও বিদ্যমান কোচিং ব্যবসা
মোহাম্মদ আবু তাহের॥ বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে, বাংলাদেশের অগ্রগতি অপ্রতিরোধ্য। চরম দারিদ্র দূর করা, সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু মৃত্যু রোধ করা সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক সাফল্য অর্জন করেছে। দেশ এমডিজি অর্জনে ভালো করেছে। এখন, দেশের প্রায় শতভাগ ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। এখন মেয়েদের আর অধ:স্থন ভাবা হয় না। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে। এভারেস্ট থেকে জাতীয় সংসদ সর্বত্র রয়েছেন নারীরা। অফিস-আদালতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েই চলছে। লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক জিপিএ ৫ এর সংখ্যাও লাখ ছাড়িয়ে যায়। এটি আমাদের একটা বড় শক্তি। আমাদের জনসংখ্যার বেশীর ভাগই তরুণ। পৃথিবীর কিছু কিছু দেশ আছে যাদের জনসংখ্যাই এক কোটির নীচে। যেমন- ডেনমার্কের জনসংখ্যা ৫৬ লাখ, আইসল্যান্ডের ৩ লাখ ৩০ হাজার, ফিনল্যান্ডের ৫৪ লাখ। দেশের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের মেধার চূড়ান্ত বিকাশ ঘটাতে হলে, পৃথিবীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে, প্রকৃত মানবসম্পদে পরিণত করতে হলে মানসম্পন্ন শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীদের শুধু জিপিএ ৫ অর্জন করার প্রতিযোগীতায় উদ্বুদ্ধ করা যাবে না। মনে রাখতে হবে মানুষ এক আশ্চর্য সম্ভাবনার নাম। বাস্তব জীবনে জিপিএ ৫ পাওয়া আর না পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে কে বেশী প্রতিষ্ঠিত মানুষ হবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। বিল গেটস এর একটি উক্তি উদ্ধৃত করছি: “আমি হার্ভার্ডে কয়েকটি বিষয়ে ফেল করেছিলাম আর আমার এক বন্ধু সব বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিল। আমার সে বন্ধুটি এখন আমার প্রতিষ্ঠানে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি করেন। শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র জিপিএ ৫ এর প্রতিযোগীতায় ঠেলে না দিয়ে দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জনের দিকে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশের বিদ্যমান ব্যবস্থায় তা কাঙ্খিত পর্যায়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে দামি পণ্য হলো শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষ বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই মাদ্রাসা শিক্ষা গ্রহণ করে। দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষের জন্য রয়েছে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা। এ শিক্ষা শুরু হয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। গ্রাম ও শহরের খেটে খাওয়া মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, কুলী-মজুরদের সন্তানরা এসব স্কুলে পড়তে আসে। গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন কৃষক, সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ব্যবসায়ীদের সন্তানরা কিন্ডার গার্টেনে শিক্ষা গ্রহণ করে। এদেরকে বলা হয় মধ্যবিত্ত। আর ধনী ও ক্ষমতাবানদের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করে বিদেশী সিলেবাসের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। শিক্ষা নাগরিকের মৌলিক অধিকার হলেও বৈষম্যহীনভাবে সকল নাগরিক সমানভাবে অধিকার ভোগ করতে পারে না। গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা কোচিং নির্ভর ও ব্যয়বহুল হওয়ায় সাধারণ মানুষ এক ধরণের বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “জীবসত্বার ঘর থেকে মানবসত্বার ঘরে উঠার মই হচ্ছে শিক্ষা”। কিন্তু আমাদের সমাজে অন্যায়, অবিচার, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদের তান্ডব দেখে মনে হয় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেও অনেকেই জীবসত্বার মধ্যে আবদ্ধ। অন্যায়, অসত্য আর অমঙ্গলের চিন্তা থেকে যতদিন পর্যন্ত আমরা মুক্ত হতে পারবো না ততদিন আমাদের জীব হয়েই থাকতে হবে। আমরা মানবসত্বায় পৌঁছাতে পারব না। সেজন্য আমাদের সন্তানরা শুধু এ প¬াস পেলেই চলবে না। জীবনবোধটাও এ প¬াস হতে হবে। শিক্ষা সম্পর্কে পৃথিবীর অন্যতম সেরা রাষ্ট্রনায়ক নেলসন ম্যান্ডেলার একটি অমর বাণী হলো, “ঊফঁপধঃরড়হ রং ঃযব সড়ংঃ ঢ়ড়বিৎভঁষ বিধঢ়ড়হ যিরপয ুড়ঁ পধহ ঁংব ঃড় পযধহমব ঃযব ড়িৎষফ.” ম্যান্ডেলার অমর বাণী যথার্থ হবে তখনই যখন শিক্ষা সত্যিকারের মানসম্পন্ন শিক্ষা হবে।
সার্টিফিকেট সর্বস্ব শিক্ষা ব্যক্তির প্রয়োজনে যতটুকু আসে, ততটুকু সমাজের প্রয়োজনে আসে না। সার্টিফিকেট সর্বস্ব শিক্ষায় শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য মানুষ গড়ার কাজ বাধাগ্রস্থ হয়। ফলে ক্ষমা, সহিষ্ণুতা, প্রেম-ভালোবাসা, নীতি-নৈতিকতা, পরোপকার, বিনয়, উদারতা ইত্যাদি গুণাবলীর বিকাশ ঘটে না। এতে করে সামাজিক অশান্তি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, হত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদি অমানবিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ৬ মে ২০১৭ জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মশালায় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর কথা বলতে গিয়ে বলেন, “ জিপিএ ৫ বেড়েছে, ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছে। আমি ক্লাসে গিয়ে তাদের জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমরা কতজন জিপিএ ৫ পেয়েছ? প্রায় ৮০ ভাগ শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে গেল। তো একজনকে বললাম আমি ৮০ ভাগ নম্বর পেয়ে জিপিএ ৫ পেয়েছি এটা ইংরেজিতে বল। বলতে আর পারল না।” এখান থেকে সহজেই অনুমেয় আমাদের লেখাপড়ার মান। দেশের কোচিং বাণিজ্য ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। সরকারি সূত্রেই বলা হয়েছে শিক্ষা ব্যয়ের ৩০ শতাংশই ব্যয় হচ্ছে কোচিং এর পেছনে। পরিসংখ্যান ব্যুরো পরচিালিত জরিপ থেকে জানা গেছে একজন শিক্ষার্থী বছরে তার শিক্ষার পেছনে যে টাকা ব্যয় করে তার মধ্যে ৩০ শতাংশ চলে যায় কোচিং আর হাউজ টিউটরের ফি বাবদ। খাতাপত্র ও টিফিন ফি বাবদ ব্যয় হয় ১৬ শতাংশ। টিউশন ফিতে ১০ শতাংশ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইউনিফরম খাতে ৯ শতাংশ অর্থ ব্যয় হচ্ছে।
মূলত: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত লেখাপড়া না হওয়ার কারনেই শিক্ষার্থীরা ঝুঁকে পড়ছে কোচিং সেন্টার এর দিকে। দেশের প্রাথমিক থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাঙ্খিত মানসম্পন্ন লেখাপড়া হচ্ছে না। হাতে গোনা কিছু বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া বেশীর ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই বিরাজ করছে শিক্ষক সংকট সহ নানাবিধ সমস্যা। অনেক শিক্ষক ক্লাসে যথাযথ মনযোগ না দিয়ে শিক্ষার্থীদের কোচিং সেন্টারের প্রতি আকৃষ্ট করারও অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষাবিদ সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বক্তব্য হচ্ছে দেশে কোচিং বাণিজ্যের কারনে একটা অশুভ ও দুষ্ট চক্র তৈরী হয়েছে। এরা দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। কোচিং বাণিজ্য শুধু শহরেই নয় গ্রামেও বিস্তৃত হচ্ছে। বছর পাঁচেক আগে কোচিং বন্ধে হাইকোর্ট থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও একটি নীতিমালা জারী করা হয়েছিল প্রায় ৫ বছর পূর্বে। বর্তমানে শিক্ষকদের বেতনভাতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন আর শিক্ষকদের বাড়তি আয়ের দিকে মনযোগ না দিলেও চলবে। মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষকদের বলা হয় এঁৎফরধহ ড়ভ ঃযব পরারষরুধঃরড়হ, অৎপযরঃবপঃ ড়ভ ঃযব হধঃরড়হ. শিক্ষকদের ছাত্রছাত্রীদের প্রতি দায়িত্বশীল হতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে শেখার আনন্দ সৃষ্টি করতে হবে। টাকার পেছনে ছোটার মানসিকতা তাদের পরিহার করতে হবে। শিক্ষকরা দায়িত্বশীল হলে, ব্যবস্থাপনায় উন্নত হলে, বাণিজ্যিক মানসিকতা প্রশ্রয় না পেলে শিক্ষার মানোন্নয়ন হবেই। লেখাপড়ার মানের ব্যাপারে কোথাও যেন কোনো আপোষ না করা হয় সেজন্য সরকারের সংশি¬ষ্ট কর্মকর্তা, ম্যানেজিং কমিটি, সচেতন অভিভাবক, জনপ্রতিনিধিসহ সচেতন নাগরিক সমাজের কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন।
বিশ্ব ব্যাংকের মতে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারে। লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে ২০৫০ সালে প্রবৃদ্ধির বিচারে বাংলাদেশ পশ্চিমা দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ বিভিন্ন সূচকে এগিয়েছে। এ উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে হলে, বিশ্ব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে, জাতির প্রত্যাশিত উন্নয়ন ও সার্বিক সমৃদ্ধির জন্য সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ হওয়ার জন্য নৈতিক শিক্ষার উপরও জোর দিতে হবে। পাশাপাশি মেধাবী শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে হবে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা শুধু তাদের পরিবারেরই নয়, তারা দেশ ও জাতির সম্পদ। সমাজ ও দেশের স্বার্থে মেধাবীদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশেষ কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার বলে মনে করি। প্রতিবছরই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর হত দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত সদস্য মেধাবীদের উচ্চ শিক্ষা নিয়ে শংকা প্রকাশ করার বিষয়টি সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানা যায়। শত সহস্র প্রতিক’লতার মাঝে হাজারো বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে শত অভাবের মাঝেও সহায় সম্বলহীন অনেক শিক্ষার্থী সবাইকে তাক লাগিয়ে জিপিএ ৫ ও গোল্ডেন জিপিএ ৫ পায়। চমৎকার কৃতিত্ব অর্জন করেও এদের অনেকেই উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না। রাষ্ট্রের নাগরিকগণ মেধাবীদের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। হত দরিদ্র অদম্য মেধাবীদের বিনামূল্যে অথবা স্বল্পমূল্যে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরী বলে মনে করি। লেখকব্যাংকার ও কলামিষ্ট এবং সভাপতি শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়ন ফোরাম, মৌলভীবাজার।
মন্তব্য করুন