মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ও জনগণকে অভিনন্দন
মোহাম্মদ আবু তাহের॥ মালয়েশিয়ায় নির্বাচনে বিস্ময়কর বিজয়ের পর মালয়েশিয়ার সপ্তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১০ মে ২০১৮ শপথ নিয়েছেন ৯২ বছর বয়সী মাহাথির মোহাম্মদ। মাহাথিরের ব্যতিক্রমধর্মী যাপিত জীবনের ক্ষেত্রে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার পংক্তিমালা স্মরণ করা যেতে পারে “ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধ মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা”। মাহাথিরকে ঘা মেরে বাঁচাতে হয়নি। তিনিই হলেন ৯২ বছরের তরুণ। তিনিই হলেন সবুজ, নবীন,কাঁচা,অবুঝ সকলের প্রেরণার উৎস। পৃথিবীর সর্বস্তরের নবীন প্রবীন মানুষদের জন্য এক আলোকবর্তিকা। রবীন্দ্রনাথের আর একটি কবিতা ‘কবির বয়স’ তাতে তিনি বলেছেন-
“কেশে আমার পাক ধরেছে বটে,
তাহার পানে এত নজর কেন?
পাড়ায় যত ছেলে এবং বুড়ো
সবার আমি এক বয়সী জেনো।”
এই কবিতার পংক্তিমালা সত্য প্রমানিত হয়েছে মাহাথিরের এই অসাধারন বিজয়ে। বিশ্বের প্রবীন নবীন সকল মানুষকে উজ্জীবিত ও উদ্দীপ্ত করেছে এই বিজয়। পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে যখন গোটা বিশ্বেই আলোচিত শব্দ ঈযধহমব ঠিক তখনই মালয়েশিয়ার উন্নতির পথে নিয়ে যাওয়া মাহাথির এবারের সাধারন নির্বাচনে নিজের সাবেক দলের বিরুদ্ধে লড়েছেন।
যে দলের নেতা হিসেবে বিজয়ী হয়ে ২২ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন বিরোধী দলের নেতা হিসেবে সে দলেরই প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাককে ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়ে দিলেন। মাহাথিরের এই বিজয়ের মাধ্যমে মালয়েশিয়ার বারিসাস ন্যাশিওনাল (বিএন) জোটের ৬১ বছরের শাসনের অবসান হয়েছে। ১৯৫৭ সালে বৃটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এ জোট একটানা দেশটির ক্ষমতায় ছিল। এখন বিরোধী জোট থেকে নির্বাচিত হয়ে এসে নতুন করে মালয়েশিয়াকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবেন, মালয়েশিয়ানদের পাশাপাশি বিশ্বের মানুষ সেটাই প্রত্যাশা করে বলে মনে করি। মালয়েশিয়ার হাজার হাজার মানুষ মাহাথিরের শপথ উপলক্ষে প্রাসাদ অভিমুখী রাস্তায় লাইন ধরে দাঁড়িয়ে দলীয় পতাকা হাতে উল্লাস করেছে। উইলিয়াম শেক্সপীয়ার এর একটি মহামূল্যবান উক্তি মাহাথির এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, উক্তিটি হলো “ঝড়সব ধৎব নড়ৎহ মৎবধঃ, ংড়সব ধপযরবাব মৎবধঃহবংং ধহফ ংড়সব যধাব ঃযরৎংঃ ঁঢ়ড়হ ঃযবস.”
ডঃ মাহাথির মোহাম্মদের জন্ম ১৯২৫ সালের ১০ জুলাই মালয়েশিয়ার উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর অ্যালোর সেটরে। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সেখানকারই একটা নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারে পিতা মোহাম্মদ ইস্কান্দারের নয় সন্তানের মধ্যে মাহাথির ছিলেন সবার ছোট। মাহাথিরের পিতা প্রথম জীবনে একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি একজন সরকারি অডিটর হিসেবে কাজ করেছেন। তার পিতা শৃঙ্খলাপরায়ণ একজন মানুষ ছিলেন। মাহাথিরও ছেলেবেলা থেকেই অত্যন্ত সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করছেন। মাহাথির এর মা গৃহিনী ছিলেন, তিনি ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। ছোটকাল থেকেই তিনি মাহাথিরকে বাসায় পবিত্র কুরআন শিক্ষা দিতেন। মাহাথির ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিলেন। এই মাহাথিরই বিশ্ব কাঁপালেন। শেষ বয়সে এসে নিজেরই তৈরী করা দল আর সিস্টেমের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে জোট বাঁধলেন চিরশত্রু আনোয়ার ইব্রাহিমের সাথে। বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বের দৃষ্টি ছিল তাই মালয়েশিয়ার দিকে শেষ জীবনে এসে প্রথম জীবনের সব অর্জন সব কৃতিত্ব ম্লান হয়ে যায় কি না এমন আশংকাও করেছেন অনেকে। কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সব হিসাব নিকাশ নিজের নিয়ন্ত্রনে এনে অসাধারণ জয় তুলে নিলেন। আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার খ্যাত মাহাথির মোহাম্মদ এর সাথে আনোয়ার ইব্রাহিমের ঐক্য হবে এই ভাবনা কারও ছিলনা। কিন্তু রাজনীতির জন্য দেশের উন্নয়নের জন্য রাজনীতিতে শেষ কথা নেই তিনি প্রমান করে দিলেন। মাহাথির এর প্রতি মালয়েশিয়ার মানুষের অন্যরকম ভালবাসা ছিল। সেজন্য প্রায় ৯৩ বছর বয়সী নেতাকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করেছেন। মূল কথা হলো তার দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান, আইনের শাসন ও ন্যায়পরায়নতা। যে কোন দেশে আইনের শাসন না থাকলে মানুষের মন জয় করা অত্যন্ত কঠিন। মাহাথির আজকের আধুনিক মালয়েশিয়ার স্বপ্নদ্রষ্টা। এক সময়ের অনুন্নত মালয়েশিয়াকে উন্নত বিশ্বের তালিকায় এনছেন মাহাথির। এশিয়ার এই নন্দিত নেতা বিশ্ববরেন্য নেতা হিসেবে নিজের স্থান করে নিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মধ্য দিয়ে মাহাথির এক বিরল বেকর্ড করেছেন। তাকে বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে বয়স তার কাছে হার মেনেছে। তিনি রাজনীতির জাদুকর, নতুন ইতিহাস রচয়িতা, রেকর্ড ভাঙ্গার কারিগর ইত্যাদি। মাহাথির মোহাম্মদ এমন একজন ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে অবসর গ্রহন করেছেন যা মুসলিম বিশ্বের অন্য কোন রাষ্ট্রনায়কের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। ক্ষমতা ছেড়েও তিনি দর্শন ভিত্তিক জীবন চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। তিনি তাঁর দেশ মুসলিম বিশ্ব এবং মানবজাতি নিয়ে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করেছেন। রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর মাহাথিরের খুব আগ্রহ ছিল। এজন্যই মালয়েশিয়ার উন্নয়নে শিক্ষার ভূমিকা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়। মাহাথির শুধু একজন সফল প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি একজন সার্থক মানুষ। নীতি ও আদর্শে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যতিক্রমী প্রধানমন্ত্রী বলতেই হবে মাহাথির মোহাম্মদকে। তিনি ছিলেন ইসলামের একনিষ্ট অনুসারী। তার পরিবার তাকে ইসলামের ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখার শিক্ষা দিয়েছে। কিন্তু এতে কোনধরনের গোঁড়ামী ছিলনা। ইসলাম সম্পর্কে তিনি নিজের লেখায় বলেছেন, ইসলাম ধর্ম আমাদের জীবনের অংশ। একে পরিত্যাগ করার কোন কারন নেই। সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা হলে ধর্ম কখনো অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য বাধা হতে পারে না। তিনি সাধারন মানুষের মনে আলাদা একটি জায়গা করে নিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষও মাহাথির মোহাম্মদকে ভালবাসেন। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে একটি আত্মীক সম্পর্ক রয়েছে মাহাথিরের। মাহাথিরের দাদার বাড়ি চট্রগ্রামে। মাহাথির তার এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেছেন ইব্রাহিমকে ক্ষমা করে দেবেন। এটি তার রাজনৈতিক ঔদার্য ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বলতে হবে। মাহাথির স্বীকার করেছেন তিনি ইব্রাহিমকে ফেলে দিয়ে ভুল করেছিলেন। এখানেও তাঁর উদার মনের পরিচয় পাওয়া যায়। আব্রাহাম লিংকন একবার বলেছিলেন যদি আমাদের পরিস্থিতি নতুন থাকে অবশ্যই আমাদের ভাবতে হবে নতুন করে। তখনই আমরা আমাদের দেশকে বাঁচাতে পারব। বিশ্বের ইতিহাসে এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেছেন মাহাথির, তিনি যুগে যুগে প্রেরণা জোগাবেন। বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের প্রতীক নেলসন ম্যান্ডেলা নতুন গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করার প্রয়াসে তিনি তার দেশে তিনটি মৌলিক নীতি অনুসরন করেছিলেন।
১. আপস আলোচনায় আমরা বা আমাদের শক্ররা কেউই বিজয়ী হবে না, বিজয়ী হবে আমাদের দেশের জনগন।
২. কোনো একটি রাজনৈতিক দল নয়, আফ্রিকান জনগনকে জিততে হবে।
৩. ছোট দলগুলোকে আমরা বাদ দেইনি কারন আমরা জনগনের আস্থা অর্জন করতে চাই।
ম্যান্ডেলার এ কথাগুলোও যেন সত্যে পরিনত হয়েছে মাহাথিরের বিস্ময়কর বিজয়ে। ম্যান্ডেলা একথাগুলো ঢাকা এসে বলেছিলেন ১৯৯৭ সালে স্বাধীনতা দিবসের রজতজয়ন্তীতে। বর্তমানে আমাদের বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও ম্যান্ডেলার সেই কথা গুলো বড় বেশী তাৎপর্যময় বলে মনে হয়। মালয়েশিয়ার সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক দীর্ঘকালের। মাহাথির ক্ষমতায় আসায় বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক আরও বৃদ্ধি পাবে বাংলাদেশের জনগন তাই প্রত্যাশা করেন। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদকে, সে দেশের সর্বস্তরের জনগণকে আন্তরিক অভিনন্দন।
লেখক-মোহাম্মদ আবু তাহের ,ব্যাংকার ও কলামিস্ট, মৌলভীবাজার।
মন্তব্য করুন